সীমান্ত সংকট ও মিয়ানমারের সামরিকায়ন : কী করছে বিশ্ব?
২০২২ এর আগস্ট ও সেপ্টেম্বরে মিয়ানমারের ভেতরে সীমান্ত এলাকা থেকে সংঘর্ষের নিয়মিত সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে। দেশের সামরিক বাহিনীর সাথে বেশ কয়েকটি জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর তুমুল সংঘর্ষ চলছে। ২৮ আগস্ট যে দুটি মর্টারশেল বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে এসে পড়েছে তাতে সেইসময় কোনো ক্ষয়ক্ষতি না হলেও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।
দুটি মর্টার শেল পড়ার ঘটনায় বাংলাদেশ মিয়ানমারের কাছে কূটনৈতিক কড়া প্রতিবাদ জানিয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আরও মনে করেছে যে, দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান ব্যবস্থা ব্যবহার করে ‘সংলাপ ও আলোচনার’ মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যেকোনো উত্তেজনা এড়ানো সম্ভব।
১৬ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার, মিয়ানমার থেকে ছোড়া মর্টারশেল বিস্ফোরণে বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ১ রোহিঙ্গা যুবক নিহত ও আরও ৪ রোহিঙ্গা আহত হওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে। ঘুমধুম ইউনিয়নের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ায় বাংলাদেশ ভূখণ্ডের শূন্যরেখায় এই ঘটনা ঘটে।
আরও পড়ুন : সীমান্তে গোলাবর্ষণ, রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী দল ও আমাদের করণীয়
মিয়ানমারে অভ্যন্তরীণ এই সংঘাত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকায় শঙ্কা ও নিরাপত্তার সংকট তৈরি করেছে। একই সাথে ২০১৭ সালের পর থেকে এই সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকায় শরণার্থী শিবিরে বাস করা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর প্রত্যাবাসন ও এই সমস্যার একটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের প্রচেষ্টা অনিশ্চিত করে তুলেছে।
মিয়ানমারের সামরিক অভিযানের ফলে বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যে ভীতি ও শঙ্কা তৈরি করছে তা কি নিছকই ‘অনিচ্ছাকৃত ঘটনা’? এই বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো—মিয়ানমার রাষ্ট্র ও-এর জান্তা সরকার যে সুদীর্ঘ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছে তা রোহিঙ্গা সমস্যা নিরসনে ও আঞ্চলিক নিরাপত্তার ক্ষেত্রে কি গুরুত্ব বহন করে? এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কি তাদের দায়িত্ব পালন করতে সক্ষম হচ্ছে?
বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় মনে করেছে যে, দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে বিদ্যমান ব্যবস্থা ব্যবহার করে ‘সংলাপ ও আলোচনার’ মাধ্যমে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে যেকোনো উত্তেজনা এড়ানো সম্ভব।
২০২১ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতার পরিপূর্ণ দখল নেওয়ার পর থেকে মিয়ানমার নতুন সহিংস অধ্যায়ে প্রবেশ করেছে। এই অভ্যুত্থানের পরে জাতিগত সশস্ত্র সংগঠনগুলো নতুন করে সংগঠিত হয় এবং তাতমাদাও (মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী) এদের বিরুদ্ধে লড়াই আরও জোরদার করে। সরকার বিরোধী আন্দোলন সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে।
সামরিক জান্তাকে প্রতিহত করার অঙ্গীকার করে বিরোধী রাজনীতিবিদ, প্রাক্তন আইন প্রণেতা ও রাজনৈতিক কর্মীরা মিলে ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (NUG) গঠন করে। এরা তাতমাদাও-এর বিরুদ্ধে সারাদেশে সংগঠিত হয়ে সামরিক অভিযান শুরু করেন।
আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা : কূটনীতির সুফল মিলবে কবে?
সামরিক বাহিনী বিরোধী গোষ্ঠী ও বিক্ষোভকারীদের ওপর নৃশংস দমন পীড়ন করেছে। তবে এখনো দেশের বৃহৎ অঞ্চলের উপর নিয়ন্ত্রণ একীভূত করতে সক্ষম হয়নি। স্বাধীন আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের একটি দল তাদের এক বিশ্লেষণে বলছে যে, তাতমাদাও মিয়ানমারের মাত্র ১৭ শতাংশ স্থিতিশীলভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে।
২০২২ এর জুন মাস থেকে রাখাইন এবং মিয়ানমারের দক্ষিণ চিনে তাতমাদাও এবং আরাকান আর্মির মধ্যে ক্রমবর্ধমান উত্তেজনা ভারী অস্ত্র এবং বিমান হামলাসহ ঘন ঘন সশস্ত্র সংঘর্ষের খবর পাওয়া যাচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের মংডু, রাথেদাউং, বুথিদাউং এবং ম্রাউক-উ টাউনশিপ এবং চিন রাজ্যের পালেতওয়া শহরে বেশিরভাগ লড়াইয়ের ঘটনা ঘটেছে।
জাতিসংঘের সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুসারে, ৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রায় দশ হাজারের উপরে মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে, যা চিন রাজ্যের রাখাইন এবং পালেতওয়া শহরে অতীত এবং বর্তমানের সংঘাত মিলিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত মানুষের (IDPs) সংখ্যা প্রায় লক্ষাধিক।
আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ প্রশাসনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে আসছে এবং স্বাধীন নিজস্ব সরকার গঠন করেছে।
তাতমাদাও রাজ্যগুলোয় প্রধান সড়ক ও নৌপথ অবরুদ্ধ করেছে, বেসামরিক মানুষের চলাচল সীমিত করেছে এবং মানবিক সহায়তা প্রয়োজনে মানুষের কাছে পৌঁছাতে বাধা দিয়ে চলেছে। অন্যদিকে এই সংঘর্ষের ফলে মিয়ানমার থেকে নতুন শরণার্থী ভারতে প্রবেশ করেছে। এছাড়াও নতুন করে রোহিঙ্গা জনগণের বাংলাদেশে প্রবেশের আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। যদিও বাংলাদেশ সরকার নতুন করে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী গ্রহণের ব্যাপারে নারাজি প্রকাশ করে আসছে।
মিয়ানমারের সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক দশকের বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সাথে লড়াই ও তাদের দমন করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপট ভিন্ন। বর্তমানে তাতমাদাও পরিবর্তনশীল শত্রুর গেরিলা কৌশলের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করতে সংগ্রাম করছে।
আরও পড়ুন : আরসা’র অস্তিত্ব ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা
দেশের কিছু অঞ্চলে, প্রধান প্রাদেশিক কেন্দ্রগুলোর বাইরে শাসনব্যবস্থায় তাদের নিয়ন্ত্রণ কমছে। আরাকান আর্মি রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ প্রশাসনের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ দাবি করে আসছে এবং স্বাধীন নিজস্ব সরকার গঠন করেছে।
চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট এবং চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্সের একটি জোট গঠন করে চিন রাজ্যের ‘মুক্ত’ অঞ্চলগুলোর জন্য একটি নতুন সরকার প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করছে। কাচিন ইন্ডিপেন্ডেন্স আর্মি (কেআইএ), ইউনাইটেড ওয়া স্টেট আর্মি (ইউডাব্লিউএসএ) এবং তাদের সহযোগী সশস্ত্র সংগঠনগুলো কাচিন রাজ্য এবং শান রাজ্যে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রসারিত করেছে। এই পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সামগ্রিক ভবিষ্যৎ বেশ হুমকির মুখে পড়েছে।
তাতমাদাও-এর আগ্রাসন বন্ধে ও মিয়ানমারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা স্থাপনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন ও বিশ্বব্যাপী এর অর্থনৈতিক প্রভাবে মিয়ানমারের উপর থেকেও একই সাথে রোহিঙ্গা সমস্যার উপর থেকে কিছুটা হলেও পশ্চিমা শক্তিশালী দেশগুলোর দৃষ্টি বিচ্যুতি ঘটেছে। তাছাড়াও তাতমাদাও-এর ভবিষ্যৎ বেশকিছুটা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে তার একটি বড় কারণ হলো রাশিয়া এই বাহিনীর অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী।
ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের পর অস্ত্র সরবরাহের গতি কমে গেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। অন্যদিকে চীন তাতমাদাও-এর অন্যতম প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। তবে ঐতিহাসিকভাবে মিয়ানমারে উভয় পক্ষের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখার নীতির অংশ হিসেবে চীন বেশ কয়েকটি প্রধান জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীকে অস্ত্র সরবরাহ করে থাকে।
তাতমাদাও-এর নিজস্ব অস্ত্র আর চীন ও রাশিয়ার আশ্বাস তাদের পুরোপুরি নিশ্চিত করতে না পারলেও; আরও বেপরোয়া ও আগ্রাসী করে তুলছে।
অন্যদিকে শান্তি আলোচনায় যোগদানের জন্য সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর কাছে রাষ্ট্র প্রধান জ্যেষ্ঠ জেনারেল মিন অং হ্লাইং-এর আবেদন খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। তারা শুধু এই আবেদন প্রত্যাখ্যান করেই ক্ষান্ত হননি, তারা চীন ও অন্যান্য দেশগুলোর কাছে সামরিক সাহায্যের অনুরোধ জানিয়েছে। তাদের মূল্যায়ন অনুসারে স্টিংগার-সদৃশ ক্ষেপণাস্ত্র এবং কয়েক হাজার সামরিক-গ্রেডের এম ফোর (M4) স্বয়ংক্রিয় রাইফেলের মাধ্যমে তারা সামরিক জান্তাকে উৎখাত করতে পারবে।
আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা সংকট : বিপদ যখন সর্বগ্রাসী!
সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর চাহিদা সম্মিলিতভাবে যতটুকু তা যুক্তরাষ্ট্রের বাইডেন প্রশাসন বর্তমানে ইউক্রেনকে যে সামরিক সহায়তা সরবরাহ করছে তার তুলনায় সামান্য।
যদিও যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো অ্যাসোসিয়েশন অফ সাউথইস্ট এশিয়ান নেশনস (আসিয়ানের) পাঁচ দফা ঐক্যমতের (ফাইভ পয়েন্ট কনসেনসাসের) প্রতি প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। তাই তারা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অস্ত্র নিষেধাজ্ঞার আহ্বান জানিয়েছে।
তাই সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো অস্ত্র সরবরাহ করা তাদের বর্তমান নীতির বিপরীত। কিন্তু চীন বা রাশিয়া এই রকম কোনো প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ নয়। সর্বোপরি তাদের অর্থনৈতিক স্বার্থ এখানে সামরিক বাহিনী ও তাদের সহযোগী মিত্রদের সাথে ওতপ্রতোভাবে জড়িত।
মিয়ানমারের অসামরিক ও রাজনৈতিক ঐক্যমতের সরকার চীনের স্বার্থ কতখানি নিশ্চিত করতে পারবে, তার উপর নির্ভর করবে বর্তমান সমস্যার সমাধানে চীন কী ধরনের সক্রিয় ভূমিকা রাখবে।
আপাতদৃষ্টিতে এটা মনে হতে পারে যে, পশ্চিমাদের মনোযোগ প্রধানত ইউক্রেনের দিকে ধাবিত হয়েছে। আঞ্চলিক রাষ্ট্রীয় জোট আসিয়ান এই সমস্যা সমাধানে খুব একটা কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়নি।
জাতিসংঘ সামরিক বাহিনীকে গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করেছে। যদিও তার কোনো ব্যবহারিক প্রয়োগ তাতমাদাওকে শান্ত করতে কার্যকর হয়নি। তাতমাদাও-এর উপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা জারি করা হলেও অভ্যন্তরীণভাবে তাদের আগ্রাসন আরও গতি লাভ করেছে। সশস্ত্র প্রতিরোধ আন্দোলন বাগে আনতে জান্তা সরকারকে সংগ্রাম করতে হচ্ছে। আর তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় তারা মানবাধিকার লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ পর্যায়ে যেতে দ্বিধা করছে না।
আরও পড়ুন : মুহিবুল্লাহ হত্যা : রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অপরাধ ও অস্থিরতা
জান্তা সরকারের কূটনৈতিক অভিযান পর্যবেক্ষণযোগ্য। তাদের অবস্থার উত্তরণে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক সমর্থন আদায়ে রাশিয়ার প্রতি সামরিক জান্তার আহ্বান জোরদার হয়েছে। অতি সম্প্রতি জেনারেল মিন অং হ্লাইং রাশিয়াতে রাষ্ট্রপতি পুতিনের সাথে দেখা করেছেন এবং মিয়ানমার রাশিয়া থেকে তেল কেনার এবং রুবেলে অর্থ প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান এই সংঘর্ষের প্রভাব শুধু মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমাবদ্ধ থাকছে না, সীমান্তবর্তী বাংলাদেশ অংশে উত্তাপের আঁচ টের পাওয়া যাচ্ছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতকে তাদের জান্তা সরকারের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন চিন্তার সংমিশ্রণ ঘটাতে হবে।
মিয়ানমারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া এবং একটি ঐক্যমতের অসামরিক সরকার স্থাপিত না হলে, শুধুমাত্র তাতমাদাও-নিয়ন্ত্রিত বর্তমান সরকার দীর্ঘমেয়াদে চীন ও রাশিয়া যে পরিবর্তিত বিশ্বব্যবস্থার স্বপ্ন দেখছে তাতে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না।
এই দুই শক্তিশালী দেশের যা বোঝা উচিত—দীর্ঘস্থায়ী সংঘর্ষ ও প্রতিবেশী দেশগুলোর নিয়মিত বিরতিতে শরণার্থী প্রেরণ এবং মাদক সমস্যাকে প্রশ্রয় প্রদান—আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতার পুনরায় উৎপাদন ঘটাবে, তা কোনোভাবেই মিয়ানমারে বা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশগুলোর স্বার্থের সম্প্রসারণ ঘটাতে সক্ষম হবে না।
তুরস্ক বা মুসলিম দেশগুলোর জোট—ওআইসিকে বিভিন্ন সময় মিয়ানমারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিপরীতে বিবৃতি দিতে দেখা গেছে। মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতে (আই সি জে) গণহত্যার অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন করতে ওআইসি গাম্বিয়াকে সমর্থন করেছে। কিন্তু সম্মিলিতভাবে মিয়ানমার জান্তা সরকারকে প্রতিহত করার মতো কার্যকরী পদক্ষেপ এর সূত্রপাত এখান থেকে দেখা যায়নি।
অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন—তাতমাদাও-এর বর্বরতার রাজত্বকেই আরও প্রসারিত করবে। এর ফলে শুধুই মিয়ানমারের জনগণ যে ভোগান্তি পোহাবে তা নয়; প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারত এর উত্তাপ থেকে রেহাই পাবে না।
সম্প্রতি মার্কিন কংগ্রেস বেশকিছু সামরিক নিষেধাজ্ঞার অনুমোদন করে এবং মার্কিন সরকারকে রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচার গণহত্যার উদাহরণ হিসেবে নির্ধারণের সুপারিশ করেছে।
ইউরোপীয় পার্লামেন্টও ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্মেন্ট অফ মিয়ানমারের বৈধ সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া সমর্থন করেছে এবং সামরিক মালিকানাধীন ব্যবসার বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নের আরও নিষেধাজ্ঞা আরোপের আহ্বান জানিয়েছে। কিন্তু এই দেশগুলো এবং জাপান বা কোরিয়ার মতো দেশগুলো মিয়ানমারের সাথে পরিপূর্ণভাবে ব্যবসায়ী সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করতে সক্ষম হয়নি। তাই জান্তা সরকারের শাসনের বৈধতা কখনো সার্বিকভাবে হুমকির সম্মুখীন করা যায়নি।
আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা সংকট : ক্ষতের গভীরতা কতটা মাপতে পারছি?
যদি এই প্রবণতা অব্যাহত থাকে, তাহলে সামরিক শাসক গোষ্ঠী আগামী বছরের নির্বাচন প্রভাবিত করে তাদের ক্ষমতায় থাকাকে দীর্ঘায়িত করবে এবং আরও কিছু আন্তর্জাতিক বৈধতা অর্জনে সফল হবে। এই জান্তা সরকারের শাসন করার ধরণ আর মানসিকতা বহু বছর ধরে এর শাসনতান্ত্রিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণের একচ্ছত্র অভিজ্ঞতার উপর পর্যবসিত।
এই কাঠামো তাই একেবারে গোঁড়া থেকে পরিবর্তন না করলে—অর্থাৎ সম্পূর্ণ আ-সামরিকীকরণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসনব্যবস্থার প্রবর্তন—তাতমাদাও-এর বর্বরতার রাজত্বকেই আরও প্রসারিত করবে। এর ফলে শুধুই মিয়ানমারের জনগণ যে ভোগান্তি পোহাবে তা নয়; প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশ ও ভারত এর উত্তাপ থেকে রেহাই পাবে না।
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, প্রতিবেশী রাষ্ট্র সমূহ এবং আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর তাই মিয়ানমারে সম্মিলিত হস্তক্ষেপের ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত থাকার কোনো অবকাশ নেই।
ড. নিলয় রঞ্জন বিশ্বাস ।। সহযোগী অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়