স্বাধীনতার অর্ধশতকে বাংলাদেশের উন্নয়ন ও অর্জন
স্বাধীনতার অর্ধশতকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষিতে বড় ধরনের সাফল্য রয়েছে। এই অর্ধশতকে অর্থনীতির আকার কয়েক গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে—১৯৭১ সালে যা ছিল ৮.৭ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির অর্থনীতি, বর্তমানে তা ৪১৬.৩ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে রূপান্তরিত হয়েছে। এর পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ আর্থ-সামাজিক সূচকগুলোর প্রেক্ষাপটেও রয়েছে বেশকিছু অর্জন।
স্বাধীনতার পর, যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অবকাঠামোর পাশাপাশি একটি কৃষিনির্ভর অর্থনীতি আমরা পেয়েছি, যেখানে ছিল মানব উন্নয়নের নানামুখী চ্যালেঞ্জ।
তবে কয়েক দশকে অর্থনীতির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অর্জন অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে—যার প্রেক্ষিতে বর্তমানে আমাদের মাথাপিছু জিডিপি পৌঁছেছে ২৭৩৪ ডলারে এবং এক দশক ধরে প্রতি বছর ৬ শতাংশেরও বেশি প্রবৃদ্ধি আমরা অর্জন করতে পেরেছি। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ দারিদ্র্যের হার ২৪.৩ শতাংশে নামিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছে, যা ৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময়েও ৫০ শতাংশ ছিল।
আরও পড়ুন >>> ২০২২ কেমন ছিল?
যদিও বাংলাদেশের এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির মূল চালিকা শক্তিগুলো আলাদা করে চিহ্নিত করা কঠিন, তবে বেশকিছু বিষয় রয়েছে যা আমাদের অর্থনীতি গড়ে তুলতে বিশেষভাবে সাহায্য করেছে এবং এর উন্নয়নে অবদান রেখেছে।
এই প্রসঙ্গে সর্বপ্রথমে বলা যেতে পারে কৃষিখাতের কথা—৭০-এর দশকে এবং বিশেষ করে ৮০-এর দশকে বিজ্ঞানীদের দ্বারা বিভিন্ন প্রজাতির ফসলের উদ্ভাবন এবং এই ধরনের উদ্ভাবনের সফল বাস্তবায়ন দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলেছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার, যা বিশেষ করে সাম্প্রতিক দশকে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে।
বস্তুত, প্রতিনিয়ত বন্যা তথা প্রাকৃতিক দুর্যোগের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে খাদ্য উৎপাদনে টেকসই অগ্রগতি নিশ্চিত করার ফলে ক্ষুধা, দারিদ্র্য ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব হয়েছে।
বাংলাদেশের স্থিতিশীল ও ধারাবাহিকভাবে উচ্চ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ খাত হচ্ছে রপ্তানি খাত, বিশেষ করে তৈরি পোশাক খাত। বর্তমানে বাংলাদেশ যে শুধু বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ তা-ই নয়, এই খাত কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে, বিশেষ করে নারীদের কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করে আসছে।
আরও পড়ুন >>> ২০২২ সাল নারীর জন্যে কেমন ছিল?
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের পেছনে প্রবাসী অভিবাসী শ্রমিকদের অবদান অনস্বীকার্য। একদিকে, ম্যাক্রো দৃষ্টিকোণ থেকে, প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্স বৈদেশিক রিজার্ভের একটি প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করে আসছে, অন্যদিকে, অভিবাসীদের প্রেরিত অর্থ গ্রামীণ অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রেখে আসছে।
বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতির বিকাশে আর একটি গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটক হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রসার, যা বিশেষ করে সাম্প্রতিক দশকে স্বনিয়োজিত কর্মসংস্থান তৈরিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির যাত্রা ত্বরান্বিত করতে ক্ষুদ্র ঋণদান কর্মসূচিরও বিশেষ ভূমিকা রয়েছে, এই ধরনের কর্মসূচিগুলো গ্রামীণ পরিবারগুলোর আনুষ্ঠানিক ঋণের প্রাপ্তির মাধ্যমে উৎপাদনশীল কাজে অংশগ্রহণ সহজ করেছে।
বাংলাদেশের সাফল্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানব উন্নয়নের অন্যান্য প্রেক্ষাপটে আমাদের উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি রয়েছে।
বাংলাদেশের সাফল্য শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং মানব উন্নয়নের অন্যান্য প্রেক্ষাপটে আমাদের উল্লেখযোগ্য প্রাপ্তি রয়েছে। মানব উন্নয়নের প্রেক্ষিতে, কয়েকটি মারাত্মক রোগের বিরুদ্ধে শিশুদের দেশভিত্তিক টিকাদান কর্মসূচি প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ শিশুকে মৃত্যু ঝুঁকি থেকে রক্ষা করে আসছে।
আরও পড়ুন >>> আর কত মাটির কান্না?
সামাজিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অর্জনের মধ্যে আরও রয়েছে ডায়রিয়ার মতো সংক্রামক রোগের বিরুদ্ধে ঘরে তৈরি খাবার স্যালাইনের মতো স্বল্পমূল্যের চিকিৎসা পদ্ধতি, দেশব্যাপী পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচির সম্প্রসারণের মাধ্যমে জন্মহারের উল্লেখযোগ্য হ্রাস ইত্যাদি।
তবে শুধু জনস্বাস্থ্যের ক্ষেত্রেই নয়, কন্যা সন্তানের শিক্ষার ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের সাফল্য রয়েছে—এক্ষেত্রে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তি কর্মসূচির কথা বলা চলে, যা কি না কন্যা শিশুদের স্কুলে উপস্থিতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে মনে করা হয়।
সামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি, আমাদের বেশকিছু অবকাঠামোগত সাফল্যও রয়েছে, যেমন যমুনা সেতু, পদ্মা সেতু ইত্যাদি, যা বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধির গতিতে অবদান রেখেছে। এই ধরনের যোগাযোগ অবকাঠামোগুলো অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোয় পৌঁছে দিতে এবং এর মাধ্যমে পূর্ব-পশ্চিম এবং উত্তর-দক্ষিণের অর্থনৈতিক বিভাজনকে কমাতে সহায়তা করেছে।
অস্বীকার করার উপায় নেই যে বিগত দশকে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, দারিদ্র্য বিমোচনসহ স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বেশ কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসনীয়।
এই ধরনের অর্জন সত্ত্বেও, প্রবৃদ্ধির গুণগত মানের প্রসঙ্গে প্রশ্ন রয়েই যায় যখন আমরা দেখি যে, মোট জনগোষ্ঠীর ২৪.৩ শতাংশ ন্যূনতম চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারছেনা কিংবা দেশের সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশ মোট আয়ের ২৭.৮ শতাংশ আয়ের মালিক (খানা জরিপ ২০১৬)। এছাড়া অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সাথে তুলনা করলে, কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে আমাদের প্রাপ্তি সেরকম আশানুরূপ নয়।
আরও পড়ুন >>> মেট্রোরেল অর্থনীতির নতুন জাগরণ
আমাদের ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধির ইতিবাচক চিত্র তাই ম্লান হয়ে যায় দারিদ্র্যতা বিমোচন, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে তাকালে।
সাম্প্রতিক সময়ে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস ও এর সাথে সাথে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি সামস্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। এছাড়াও বেশ কয়েকটি প্রাতিষ্ঠানিক দিক, যেমন ব্যাংকিং খাতে ঋণখেলাপী এবং আর্থিক খাতে অনিয়ম, সরকারি ব্যয়ে অদক্ষতা, উন্নয়ন ব্যয়ের ক্ষেত্রে সক্ষমতার চ্যালেঞ্জগুলো রয়েই গেছে।
পরিশেষে বলা চলে যে, এই ধরনের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও, বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশের অর্জন প্রশংসার দাবিদার—তবে উচ্চ আয়ের দেশের লক্ষ্য কিংবা টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য, অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নীতি প্রণয়ন ও এর বাস্তবায়ন হওয়া জরুরি।
অধ্যাপক ড. সায়মা হক বিদিশা ।। অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়