লোডশেডিং : সাশ্রয়েই সমাধান?
টুকটাক হচ্ছিল কদিন ধরেই। কিন্তু বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে আবার লোডশেডিং যুগে ফিরল ১২ জুলাই ২০২২, মঙ্গলবার থেকে। তবে একটা সময় সরকারের নীতিনির্ধারকদের কথা শুনে মনে হচ্ছিল, বাংলাদেশে এখন উপচেপড়া বিদ্যুৎ, লোডশেডিং বুঝি জাদুঘরে চলে গেছে।
২৫ হাজার মেগাওয়াট উৎপাদন সক্ষমতা, আর শতভাগ বিদ্যুতের গল্প আমাদের এতটাই মোহাবিষ্ট করে ফেলেছিল, আমরা ভেবেছি আলোর পথে যাত্রায় আর কখনো পেছনে তাকাতে হবে না। হারিকেন, কুপি আর হ্যাজাক লাইট তো হারিয়ে গেছে আমাদের শৈশবেই। হারিয়ে যেতে বসেছিল আইপিএস, জেনারেটরের গল্পও।
তবে বৈশ্বিক বাস্তবতায় বাংলাদেশকে আবার লোডশেডিং-এর যুগে ফিরতে হয়েছে, আলোর পথে অগ্রযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। তবে এমনটা ভাবারও কোনো কারণ নেই, যে বাংলাদেশ অন্ধকার যুগে ফিরে গেছে। এখন আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া রুটিনে দিনে এক ঘণ্টা লোডশেডিং হবে শুনেই আমরা মাতম তুলছি।
আরও পড়ুন : মেগা প্রকল্প, উচ্ছেদ ও কর্মসংস্থানের ভ্রান্ত প্রতিশ্রুতি
তবে একসময় দেশে দিনে ১০/১২ ঘণ্টা লোডশেডিং-এর যন্ত্রণাও সইতে হয়েছে। ২০০১-২০০৬ আমলের তুলনায় আগে ঘোষণা দিয়ে দিনে এক ঘণ্টার লোডশেডিং সহনীয়ই হওয়ার কথা। কিন্তু সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ পেতে পেতে আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। তাই এক ঘণ্টার লোডশেডিং-এর ঘোষণায়ও আমরা গেল গেল রব তুলছি।
অনেকেই বলছেন, সরকারের এত বিদ্যুৎ গেল কোথায়? বিদ্যুৎ কিন্তু কোথাও যায়নি। আমাদের জাতীয় উৎপাদন সক্ষমতা সত্যিই ২৫ হাজার মেগাওয়াট। তার মানে চাইলে বাংলাদেশ দিনে ২৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে পারবে। অত দরকার নেই।
একসময় দেশে দিনে ১০/১২ ঘণ্টা লোডশেডিং-এর যন্ত্রণাও সইতে হয়েছে। ২০০১-২০০৬ আমলের তুলনায় আগে ঘোষণা দিয়ে দিনে এক ঘণ্টার লোডশেডিং সহনীয়ই হওয়ার কথা।
বাংলাদেশে এখন বিদ্যুতের চাহিদা ১৪ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট থেকে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ উৎপাদন করা কোনো ব্যাপারই না। কিন্তু সার্বক্ষণিক বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হলে আমাদের থালায় টান পড়বে, রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। আপনার সামর্থ্য থাকলেই তো আপনি প্রতিদিন পোলাও খাবেন না।
বাংলাদেশের বর্তমান সার্বিক সমস্যা আমাদের নিজস্ব নয়, এটা রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অভিঘাত। এই অভিঘাত শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বেই লেগেছে। যার ফলে জ্বালানির দাম আকাশ ছুঁয়েছে। আর বাংলাদেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের অধিকাংশ জ্বালানিই আমদানি করতে হয়। তাই আপাতত সাশ্রয়ের কোনো বিকল্প নেই।
আরও পড়ুন : শুধু সংখ্যা নয়, উন্নয়নে এবার চাই মান
এটা ঠিক ২০০১-০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে দেশের মূল সংকট ছিল বিদ্যুৎ। তখনকার প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমান তখন বলেছিলেন, একই সঙ্গে বাসায় এবং মার্কেটে বিদ্যুৎ দেওয়া কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়। তখন খাম্বা থাকলেও বিদ্যুৎ ছিল না। কিন্তু বর্তমান সরকার সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে।
বাংলার ঘরে ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিয়েছে। বিদ্যুতের সহজলভ্যতায় উৎপাদন বেড়েছে, গতি এসেছে অর্থনীতিতে। তবে এটাও ঠিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে সরকার আগপিছ ভাবেনি। যেকোনো মূল্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে গিয়ে খরচের দিকে তাকায়নি। চড়া মূল্যে জ্বালানি কিনেই বিদ্যুৎ উৎপাদন করেছে সরকার।
আজ নিজের ফাঁদে নিজেই ধরা পড়েছে সরকার। তাই এখন এক ঘণ্টার লোডশেডিং-এ গেল গেল রব। বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে আমরা প্রতিবাদ করি, আন্দোলন করি। কিন্তু এত বাড়ানোর পরও কিন্তু বিদ্যুতের দাম উৎপাদন খরচের চেয়ে কম। তার মানে যত বিদ্যুৎ তত লস।
যখন সামর্থ্য ছিল, তখন আমরা ভবিষ্যৎ না ভেবে বিদ্যুৎ বিলাসিতার আলোয় গা ভাসিয়েছি। কিন্তু এখন যখন আমদানি ব্যয়ে টান পড়েছে, তখন আমাদের টনক নড়েছে। আসলে সার্বক্ষণিক সবার ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দিয়ে সরকার আসলে আমাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে। আর বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া হয়ে গেছে, এমন বিভ্রম তৈরি করে মানুষের প্রত্যাশাকে আকাশে তুলে দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন : অতিমারির ধাক্কাই কাটল না, এর ওপর ইউক্রেন যুদ্ধ, কী হবে আমাদের?
আমাদের অর্থনীতি অনেক এগিয়েছে। তার মানে তো আমরা সিঙ্গাপুর-মালয়েশিয়া হয়ে যাইনি। এখনো আমাদের মাথা ঢাকলে পা উদোম হয়ে যায়। তাই নিজেদের সামর্থ্য বিবেচনা করেই আমাদের সব পদক্ষেপ নিতে হবে। সামর্থ্য আছে বলেই বেশি খরচে উৎপাদিত বিদ্যুৎ কম দামে কিনে ইচ্ছেমতো খরচ করা উচিত নয়।
বিদ্যুৎ মানেই উৎপাদন, বিদ্যুৎ মানেই উন্নয়ন। তবে উন্নয়নের সুফল যেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি কিনতে ফুরিয়ে না যায়।
দেরিতে হলেও সরকার বিদ্যুৎ খাতের বাস্তবতা উপলব্ধি করতে পেরেছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে নানা পদক্ষেপ ঘোষণা করেছে। রুটিন করে এক ঘণ্টার লোডশেডিং তো আছেই; রাত ৮টার মধ্যে শপিং মল বন্ধ করা, আলোকসজ্জা না করা, এসির ব্যবহারে সতর্ক হওয়া, বেশিরভাগ মিটিং ভার্চুয়ালি করাসহ নানা চেষ্টা আছে সরকারের।
এমনকি অফিসের সময় কমিয়ে আনার কথাও ভাবা হচ্ছে। তবে সরকারের এই সিদ্ধান্ত ঘোষণার দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দেখলে যে কারো মনে হতে পারে, সরকার বুঝি মসজিদে এসি ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে। ফেসবুকবাসী পারলে বাংলাদেশে ইসলামী বিপ্লব ঘটিয়ে ফেলে।
আরও পড়ুন : পরিবেশ সুরক্ষায় আমাদের ভূমিকা কী?
সরকার আসলে অন্য সব ক্ষেত্রের মতো উপাসনালয়েও বিদ্যুৎ সাশ্রয়ের অনুরোধ করেছে। এই অনুরোধ শুধু মসজিদের ক্ষেত্রে নয়, সকল উপাসনালয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। সরকার বলেছে, নামাজ, পূজা বা প্রার্থনা শেষে যেন মসজিদ, মন্দির, গির্জার এসি, লাইট, ফ্যান বন্ধ করা হয়।
বাংলাদেশের মসজিদসহ কোনো উপাসনালয়ের বিদ্যুৎ বিল কোনো ব্যক্তির পকেট থেকে দিতে হয় না। তাই প্রায় সারাক্ষণই এখানে এসি, লাইট ফ্যান চলে। এটা নিয়ন্ত্রণ করতে বলা হয়েছে, মোটেই নামাজের সময় এসি বন্ধ রাখার কথা বলা হয়নি।
দেরিতে হলেও সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সাশ্রয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত আরও আগেই নেওয়া উচিত ছিল। যতটুকু জরুরি চাহিদা ততটুকু বিদ্যুৎ যেন দেশের মানুষ পায়, শিল্পোদ্যোক্তারা পায় সেটা নিশ্চিত করতে। কিন্তু চড়া দামে কেনা জ্বালানিতে উৎপাদিত বিদ্যুতে কেউ ২৪ ঘণ্টা এসি চালিয়ে রাখবেন, আর গ্রামের লোক একটা ফ্যান চালানোর জন্য বিদ্যুৎ পাবেন না, এটা যেন না হয়।
প্রায় সবক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রকট বৈষম্য আছে, অন্তত বিদ্যুতের আলো যেন সবার ঘরে সমানভাবে পৌঁছায়। বিদ্যুতের উৎপাদনকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সরকার সঠিক কাজটি করেছে। কারণ বিদ্যুৎ মানেই উৎপাদন, বিদ্যুৎ মানেই উন্নয়ন। তবে উন্নয়নের সুফল যেন বিদ্যুৎ উৎপাদনের জ্বালানি কিনতে ফুরিয়ে না যায়।
আরও পড়ুন : জলবায়ু পরিবর্তন : ঝুঁকি মোকাবিলায় আমরা কি সক্ষম?
সময় এসেছে, বিদ্যুৎ খাত নিয়ে যৌক্তিক ভাবনার, সমন্বিত পরিকল্পনার। এই খাতের অপচয়, সিস্টেম লস, দুর্নীতি বন্ধ করতে হবে; খরচ কমাতে হবে, সাশ্রয়ী জ্বালানির সন্ধান করতে হবে, রিনিউবেল এনার্জিতে মনোযোগ দিতে হবে।
আর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা যাই থাকুক, সাশ্রয়ের চলমান উদ্যোগ সবসময়ের জন্য বহাল রাখতে হবে। অপ্রয়োজনে এসি-লাইট-ফ্যান চালাব না, আলোকসজ্জা করব না, গভীর রাত পর্যন্ত শপিং মল খোলা রাখব না, বিয়ে বা অন্য অনুষ্ঠান তাড়াতাড়ি শেষ করব। এটা শুধু এখন জরুরি পরিস্থিতি বলেই নয়, সবসময় অভ্যাস করতে হবে।
অপচয়কারীকে কেউই পছন্দ করেন না। বিশ্ব পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে শুধু বিদ্যুৎ নয়, সবক্ষেত্রেই আমাদের সাশ্রয়ী হতে হবে।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
[email protected]