নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন কেন জরুরি?
বেঁচে থাকার তাগিদে আমরা খাবার খাই। প্রতিদিন আমরা যা খাচ্ছি সবই কি নিরাপদ? অবশ্যই না। কিন্তু নিরাপদ করা যায়। শুধু সদিচ্ছা থাকলেই সম্ভব। গণমাধ্যমে প্রতিনিয়ত খাদ্যে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল মেশানোর খবর দেখছি যা আমাদের শঙ্কিত করে তোলে।
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ বা খাদ্য সুরক্ষা বলতে খাদ্যবাহিত অসুস্থতা প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে খাদ্য ব্যবহার, প্রস্তুতকরণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও সংরক্ষণের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে বোঝায়। কোনো ধরনের খাদ্য গ্রহণের পরে দুই বা তার অধিক ব্যক্তি একই ধরনের অসুস্থতায় পতিত হলে সেই ঘটনাকে খাদ্যবাহিত অসুস্থতার প্রাদুর্ভাব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
পোল্ট্রি বা প্রাণিদেহে ঘনঘন অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের খবর আমরা গণমাধ্যম থেকে জানতে পারি। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পর উইথড্রল পিরিয়ড (withdrawal period)-এর ভেতর যদি মাংস আমাদের পেটে যায়, তবে কিছু না কিছু অ্যান্টিবায়োটিক রেসিডিউ (Residue) আমাদের শরীরে যাবেই বা যাচ্ছেই। এটাই বিজ্ঞান। এখানে যুক্তিতর্কের কোনো অবকাশ নেই।
পোল্ট্রি বা ফিশ ফিডে যদি হেভিমেটালযুক্ত কিছু থাকে, তবে মাছ বা মাংসের মাধ্যমে তা আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে। হেভিমেটাল শত বছরেও নষ্ট হয় না...
উইথড্রল পিরিয়ড পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে কঠোরভাবে পালন করা হয়। আমাদের দেশে তা হয় না। পোল্ট্রি বা প্রাণিদেহে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের পরই আমরা বিক্রির জন্য অস্থির হয়ে উঠি। টাকায় যেন সব, মানুষের শারীরিক সুস্থতা বা নিরাপত্তার কথা আমরা ভাবি না। ফলে আমরা অনেক বেশি রোগাক্রান্ত হচ্ছি।
আরও পড়ুন : প্রান্তিক মানুষ আর কত ধাক্কা সামলাবে?
পোল্ট্রি বা ফিশ ফিডে যদি হেভিমেটালযুক্ত কিছু থাকে, তবে মাছ বা মাংসের মাধ্যমে তা আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে। হেভিমেটাল শত বছরেও নষ্ট হয় না।
কৃষি জমিতে যদি শিল্প বর্জ্য বা কীটনাশকে হেভিমেটাল থাকে, তবে সেই জমির ফসলে কিছু না কিছু হেভিমেটাল পাওয়া যাবেই। সেখান থেকে আমাদের পেটে যাবে।
আমাদের দেশকে এসব অভিশাপ থেকে যতদিন সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করা না যাবে, ততদিন নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ অধরাই থেকে যাবে।
ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করা বা নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতকরণ বা খাদ্য সুরক্ষার কাজে যারা জড়িত তারাও কিন্তু অনিরাপদ খাবারই খাচ্ছেন। তাদের পরিবার-পরিজনও একইভাবে অনিরাপদ খাবারই খাচ্ছেন। ফলে আমরা সবাই ডুবে যাচ্ছি আকণ্ঠ নীল বিষে।
আরও পড়ুন : মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত : সবার জীবন যায় যায়
শুধু টাকা আর টাকা! আমাদের দরকার শুধু টাকা। টাকায় কি আমাদের মুক্তি দেবে? যদি সুস্থভাবে চলতে ফিরতে না পারি তবে কি টাকা দিয়ে সবকিছু উদ্ধার করা সম্ভব?
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতিবছর প্রায় ৬০ কোটি মানুষ দূষিত খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়। এই কারণে প্রতিবছর মারা যায় চার লাখ ৪২ হাজার মানুষ। এছাড়া, ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৪৩ শতাংশই খাবারজনিত রোগে আক্রান্ত হয়, প্রতিবছর প্রাণ হারায় ১ লাখ ২৫ হাজার শিশু।
বিষাক্ত খাবার খেলে মানুষের মৃত্যু কিন্তু সাথে সাথেই হয় না, ধীর গতিতে হয়। আমরা চাইলে নিরাপদ খাদ্য ক্রয়-বিক্রয়ের একটি হাব চালু করতে পারি। যেখানে দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, ঘরের তৈরি খাবার, সবজি, ফলমূল সবই থাকবে।
বিষাক্ত খাবার খেলে মানুষের মৃত্যু কিন্তু সাথে সাথেই হয় না, ধীর গতিতে হয়। আমরা চাইলে নিরাপদ খাদ্য ক্রয়-বিক্রয়ের একটি হাব চালু করতে পারি। যেখানে দুধ, মাছ, মাংস, ডিম, ঘরের তৈরি খাবার, সবজি, ফলমূল সবই থাকবে।
যেখানে একটা সমৃদ্ধ ডাটাবেজ থাকবে। যে ডাটাবেজ থেকে আমরা নিরাপদ খাবার পেতে পারি। যে খাবারগুলো থাকবে অ্যান্টিবায়োটিক এবং হেভিমেটাল ফ্রি। ডাটাবেজে প্রত্যেক বিক্রেতা তাদের খাবার তিন মাস পরপর ল্যাবে টেস্ট করাবেন। ল্যাবের সেই রিপোর্ট ক্রেতা দেখতে পারবেন।
আরও পড়ুন : প্রান্তিক মানুষের বেঁচে থাকার দায়
নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তা এখন সব জেলাতেই নিয়োগ পেয়েছেন। অন্যের উপর নির্ভর না করে তারাই কিন্তু কাণ্ডারির ভূমিকা পালন করতে পারে। উপজেলা বা ইউনিয়ন ভিত্তিক পাইলট প্রকল্প তারা হাতে নিতে পারেন। এরা যদি নিধিরাম সর্দারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, তাহলে আমাদের সব আশা ভরসা শেষ।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রোগাক্রান্ত এবং অসুস্থ জাতি হিসেবে গড়ে তোলার দায় থেকে আমরা কোনোভাবেই রেহাই পাব না, যদি না আমরা নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন জোরদার করতে না পারি। তাই আমাদের এখনই নিরাপদ খাদ্য আন্দোলন জোরদার করা উচিত, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বিষমুক্ত খাবার গ্রহণ করতে পারে।
মাহবুব কবীর মিলন ।। অতিরিক্ত সচিব (পিআরএল) ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ইভ্যালি