সম্প্রীতি ফিরে আসার প্রত্যাশায়
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অজুহাতে মৌলবাদীদের দেওয়া আগুনে পুড়ে যায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসতবাড়ি। সাথে পুড়ে যায় তাদের বিশ্বাস।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে পোস্ট দেওয়ার অভিযোগে এই হামলা চালানো হয়। ১৮ বছর বয়সী কলেজ শিক্ষার্থী আকাশ সাহা নামক এক আইডিকে কেন্দ্র করে ঘটনার সূত্রপাত। আকাশ সাহা নামক ফেসবুক আইডি তার পোস্টে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে বলে অভিযোগ করা হয়।
তবে স্থানীয়দের মাধ্যমে জানা যায়, আকাশ সাহা নামক আইডিটি সদ্য নতুন একটি আইডি। ঘটনার ২৪ ঘণ্টা আগে আইডিটি ওপেন করা হয়। আইডিটি কার তা নিশ্চিত না হয়েই আকাশের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হয় এবং মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আকাশ সাহাকে ১৭ জুলাই ২০২২ গ্রেফতার করা হয়।
আরও পড়ুন : সম্প্রীতি কোথায়?
ঘটনার দিন শুক্রবারেই একদিকে মৌলবাদীদের আক্রমণ অন্যদিকে আকাশের বাবা নিরপরাধ অশোক সাহাকে আটক করে পুলিশ। অদ্ভুত দেশের পুলিশ প্রশাসন, আকাশ সাহার তথাকথিত অপরাধে পিতা অশোক সাহা গ্রেফতার করে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ইস্যুতে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পুলিশ প্রশাসনের এমন উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপাতে দেখা যায়। হয়তো অধিকতর তদন্তে দ্রুতই প্রকৃত ঘটনা বেড়িয়ে আসবে। তবে সাধারণ বিবেচনাতেই বোঝা যায়, বিষয়টি ষড়যন্ত্রমূলক। কারণ কেউ সদ্য আইডি খুলে ২৪ ঘণ্টা যেতে না যেতেই অপ্রাসঙ্গিকভাবে অন্য ধর্ম সম্পর্কে কটূক্তি করবে না।
আর একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোনো নাগরিক তো কখনোই করবে না। সে চারিদিকে প্রতিনিয়ত দেখছে ধর্মীয় অনুভূতি নামক করাতের বিষাক্ত দংশন। যে দংশনে কত মানুষের জীবন, কত মানুষের পরিবার ছারখার হয়ে যাচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় জানা যায়, দফায় দফায় আক্রমণ এবং লুট করা হয়। একদল লুট করে চলে যাওয়ার পর আরেকদল লুট করতে আসে। সর্বশেষ দল কিছু না পেয়ে দিপালী সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
১৫ জুলাই ২০২২। শুক্রবার। দুঃসহ স্মৃতি কিছুতেই ভুলতে পারছেন না, গৃহহারা দিপালী রাণী সাহা। অবশ্য এমন দুর্বিষহ বিষয় কোনোদিন ভোলারও নয়। সারা জীবন তাদের তাড়া করে ফিরবে এই ঘটনা। সেদিন দিপালী রাণী সাহা তার দু'চোখের সামনেই দাউদাউ করে পুড়ে যেতে দেখেছেন তার বসতবাড়ি।
ভুক্তভোগীদের বর্ণনায় জানা যায়, দফায় দফায় আক্রমণ এবং লুট করা হয়। একদল লুট করে চলে যাওয়ার পর আরেকদল লুট করতে আসে। সর্বশেষ দল কিছু না পেয়ে দিপালী সাহার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
আরও পড়ুন : সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস কীভাবে ছড়ায়?
হামলার সময় জীবন বাঁচাতে বড় ছেলে গোবিন্দ সাহাকে নিয়ে খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন ৬২ বছর বয়সী দিপালী রাণী সাহা। তারা যে ঘরটিতে লুকিয়ে ছিলেন, সেই ঘরের দরজা ভাঙতে না পেরে হামলাকারীরা পাশের বাড়ির মন্দিরে হামলা করে মন্দিরের প্রতিমা বিধ্বস্ত করে।
সেই বিভীষিকাময় রাতে দিঘালিয়া ইউনিয়নের সাহা পাড়া গ্রামের দিপালী সাহার বাড়িসহ আরও কয়েকটি বাড়ি ও কয়েকটি দোকানে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে সাহা পাড়া মন্দিরের চেয়ার ও সাউন্ড বক্স ভাঙচুর করা হয়।
নড়াইলে মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগেই মির্জাপুর ইউনাইটেড ডিগ্রি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্র রাহুল দেব রায়ের একটি পোস্টকে কেন্দ্র করে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাসের গলায় জুতার মালা পরানো হয়। যে ঘটনায় সারাদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে।
আক্রমণকারী দুর্বৃত্তদের দেওয়া আগুনে ভস্মীভূত হয়ে যাওয়া ঘরের সামনে বসে বুক চাপড়ে দিপালী রাণী সাহার করুণ আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ার আকাশ-বাতাস। তিনি বলেন, ‘এমনকি নাতনির খেলার পুতুলগুলোও হিংসার হাত থেকে বাঁচেনি। ওই ছাত্র হিন্দু। আমিও হিন্দু। শুধুমাত্র এই কারণে আমার বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।’
আরও পড়ুন : ধর্মের রাজনীতি নাকি রাজনীতির ধর্ম
কোলে তার আটমাস বয়সী অবুঝ নাতনি রাই সাহা, যে এখনো ভালো করে কথাও বলতে শেখেনি। তিনি যখন ঘর পুড়ে যাওয়ার বেদনায় আহাজারি করছেন, তখন কোলে তার অবুঝ নাতনি রাই সাহা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ঠাকুমার দিকে। চোখে মুখে শিশুটির কান্নার ভাব। ছোট্ট শিশুর খেলার পুতুলকে রক্ষা করতে পারেনি পরিবার।
এই সহিংসতা কত দিন আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে আমি জানি না। কার কাছে বিচার চাইব? কে জীবনের নিরাপত্তা দেবে?
শিশুটির অবাক ফ্যালফ্যালে সকরুণ চাহনি যেন অনেক কথা বলছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনাগত ভবিষ্যতের কথা বলছে! দিপালী রাণী সাহা এই দুর্বিষহ বীভৎস স্মৃতি হয়তো সারা জীবনেও ভুলতে পারবেন না।
তিনি বলেন, ‘এই সহিংসতা কত দিন আমাদের তাড়িয়ে বেড়াবে আমি জানি না। কার কাছে বিচার চাইব? কে জীবনের নিরাপত্তা দেবে? হামলার সময় আমাকে যদি সামনে পেত তাহলে নিশ্চিত মৃত্যু ছিল আমার। ভগবান আমাকে বাঁচিয়েছেন। কিন্তু, এভাবে কি বেঁচে থাকা যায়? আমার পরনের এই শাড়িটা ছাড়া এখন আর কিছুই নেই’(দ্য ডেইলি স্টার, ১৭ জুলাই ২০২২)।
১৫ জুলাই রাতে ভয়াবহ হামলার পর ১৬ জুলাই সকাল থেকে প্রশাসনের কর্মকর্তা অনেকেই দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় এসে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে বিভিন্ন প্রকারের আশ্বাসবাণী শুনিয়েছেন। যা প্রত্যেকটি সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসী হামলার পরেই প্রশাসনের পক্ষে শোনানো হয়। এরপরেও আশ্বস্ত হতে পারেননি সাহা পাড়ার অন্যান্য ভুক্তভোগীদের মতো দিপালী সাহা।
আরও পড়ুন : বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা ও অসাম্প্রদায়িকতার দ্বৈরথ
হামলার রাতে বাড়িতে ছিলেন না দীপালী সাহার পুত্রবধূ চন্দ্রা সাহা। ১৬ জুলাই সকালে সে ফিরে এসে তাদের বাড়িটিকে একরাতেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে দেখে নিজ বসতবাড়িকেই চিনতে পারেননি। শোকে বিমর্ষ হয়ে চন্দ্রা সাহা বলতে থাকেন, ‘আমি এখানে আমার সন্তানদের নিয়ে থাকতে চাই না। আমি হামলার শিকার হতে চাই না।’
এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ সদস্য মোতায়েন করা হলেও হামলার পর থেকে এলাকা প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। দিঘলিয়া গ্রামে প্রায় ৩০০ পরিবারের বাস। তার মধ্যে ১০৮ হিন্দু পরিবার সাহা পাড়ায় থাকেন। হামলার মৌলবাদীদের প্রতিরোধ না করে, প্রাণের মায়ায় জীবন বাঁচাতে অধিকাংশ পরিবারের সদস্যরা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
অধিকাংশ বাড়ির দরজা তালাবদ্ধ। বিষয়টি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি কমন চিত্র। কিছু পরিবারের বয়স্ক ব্যক্তিরাই শুধু বাড়িতে আছেন, তারাও ভীতি-সন্ত্রস্ত। ৬৫ বছর বয়সী স্থানীয় রাধাগোবিন্দ মন্দিরের সভাপতি শিবনাথ সাহা বলেন, ‘গ্রামে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। কিন্তু, আমরা তাদের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না। বিকেলে অশোককে আটক করার পর থানার ওসি ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদের নিরাপত্তার জন্য অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েনের কথা বলেছিলেন। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ এসে সাহা পাড়ায় হামলা চালায়। হিন্দুদের বেছে বেছে মারধর করে।’
পুলিশের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করেন স্থানীয় দিঘলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত আসনের সাবেক মহিলা সদস্য বিউটি রানী। তিনি বলেন, ‘যখন গ্রামে একের পর হিন্দু পুরুষদের মারধর করা হচ্ছিল, তখন পুলিশ ছিল। তারা দূরে থেকে দেখছিল। কাউকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেনি। পুলিশের ওপর আর আস্থা রাখা যায় না। গ্রামের মানুষ তাই এলাকা ছেড়েছে।’
দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা চাইলে হয় না এমন কোনো বিষয় তো আজ পর্যন্ত দেখলাম না। তবে দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা হিন্দু নির্যাতন বন্ধ হয় না কেন?
দিঘলিয়া বাজারের সার ব্যবসায়ী গোপাল সাহা তার ওপর হামলার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘আমি ২২ বছর ধরে এই বাজারে ব্যবসা করছি। আমাকে মারধরের একমাত্র কারণ ছিল আমি হিন্দু। ওই ছেলেটির বাড়ি আমার বাড়ি থেকে অনেক দূরে। এ কেমন দোষ আমার? একজন হিন্দু হিসেবে আমি এই গ্রামে আর নিরাপদ বোধ করি না।’
আরও পড়ুন : এই দুঃখ কোথায় রাখি?
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে অনুভূতিতে আঘাত নামক ইস্যুতে রাষ্ট্র সবসময় নীরব থাকে। সঠিকভাবে বিচার বিশ্লেষণ করে না। ফলে মৌলবাদীরা প্রশ্রয় পেয়ে যাচ্ছে। তাই এই খেলা তারা প্রতিনিয়ত খেলছে। অথচ এই দুর্বিষহ বিষাক্ত খেলার অভিঘাতে কত-শত সংখ্যালঘু প্রতিনিয়ত নির্যাতিত লাঞ্ছিত হয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে, দেশান্তরিত হচ্ছে এর সঠিক পরিসংখ্যান কয়জনই বা রাখে?
পদ্মা সেতুর নাটবল্টু খোলায় প্রশাসনের পদক্ষেপ এবং প্রতিক্রিয়ায় দ্বিতীয়বার কেই পদ্মাসেতুর নাটবল্টু খোলা তো দূরে থাক, নাটবল্টুর দিকে তাকাতেও বা স্পর্শ করতেও ভয় পায়। কারণ সাধারণ মানুষ বুঝে গেছে, পদ্মাসেতুর নাটবল্টু খোলা তো দূরের কথা শুধু স্পর্শ করলেই কপালে রিমান্ড প্রায় নিশ্চিত।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বাড়িঘর, মন্দিরসহ তাদের ওপর সংঘবদ্ধভাবে আক্রমণ করলে, সেই আক্রমণে যদি পুলিশের কাছে ধরা পড়ে তবে জামিনও পাবে এবং মামা চাচা ধরে যেকোনো ছুতোয় মামলার হাত থেকেও রক্ষা পাবে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, রাষ্ট্রের কাছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিশেষ করে হিন্দুদের জীবন বসতবাড়ির থেকে পদ্মাসেতুর নাট-বল্টু অনেক দামি।
স্বাধীনতা পরবর্তী বিচ্ছিন্ন বা ধারাবাহিক বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক আক্রমণ হয়েছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে। কিন্তু ২০১০ সাল থেকে শুরু হয়েছে এক নতুন স্টাইলে সংখ্যালঘু নির্যাতন। স্টাইল হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের মিথ্যা স্ক্রিপ্ট তৈরি করা।
আরও পড়ুন : রাজনৈতিক সম্প্রীতির দেশ!
বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকার যদি প্রথম থেকেই পদ্মাসেতুর নাটবল্টু রক্ষার মতো অনুভূতিতে আঘাত নামক সংখ্যালঘু নির্যাতনকারী অনুভূতি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ করত, তবে হয়তো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ২০২১ সালের শারদীয় দুর্গোৎসবে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসসহ ২০২২ সালে জুলাইয়ে এসে নড়াইলের লোহাগড়ার দিঘলিয়া গ্রামের সাহা পাড়ায় দিপালী রাণী সাহার বসতবাড়ি এমন ভয়ংকরভাবে ভস্মীভূত হতে হতো না। ঘরের সাথে সাথে দিপালী রাণী সাহার প্রতিবেশীদের প্রতি বিশ্বাস, সমাজের প্রতি বিশ্বাস এবং প্রশাসনের প্রতি তার বিশ্বাস পুড়ে যেত না।
নাতনি রাই সাহার খেলার পুতুলগুলোও হিংসার আগুনে পুড়ে গেছে। আট মাসের ছোট শিশু রাইয়ের কাছে খেলার পুতুলগুলো তার শিশু মনোজগতে অনেক কিছু, অনেক মূল্যবান। অথচ এই ছোট্ট অবুঝ শিশুটি থেকেও তার খেলার পুতুলটি কেড়ে নিয়েছে ঘুণে ধরা মৌলবাদী কিটে দংশন করা ক্ষত-বিক্ষত সমাজ।
এই দায়, ব্যর্থতা আমাদের সকলের। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা চাইলে হয় না এমন কোনো বিষয় তো আজ পর্যন্ত দেখলাম না। তবে দেশে প্রতিনিয়ত ঘটে চলা হিন্দু নির্যাতন বন্ধ হয় না কেন? তবে কি শর্ষের মধ্যেই ভূত লুকিয়ে?
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী ।। সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়