বাংলাদেশ কি শ্রীলঙ্কার পথে?
বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায় পার্লামেন্ট সদস্যদের ভোটে নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রনিল বিক্রমাসিংহে। এর মধ্য দিয়ে আপাতত রাজনৈতিক সঙ্কটের একটা সুরাহা হবে বলে আশা করা হচ্ছে। কিন্তু দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা কবে একটা নিশানা পাবে সেটা অনিশ্চিত।
সর্বগ্রাসী দুর্নীতি আর ধারাবাহিক অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনায় দেশকে তিলে তিলে ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে এসেছে যেখান থেকে একে বের করে আনার কোনো পথ পাচ্ছে না আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-ও।
শতভাগ শিক্ষিত মানুষের এই দেশের অর্থনীতি এমন অবস্থায় কেন গেল তা নিয়ে নানা অভিমত ইতিমধ্যেই জানা গেছে। পর্যটন নির্ভর শ্রীলঙ্কান সরকারের রাজস্ব আয়ের খাত পর্যটনে ধস নেমেছে করোনার দুই বছরে।
আরও পড়ুন : শ্রীলঙ্কা : কেন এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো?
পর্যটকদের ভ্রমণ বন্ধ থাকায় কার্যত এই খাত থেকে দেশের আয় হয়নি। কিন্তু পর্যটক আকৃষ্ট করতে নানা প্রকল্পে নেওয়া বিপুল পরিমাণ বিদেশি ঋণের কিস্তি ঠিকই পরিশোধ করতে হয়েছে।
শিল্প উৎপাদনে ধস নেমেছে, রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সও পৌঁছেছে তলানিতে। পাশাপাশি কর ও ভ্যাট কমানো, কৃষিতে রাসায়নিকের ব্যবহার শূন্যতে নামিয়ে আনার কারণে উৎপাদনের ঘাটতি, সব মিলিয়ে কিছু ভুল পরিকল্পনা আর মহামারিতে এই দশা হয়েছে দেশের।
এগুলো আমাদের জানা। তবে সরকারের দিক থেকে হঠাৎ করে বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলায় পরিকল্পিত লোডশেডিংসহ বেশকিছু কৃচ্ছ্রতাসাধনের ঘোষণা আসায় মানুষ নতুন করে শ্রীলঙ্কার সাথে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে তুলনা করার সুযোগ খুঁজছে।
সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে এক প্রকার আর্থিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সেটা খালি চোখেই বোঝা যায়। পরিসংখ্যানও সেই কথাই বলে।
আইএমএফ প্রধান ক্রিস্টালিনা জর্জিভা ১৬ জুলাই ২০২২ তারিখে বলেছেন, যেসব দেশের ঋণের মাত্রা উচ্চ এবং নীতিমালার পরিসর সীমিত, তারা অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়বে। তাদের জন্য শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি একটি সতর্ক সংকেত। আইএমএফ প্রধান বলেছেন, অন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও চার মাস ধরে টেকসই মূলধনের বহিঃপ্রবাহ দেখা যাচ্ছে।
আরও পড়ুন : শ্রীলঙ্কা সমাচার : সংকট যতটা অর্থনৈতিক, ততটাই সামাজিক ও রাজনৈতিক
আইএমএফ প্রধানের বক্তব্যের সূত্র ধরে বিবিসির এক প্রতিবেদনে ঝুঁকিতে থাকা তেমন কয়েকটি দেশের তথ্য তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশও আছে। যেসব উন্নয়নশীল দেশে ঋণদাতা হিসেবে চীনের আধিপত্য রয়েছে সেসব দেশেই সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
লাওস, পাকিস্তান ও মালদ্বীপের পাশে বাংলাদেশের নাম নিয়েছে বিবিসি। বলছে, ২০২২ সালের মে মাসে বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতির হার ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে পৌঁছেছে, যা ৮ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ায় জরুরি নয় এমন পণ্য আমদানি বন্ধ করতে দ্রুত ব্যবস্থা নিয়েছে সরকার।
প্রবাসীদের কাছ থেকে রেমিট্যান্স পেতে বিভিন্ন বিধান শিথিল করা হয়েছে। কর্মকর্তাদের বিদেশে ভ্রমণও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের বিশ্লেষক কিম এং তান বিবিসিকে বলেন, আমদানি ব্যয় ও রপ্তানি আয়ের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক ঘাটতিতে থাকা বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা সরকারকে ভর্তুকি বাড়াতে ব্যাপক প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়তে হবে। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক সহায়তার জন্য ইতিমধ্যে আইএমএফ ও অন্য দেশের সরকারের দ্বারস্থ হয়েছে।
আরও পড়ুন : শ্রীলঙ্কার নিরুদ্দেশ যাত্রা
এগুলো সবই বিশ্লেষণ। হতেও পারে, নাও পারে। তবে নিশ্চয়ই সতর্কতার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যে এক প্রকার আর্থিক কষ্টের ভেতর দিয়ে যাচ্ছে সেটা খালি চোখেই বোঝা যায়। পরিসংখ্যানও সেই কথাই বলে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস)-এর হিসাবে সার্বিক মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ। এটি আসলে ধনী-গরিব নির্বিশেষে গড় হিসাব। গরিব মানুষের ওপর মূল্যস্ফীতির চাপ বেশি থাকে। সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এ বি এম মির্জা আজিজুল ইসলামের মতে, গরিব মানুষের ওপর প্রকৃত মূল্যস্ফীতির চাপ ১০ শতাংশের মতো।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি টালমাটাল। বর্তমান মূল্যস্ফীতির অন্যতম প্রধান কারণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়া। এই মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা নির্ভর করবে আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি কোথায় যায় তার ওপর।
কেননা, বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর দেশ। তাই আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি খারাপের দিকে যেতে থাকলে আমাদের গন্তব্যও সেদিকে। ২০২১–২২ অর্থবছরে আমদানি ব্যয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৭৮৭ কোটি ডলার।
আরও পড়ুন : শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট : বাংলাদেশ কি সেই পথে?
আগের অর্থবছরে পণ্য আমদানি ব্যয় ছিল ৬ হাজার ৫৫৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে পণ্য আমদানিতে ব্যয় ৩৩ শতাংশ বা ২ হাজার ২৩২ কোটি ডলার বাড়তি ব্যয় হয়েছে।
আমদানি ব্যয় বাড়লেও পরিমাণের দিক থেকে সার্বিকভাবে আমদানি কমেছে। তবে আশার কথা এই যে, বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের দাম কমতে শুরু করেছে।
দাম কমার এই তালিকায় আছে সয়াবিন তেল, পাম তেল, সয়াবিন বীজ, গমের মতো ভোগ্যপণ্য। আবার শিল্পের কাঁচামাল তুলা, পুরোনো লোহার টুকরো ও সারের দাম কমেছে। দাম কমার এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমদানি ব্যয়ও কমবে।
মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, সেটা মাত্র ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছিল। এর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর একটা প্রভাব আমাদের প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তায় পড়ছে।
সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে সাবধানতার বিকল্প নেই। সরকার সেই পথেই হাঁটছে। মহামারির মধ্যে বাংলাদেশে বিনিয়োগ কমে গিয়েছিল, সেটা মাত্র ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করেছিল। এর মধ্যেই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। এর একটা প্রভাব আমাদের প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক নিরাপত্তায় পড়ছে।
ডলারের মূল্য বাড়ায় রিজার্ভ সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ যা আছে তা দিয়ে ৬ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন : অতিমারির ধাক্কাই কাটল না, এর ওপর ইউক্রেন যুদ্ধ, কী হবে আমাদের?
ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, রিজার্ভ কমে আসা, মূল্যস্ফীতি, আমদানি ও বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যের ঘাটতি বেড়ে যাওয়া ছাড়া অর্থনীতির অন্য সূচকগুলোর অবস্থা ইতিবাচক বলে মনে করছেন অর্থনীতির বিশ্লেষকেরা।
তাই সার্বিকভাবে অর্থনীতির ওপর কিছুটা চাপ থাকলেও এখনো চিন্তিত হওয়ার মতো কিছু দেখছেন না অনেকে। তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং এর অভিঘাত থেকে প্রান্তিক মানুষকে রক্ষার জন্য খাদ্য ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বাড়ানো যেতে পারে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, গ্লোবাল টেলিভিশন