শনিবার বিকেল : খুলে যাক রুদ্ধ দ্বার
শনিবার বিকেল আমি দেখিনি। জেনেছি যে, এই চলচ্চিত্র আমাকে দেখতে দেওয়া হবে না কারণ আমি বাংলাদেশ থাকি। বাংলাদেশে থাকি এই কারণেই ভাবা হয়েছে যে, এই চলচ্চিত্র দেখার পর আমার মাথা ঘুরে যাবে বা আমার মাথা নষ্ট হয়ে যাবে।
হয়তো সিনেমা হল থেকে বেরিয়ে আমি কিছু একটা করে বসব বা কিছু একটা হয়ে যাবে বা কী হবে এইটাও আমি জানি না। আমার মাথার ভেতর এইটা এমনভাবে জট পাকাবে যে, আমি হয়তো এনারকিস্ট বা নৈরাজ্যবাদী হয়ে যাব তাই আমাকে শনিবার বিকেল দেখতে দেওয়া হচ্ছে না। অথচ এই চলচ্চিত্র বিশ্বের অনেকেই দেখেছেন এবং প্রশংসাও করেছেন।
একজন নির্মাতার মনে যখন একটি চলচ্চিত্রের ভাবনা আসে তখন এটি স্বপ্নের মতো থাকে। ধীরে ধীরে নির্মাতা সেই স্বপ্নকে বড় করে। চলচ্চিত্র মানেই স্ক্রিপ্ট, প্রি-প্রোডাকশন, শুটিং, এডিটিং, ডাবিং, কালার গ্রেডিং সবকিছুর বিশাল কর্মযজ্ঞ।
আরও পড়ুন : চলচ্চিত্র বিষয়ক এজেন্ডাটা কী?
অসম্ভব, অমানুষিক পরিশ্রমের পরে একটা চলচ্চিত্র দাঁড়ায়। তারপরে এটি প্রদর্শনের জন্য বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের কাছে জমা দিতে হয়। উন্নত বিশ্বে চলচ্চিত্রের জন্য সেন্সর বোর্ড, তা এখন অতীত।
অনেক মানুষের মিলিত শ্রমে আমি একটা চলচ্চিত্র নির্মাণ করলাম, সেই চলচ্চিত্র প্রদর্শনের জন্য আমাকে সেন্সর বোর্ডের অনুমতি নিতে হবে! কারো অনুগ্রহ বা বিচারের পর নির্ধারিত হবে সেই চলচ্চিত্র আদৌ দর্শকেরা দেখতে পারবেন নাকি পারবেন না।
চলচ্চিত্র মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলে সেই জায়গায় আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং তার প্রদর্শনী নিয়ে শত জটিলতা।
বিশ্বের কোথাও এইভাবে নির্মাতাদের সেন্সর বোর্ডের পেছনে ঘুরতে হয় না। একজন নির্মাতা মুক্তভাবনা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা করবেন। অনেকে মানুষের মিলিত প্রয়াসে একটা চলচ্চিত্রের সৃষ্টি, দর্শক সেই চলচ্চিত্র দেখবে কি, দেখবে না সেই বিবেচনা তার নিজস্ব।
চলচ্চিত্র মানুষের মানবিক মূল্যবোধ জাগিয়ে তোলে সেই জায়গায় আমাদের দেশে চলচ্চিত্র নির্মাণ এবং তার প্রদর্শনী নিয়ে শত জটিলতা। এতে করে আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি। এতে শিল্পের সৃজন হচ্ছে না, চলচ্চিত্র সঠিক পথে আগাচ্ছে না।
শিল্পের প্রসারে আঘাত আসা মানেই সব জায়গায় আঘাত আসা। আমাদের তরুণেরা এখন কিন্তু সৃজনশীল চিন্তা করছে না, প্রতিনিয়ত তাদের মধ্যে পশ্চাৎপদতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। বোধশূন্য জাতির উত্তরণের জন্য চলচ্চিত্র একটি শক্তিশালী মাধ্যম। সেটা এক বাক্যে সবাই স্বীকার করেছে। সব সভ্য দেশও তা স্বীকার করেছে, এজন্য চলচ্চিত্রে গল্প বলার স্বাধীনতা সেখানে বেশি।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশের চলচ্চিত্র (১৯৪৭-১৯৭৫) শিল্পের স্বকীয়তা
পৃথিবীর সব সভ্য দেশে একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা তার গল্প বলাতে স্বাধীন। চলচ্চিত্র নির্মাণের পর প্রদর্শনেও এখন বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুসরণ করা হয়। উন্নত বিশ্বের চলচ্চিত্রকে এখন সেন্সরের দ্বারস্থ হতে হয় না। এখন বয়স ভেদে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে চলচ্চিত্র উন্মুক্ত করা হয়।
শনিবার বিকেলের ক্ষেত্রে যা হয়েছে তা আসলে পরিষ্কার নয়। আমরা নিজেদের অগ্রসর ভাবি। উন্নত সমাজের নাগরিক মনে করি, ডিজিটাল বাংলাদেশও যদি ভাবি তাহলেও সেন্সরের এই প্রক্রিয়া এখন আধুনিক নয়, বরং সাংঘর্ষিক। এটি কোনোভাবেই চলে না। এই ভাবনা অচল। পেছনের ভাবনা, পুরোনো ভাবনা।
আরেকটি বিষয় সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক তা হলো, আমাকে সংবিধান স্বাধীনতা দিয়েছে আমার মতামত প্রকাশের, একজন নির্মাতারও স্বাধীনভাবে গল্প বলার অধিকার আছে, এটি সংবিধান স্বীকৃত অধিকার।
সমাজের অনেক বিষয় আমাকে নাড়া দেয়, অনেক ঘটনা আমাকে আন্দোলিত করে, অনেক কিছুই আমার মনকে তাড়িত করে সেজন্যই আমি চলচ্চিত্র নির্মাণে ব্রতী হই, যাতে আমি গল্পটা বলতে পারি। আমি যখন সমাজের যেকোনো ঘটনা চলচ্চিত্রে বলব, সেটি আমার পন্থায় হবে।
আরও পড়ুন : এখন তাহলে কোন জীবন থেকে নেবেন?
আমি যেভাবে গল্প বলতে চাই সেভাবেই গল্প বলব। সেখানে সত্য ঘটনা, ঘটনার চরিত্র আসতে পারে, তা অবশ্যই মুক্ত থাকতে হবে। সেন্সর আমার মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে হরণ করতে পারে না।
শুধু মোস্তফা সরয়ার ফারুকীই নয়, হলি আর্টিজানের হামলা নিয়ে হানসাল মেহতাও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘ফারাজ’ নামের সেই চলচ্চিত্র শনিবার বিকেলের আগেই দর্শক দেখতে পারবেন এইটা ভাবতেও কষ্ট লাগছে।
আমরা একসময় সেন্সর প্রথাকে সাধুবাদ জানিয়েছি, যখন অশ্লীলতার সময় ছিল, সেই সময় আমরা সেন্সর বোর্ডের কাছেই জানিয়েছি, অশ্লীলতা বন্ধ করা প্রয়োজন।
সেই সময় আমরা অতিক্রম করে এসেছি। এখন বিষয়ভিত্তিকভাবে সেন্সর করা সঠিক পথ নয়। কারো গান, কারো চলচ্চিত্র যদি বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে তার মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করা হবে।
‘গল্প বলার স্বাধীনতা’ চেয়ে নির্মাতা-শিল্পীদের যে প্রতিবাদ হয়েছে আমি এর পক্ষে একমত। নির্মাতা যদি তার গল্পই বলতে না পারেন তবে এই দেশে ভালো চলচ্চিত্র নির্মিত হবে না।
শনিবার বিকেল আমাদের দেখতে দিতে হবে। আমাদের নির্বোধ ভাবার কোনো কারণ নেই। কেন আমাদের এইভাবে ভাবা হচ্ছে যে, আমরা শনিবার বিকেল দেখলেই বুঝি নষ্ট হবে যাব? কেন আমাদের এত বোকা ভাবা হচ্ছে? সরকারের কাছে আমি জানতে চাই।
আরও পড়ুন : ভাষা আন্দোলনকে নিছক জাতীয়তাবাদী মোচড়ে আমি দেখি না
শুধু মোস্তফা সরয়ার ফারুকীই নয়, হলি আর্টিজানের হামলা নিয়ে হানসাল মেহতাও একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ‘ফারাজ’ নামের সেই চলচ্চিত্র শনিবার বিকেলের আগেই দর্শক দেখতে পারবেন এটা ভাবতেও কষ্ট লাগছে। এটা দুঃখজনক।
একজন নির্মাতা হিসেবে মোস্তফা সরয়ার ফারুকীর যন্ত্রণা আমি অনুধাবন করতে পারছি। অনেক আগে নির্মিত চলচ্চিত্র ফারুকী এখনো মুক্তি দিতে পারছেন না সেন্সর বোর্ডের কারণে, অপরদিকে হানসাল মেহতার চলচ্চিত্র সবাই শনিবার বিকেলের আগেই দেখতে পারবেন এইটা মানাও কষ্টদায়ক।
সরকারের প্রতি আমি অনুরোধ করব, আবেদন করব, দাবি জানাব, শনিবার বিকেল আমাদের দেখতে দিন।
শিহাব শাহীন ।। চলচ্চিত্র পরিচালক