সীমান্তে গোলাবর্ষণ, রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী দল ও আমাদের করণীয়
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্তে মিয়ানমার মর্টারশেল নিক্ষেপ করছে। একদিকে রোহিঙ্গা সংকট আরেকদিকে বাংলাদেশি সীমান্তে মিয়ানমারের মর্টারশেল নিক্ষেপ এর থেকে পরিত্রাণ আমাদেরই খুঁজে বের করতে হবে। আমাদের সেই সক্ষমতা কি আছে?
রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে আরসা সক্রিয় অনেকদিন ধরে। আরসার রাজনৈতিক পরিচয় কী? আরসার আগের নাম ছিল আল ইয়াকিন বা বিশ্বাসের সংগ্রাম বা ঈমানের সংগ্রাম। এর ঘোষিত উদ্দেশ্যই ছিল আরাকানে বসবাসরত রোহিঙ্গা মুসলমানদের অধিকার রক্ষা করা এবং এই উদ্দেশ্যে ওরা ২০১২ সালে আরাকানে একটা সাম্প্রদায়িক সংঘাত সৃষ্টি করে। সেই সংঘাতের পর ওরা ২০১৩ সালের দিকে সংগঠনের নাম পাল্টে রাখে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি বা আরসা।
দৃশ্যতই এটা একটা সামরিক সংগঠন এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের সামরিক সংগঠন। এই বাহিনী প্রধানের নাম আতাউল্লাহ আবু আম্মার, সে আবার ডাকনাম গ্রহণ করেছে জুনুনি। এই আতাউল্লাহর জন্ম সৌদি আরবে, তার পিতামাতা আরাকান থেকে গিয়ে সৌদি আরবে স্থায়ী হয়। কিন্তু জন্ম সৌদি আরবে হলেও আতাউল্লাহ পরে পাকিস্তানের করাচিতে এসে বসবাস করতে থাকে এবং এখনো সে করাচি থেকেই তার রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে।
আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা সংকট : আমাদের কী উপায়
ইউটিউবে খুঁজলে আতাউল্লাহর ভিডিও বার্তা পাওয়া যায়। সেখানে করাচিতে বসে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ক্রিয়াশীল আরসা সদস্যদের উদ্দেশ্যে প্রকাশ্য নির্দেশনা প্রদান করে। গোপন নির্দেশনা নিশ্চয়ই আলাদা যোগাযোগমাধ্যমে দেয়।
২০১৬ ও ২০১৭ সালে তারা আরাকানে অনেকগুলো সংঘর্ষ পরিচালনা করে যার প্রতিক্রিয়াতেই রোহিঙ্গারা মিয়ানমার ছেড়ে আসতে বাধ্য হয়। ২০১৭ সালের পর আরসার খুব বেশি তৎপরতা আরাকানে দেখা যায়নি, তবে কক্সবাজারের ক্যাম্পে ওরা আছে, ওদের কাছে অস্ত্রশস্ত্রও আছে।
২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে আরাকানে আরেকটা মুসলিম সশস্ত্র গ্রুপের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে, ওদের নাম রোহিঙ্গা সলিডারিটি অরগানাইজেশন (Rohingya Solidarity Organisation or RSO) বা আরএসও। আরএসও সংগঠনটি এর আগেও ক্রিয়াশীল ছিল কিন্তু নব্বইয়ের দশকের পর ওদের আর কোনো কর্মতৎপরতার খবর পাওয়া যায়নি।
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো, যেমন মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া, ওরাও রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে নিয়ে আশ্রয় দেওয়া বা মিয়ানমারের সরকারের ওপর কঠিন চাপ তৈরি করার জন্য এগিয়ে আসেনি।
অনলাইনভিত্তিক জার্নাল দ্য ডিপ্লোমেটের রিপোর্ট থেকে জানা যায় যে, ২০২২ সাল থেকে আরাকানে ওদের সশস্ত্র তৎপরতা আবার শুরু হয়েছে। এই গ্রুপ নীতিগতভাবেই আরসা বিরোধী—ওরা মনে করে যে আরসা যথেষ্ট ইসলামী ভাবাপন্ন নয়।
সেই সাথে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে আরসার লোকেদের মাদক চোরাচালান, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস ইত্যাদি অপরাধমূলক কর্মতৎপরতার কারণেও আরএসও, আরসার তীব্র সমালোচনা করে। কিছুদিন আগে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যার জন্যে সাধারণভাবে আরসাকেই দায়ী করা হয়।
২০২১ সালে দ্য ডিপ্লোমেট আরেকটা জিহাদি সংগঠনের আবির্ভাবের খবর দিয়েছে, এর নাম কাতিবাহ আল-মাহদি ফি বিলাদ আল আরাকান (Katibah al-Mahdi fi Bilad al-Arakan) বা কেএমবিএ।
আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা : কূটনীতির সুফল মিলবে কবে?
২০০০ সালের শেষ দিকে এই সংগঠন কার্যক্রম শুরু করে। এই সংগঠন একদম সরাসরি ইসলামী স্টেট নামে যে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জিহাদি সংগঠন রয়েছে তাদের সাথে সম্পৃক্ত। আরও দুই একটা ক্ষুদ্র সশস্ত্র গ্রুপের সন্ধানও সম্ভবত পাওয়া যাবে খুঁজলে।
আরসা এবং এই যে গ্রুপগুলো এরা নিজেরা নিজেদের শত্রু। আবার আরাকানে যে বিদ্রোহী সশস্ত্র গ্রুপ আরাকানের স্বাধীনতার জন্য সশস্ত্র লড়াই করে যাচ্ছে, আরাকান আর্মি, ওদের সাথেও এইসব গ্রুপের শত্রুতা রয়েছে। আরাকান আর্মি সাধারণভাবে সব আরাকানির জন্যে স্বাধীন আরাকান চায়, কিন্তু আরসাকে ওরা চিহ্নিত করে মুসলিম সন্ত্রাসী গ্রুপ হিসেবে।
রোহিঙ্গাদের এতগুলো সংগঠনের কথা বলছি তার কারণ হচ্ছে, এইসব সংগঠনের চরিত্র ধরেই রোহিঙ্গা সংগঠনের রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করা হয়ে থাকে। তাই প্রত্যেকটা সংগঠনই সাম্প্রদায়িক সশস্ত্র গ্রুপ। ফলে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর দুঃখ দুর্দশার প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন হলেও কেউই এগিয়ে এসে রোহিঙ্গাদের সমর্থনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে খুব শক্ত কোনো অবস্থান নিতে চাইবে না বলেই আমি মনে করি।
রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি সব দেশেরই আছে, কিন্তু নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে ওদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে ঐ মৌখিক নিন্দার বাইরে গিয়ে যে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সেটা কেউ করছে না।
এমনকি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলো, যেমন মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়া, ওরাও রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া সত্ত্বেও রোহিঙ্গাদের নিজেদের দেশে নিয়ে আশ্রয় দেওয়া বা মিয়ানমারের সরকারের ওপর কঠিন চাপ তৈরি করার জন্য এগিয়ে আসেনি। না, কিছু কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপ যে ওরা নেয়নি সেটা নয়, কিন্তু কার্যকর চাপ তৈরি করা—অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক—সেটা কেউ করছে না।
এর জন্য প্রয়োজন ছিল রোহিঙ্গাদের মধ্যে এমন সংগঠন ও নেতৃত্বের বিকাশ হওয়া যারা রোহিঙ্গাদের মানবিক সমস্যা এবং অধিকারের দাবি সাম্প্রদায়িক বিবাদের ঊর্ধ্বে বিশ্বজনীন একটা দাবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্যে রাজনৈতিক সংগ্রাম করতে পারবে।
মুহিবুল্লাহ সেরকম একজন নেতা হতে পারতেন—তিনি রোহিঙ্গাদের মধ্যে এবং নানা আন্তর্জাতিক ফোরামে সক্রিয়ভাবে কিছু কাজও শুরু করেছিলেন। কিন্তু তাকেও তো আরসার লোকজন বছর খানেক আগে হত্যা করেছে।
আরও পড়ুন : আরসা’র অস্তিত্ব ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা
আমাদের দিক থেকেও দরকার ছিল আরসা এবং অন্যান্য সশস্ত্র গ্রুপকে শক্ত হাতে দমন করে রোহিঙ্গা সমস্যার মানবিক ও নৈতিক দিকটা ঊর্ধ্বে তুলে ধরে বিশ্বব্যাপী একটা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করা। সেভাবে করতে পারলে আমরাও নিশ্চয়ই বিশ্বের অনেক দেশের সমর্থন আদায় করতে পারতাম।
এমনিতেও রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভূতি সব দেশেরই আছে, কিন্তু নিজের কাঁধে দায়িত্ব নিয়ে ওদের স্বার্থ রক্ষার জন্যে ঐ মৌখিক নিন্দার বাইরে গিয়ে যে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে সেটা কেউ করছে না।
আমাদের মিত্র এবং বন্ধুভাবাপন্ন দেশগুলো নিয়ে এই ক্যাম্পেইন যদি আমরা করতে পারি তাহলে হয়তো একটা কিছু হয়—না হয় এই রোহিঙ্গারা যে কবে নিজেদের দেশে ফিরতে পারবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
আর মিয়ানমারে ফেব্রুয়ারির ক্যু হয়ে যাওয়ার পর থেকে অবস্থার আরও অবনতি হয়েছে। রোহিঙ্গারা তো পড়েছে আমাদের দায়িত্বে, আমাদের ঘরে। সুতরাং দায়িত্বটাও যেন আমাদেরই বেশি।
ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট