রেলের দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা : বন্ধ হবে কবে?
তাকে যত ভালোবাসি, সে ততই আমাকে লজ্জার জলাশয়ে নিক্ষেপ করে। কতবার বাজি ধরেছি তাকে নিয়ে, কোনোবারই জিতে আসতে পারিনি। বাংলাদেশের রেলবিভাগ হচ্ছে সেই নিষ্ঠুর প্রেমিক।
একবার বিশেষ কুটুম এলেন সপরিবারে পশ্চিমের একদেশ থেকে। তাদের মুখে সেই দেশের রেল নিয়ে ফুলঝুরি। তারা উত্তরবঙ্গে বেড়াতে গেলেন বাসে। নিকট কুটুমের সঙ্গী আমিও।
ফেরার সময় বললাম, আমাদের রেল এখন অনেক আধুনিক। আরাম, আয়েশ, আদর ভালো, চলেন রেলে ফিরি। তিনি ও তার পরিবার রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ প্রবাসে বসে বা দেশে এসে রেল নিয়ে তারা গুণের খবর পাননি।
আরও পড়ুন : রেলের টিকিট কালোবাজারি : টিকিট যার ভ্রমণ তার
তারপরও হয়তো আমার আবদার ফেলতে না পেরে রাজি হলেন। কিন্তু সমস্যা হলো টিকিট কাটতে গিয়ে। কাউন্টারে টিকিট নেই। যে স্টেশন থেকে টিকিট কাটব সেখানে শীতাতপ কক্ষ এবং চেয়ারের আসনের বরাদ্দ কম। কিন্তু টিকিট পেতে কপালে ভাঁজ আনতে হলো না। বাড়তি দামে কিনতে হলো।
যাত্রার দিন স্টেশনে এসে হাজির হলাম নির্ধারিত সময়ের ঘণ্টা খানেক আগে সন্ধ্যা সাতটায়। ট্রেনের যাত্রা শুরুর সময় ছিল রাত ৮টা। শিশু, প্রবীণ নাগরিক নিয়ে রাত দুটো পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকার পর কাঙ্ক্ষিত ট্রেনের হুইসেল শুনতে পাই। এসময় পর্যন্ত নিকট কুটুম থেকে নিরাপদ দূরে ছিলাম। পুরো যাত্রা ছিল অস্বস্তির।
দমে যাইনি এরপরও দালালি করে যাচ্ছি, ভ্রমণে নিজের পছন্দের প্রথম তালিকায় যেমন রাখি রেল, অন্যদেরও সেই দলে আনার জন্য লবিং করি। কিন্তু দুর্লভ টিকিট, সময় মেনে না চলার অভ্যাসে আমার লবিং ভেস্তে যাচ্ছে।
কাউন্টারে টিকিট নেই। যে স্টেশন থেকে টিকিট কাটব সেখানে শীতাতপ কক্ষ এবং চেয়ারের আসনের বরাদ্দ কম। কিন্তু টিকিট পেতে কপালে ভাঁজ আনতে হলো না। বাড়তি দামে কিনতে হলো।
রেলে পরিচিত বন্ধু আছেন বেশ কয়েকজন, আবার গণমাধ্যম কর্মী হিসেবেও খাতির পাই, তারপরেও কখনো কখনো টিকিট না পাওয়া হরিণী হয়ে উঠে।
আরও পড়ুন : পরিকল্পিত মেট্রোরেল কেন জরুরি
ঈদ বা যেকোনো উৎসবে ট্রেনের টিকিটের জন্য হাহাকার, মল্লযুদ্ধের বাঁধাধরা দর্শক আমরা। দর্শক হিসেবে এও জানি টিকেট রেলের লোকের পকেটে পকেটে ঘুরে। চাক্ষুষ দেখেছি কী জাদুতে সেই পকেট থেকে বেরিয়ে আসে টিকিট।
হারানো রেল পথ ফিরিয়ে আনা, পুরোনো স্টেশন আবার সরগরম করার পাশাপাশি নতুন রেলপথ তৈরি করেছে বর্তমান সরকার। রেলপ্রেমীদের জন্য এই উদ্যোগ আনন্দের।
সরকার যাত্রীদের চিত্তে আরও সুখ দিতে টিকিট অনলাইনে থেকে কেটে নেওয়ার সুযোগ দিতে চাইল। কিন্তু সেই কোমল সম্ভার বা সফটওয়্যার থেকে কঠিন টিকিট পাওয়া কঠিনতর হচ্ছিল।
রেলবিভাগ টিকিট আরও সহজ করতে চাইল। বিধিবাম সেই সহজে পাওয়া গেল কালো ভূত। সেই ভূত হয়ে উঠল কালোবাজারের দৈত্য।
প্রতিবাদ সকলে করে না। কেউ কেউ করে। মহিউদ্দিন রনি তাদের একজন। তিনি কমলাপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকে রেলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন টানা কয়েকটি দিন। তার সেই আন্দোলনে সাড়া দিয়েছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর।
প্রতিবাদ সকলে করে না। কেউ কেউ করে। মহিউদ্দিন রনি তাদের একজন। তিনি কমলাপুর স্টেশনে দাঁড়িয়ে থেকে রেলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে গেছেন...
দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত প্রতিষ্ঠানকে জরিমানা করা হয়। বেশ ভালো। কিন্তু রেলের লোকেরা যে একসঙ্গে তালি বাজাতো দুর্নীতির তাদের কী হবে? শেকড় লতা পাতা ধরে টান দিলে হয়তো পুরো বৃক্ষ উজাড় হবে। কিন্তু আমরা যারা ভালোবাসি রেল। সহজ ও সুলভে পৌঁছতে চাই গন্তব্যে তাদের জন্য রেল সেবায় সংস্কার আনা দরকার।
আরও পড়ুন : ট্রেনের জানালায় পাথর ছোড়ে কেন?
উদ্যোগ দেখেছি। কিন্তু শ্লোগান ও চোখ রাঙানিতে থেমেও গেছে। কখনো থেমেছে রুটির সহভাগে। কিন্তু রেল যারা পরিচালনা করেন বা তাদের যারা পরিচালক সকলের নিশ্চয় জানা, এক সময় এই রেল ছিল গৌরবের। রেল বগি, ইঞ্জিন কারখানা ছিল আধুনিক।
রেলের লোকজনও সুখে ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির কর্কট রোগ, ষড়যন্ত্র রেলকে শেষকৃত্যের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল প্রায়। চলতি সরকার রেলে সুদিন ফিরিয়ে এনেছে বিশ্বাস করি। সেই রেলে যেন কেউ ষড়যন্ত্রের পাথর না ছোঁড়ে, সাবধান থাকা জরুরি।
যোগাযোগ খাতে মহাসড়কে গতি বেড়েছে। ফেরি যাচ্ছে উঠে। রাজধানী থেকে সকল গন্তব্যই নিকটতর হচ্ছে। ফলে গণপরিবহন এখন প্রতিযোগিতার মুখে।
যাত্রীরা বাস, ট্রেন, লঞ্চ বা ভাড়া গাড়ি নিয়ে টস করছেন সামর্থ্য অনুসারে। এই বাস্তবতায় দীর্ঘ যাত্রায় রেলকে যাত্রী পেতে আদর সোহাগ বাড়াতে হবে। টিকিটের সহজলভ্যতা আদরের প্রথম ধাপ। এটি আগে নিশ্চিত হোক।
তুষার আবদুল্লাহ ।। গণমাধ্যমকর্মী