মৃত্যুঞ্জয়ী শেখ হাসিনা
আজকে যারা দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী শেখ হাসিনাকে দেখছেন; তাদের কারো কাছে তিনি গণতন্ত্রের মানস কন্যা, কারো কাছে ফ্যাসিস্ট; কারো কাছে মানবিকতার জননী, কারো কাছে নিষ্ঠুর; কারো দৃষ্টিতে তিনি উন্নয়নের রূপকার, আবার কেউ মনে করেন তার প্রশ্রয়েই দুর্নীতি বিস্তার লাভ করেছে; শেখ হাসিনা কারো দিকে শুভ দৃষ্টি দিলে খুলে যায় তার সম্ভাবনার দ্বার, আবার শেখ হাসিনা ক্ষুব্ধ হলে কারো ধ্বংস হতেও সময় লাগে না।
শেখ হাসিনা যেন অসীম ক্ষমতার অধিকারী একজন রাজনীতিবিদ, যিনি বাংলাদেশ এবং নিজেকে তুলে নিয়েছেন আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে। শেখ হাসিনা যেদিকে তাকান, সব সহজ হয়ে যায়। কতটা অবলীলায় বাংলাদেশের মতো একটি দেশকে সমৃদ্ধি আর সক্ষমতার সীমা ছাড়িয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তা অবিশ্বাস্য। শেখ হাসিনাকে পছন্দ করুন, আর অপছন্দ; বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ২০ বছর আগে আপনারা কেউ ভেবেছিলেন, বাংলাদেশ আজ সমৃদ্ধির এই স্তরে পৌঁছাতে পারবে?
বঙ্গবন্ধু ৭১-এর ৭ মার্চ বলেছিলেন, ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ বঙ্গবন্ধুর সে অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করছেন তার কন্যা। অনেকে বলবেন, উন্নয়নই শেষ কথা নয়। গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ধ্বংস করে উন্নয়নের কোনো মানেই হয় না। আমি আপনাদের সাথে শতভাগ একমত।
আরও পড়ুন : রাজনীতি কি মরণ খেলা?
আমি উন্নয়ন চাই; তবে তার আগে চাই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, কথা বলার স্বাধীনতা। উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কোনোভাবেই অন্য কোনো অধিকার রুদ্ধ করা যাবে না। তবুও এটা মানতেই হবে শেখ হাসিনার সাহস আর দূরদর্শিতা ছাড়া বাংলাদেশ আজকের অবস্থানে পৌঁছতে পারতো না। একবার যেহেতু পৌঁছে গেছেই, কেউ নিশ্চয়ই নামাতে পারবে না।
শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের সভানেত্রী। কিন্তু গত একযুগ ধরে বাংলাদেশের রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ এককভাবে তার হাতে। ১৪ দল, মহাজোট তো বটেই, মাঝে মাঝে মনে হয় বিএনপিকেও শেখ হাসিনাই চালান। শেখ হাসিনা পরিশ্রমী, সাহসী, দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক এবং ভাগ্যের বরকন্যাও। ভাগ্যের বরকন্যা কেন বলছি, তার ব্যাখ্যা পরে দেবো।
আজকের শেখ হাসিনাকে যারা দেখছেন, তারা তার লড়াইটা কল্পনাও করতে পারবেন না। বাবা-মা, ভাই-ভাবি সবাইকে যখন হারিয়েছেন; তখন শেখ হাসিনার বয়স ছিল মাত্র ২৭ বছর। স্বামী, দুই সন্তান আর ছোট বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে উদ্বাস্তু জীবন।
আগের দিন যিনি রাষ্ট্রপতির কন্যা, পরদিনই ভয়ে তাকে কেউ আশ্রয় দিতে চান না। বাবা-মা মারা গেলে সন্তান হঠাৎ করেই বড় হয়ে যায়, দায়িত্ব বেড়ে যায়। শেখ হাসিনারও তেমন হয়েছিল। শোক করার সময় নেই। পরিবারের যেটুকু বেঁচে আছে, সেটুকু নিয়েই লড়াই করতে হবে।
আগের দিন যিনি রাষ্ট্রপতির কন্যা, পরদিনই ভয়ে তাকে কেউ আশ্রয় দিতে চান না। বাবা-মা মারা গেলে সন্তান হঠাৎ করেই বড় হয়ে যায়, দায়িত্ব বেড়ে যায়। শেখ হাসিনারও তেমন হয়েছিল।
ইন্দিরা গান্ধীর ভালোবাসায় থিতু হলেন দিল্লীতে। প্রায় লুকিয়ে থাকার মত অবস্থা। এই লড়াই পর্বের কিছুটা আঁচ পাবেন, তথ্যচিত্র ‘হাসিনা: অ্যা ডটার্স টেল’এ। এত বড় শোকের পাহাড় মাথার ওপরে। কিন্তু শেখ হাসিনার শোক করার সময় নেই। তিনি তো শুধু একজন নারী নন; তিনি জাতির জনকের কন্যা। তার দায়িত্ব শুধু পরিবার নয়, পিতা যে দেশ স্বাধীন করে দিয়ে গেছেন, সেই দেশের দায়িত্বও তো তার কাঁধেই।
১৯৮১ সালের ১৭ মে শেখ হাসিনা যখন দেশে ফেরেন; দেশ তখন সামরিক শাসনের কব্জায়, দেশে বিরুদ্ধ পরিবেশ, পিতার রেখে যাওয়া সংগঠনে অন্তর্দ্বন্দ্ব আর সরকারি দমন-পীড়নে স্তব্ধ প্রায়, দেশে ফিরে নিজের বাড়িতেও ঢুকতে পারেন না।
আরও পড়ুন : সহমতের রাজনীতি
বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একাত্তরের পরাজিত শক্তি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে, দেশকে ফিরিয়ে নিতে চাইছে পাকিস্তানী ধারায়। তার আসল লড়াই দেশকে সঠিক ধারায় ফিরিয়ে আনা। পরপর দুটি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে লড়তে হয়েছে তাকে। তারচেয়ে বড় কথা হলো, পঁচাত্তরের ঘাতকরা তাদের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য মরিয়া।
শেখ হাসিনা যেখানেই যান, বুলেট যেন তাড়া করে ফেরে। শেখ হাসিনা যে আজও বেঁচে আছেন, এটা যেমন সৌভাগ্য, তেমনি বাংলাদেশেরও ভাগ্য। শেখ হাসিনা সেই বিরল রাজনীতিবিদদের একজন, যাকে বারবার হত্যার চেষ্টা হয়েছে। ফিদেল কাস্ত্রো ছাড়া আর কাউকে হত্যার জন্য এতোটা মরিয়া ছিল না প্রতিপক্ষ। নিজের বাসায়, জনসভায়, গাড়ি বহরে, ট্রেন যাত্রায়- বারবার তাকে হত্যার চেষ্টা হয়েছে। সংখ্যাটা অন্তত ২১।
জনসভা মঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে রেখেছিল জঙ্গিরা। একবার ভাবুন, সেই বোমা বিস্ফোরিত হলে আজকের বাংলাদেশ কোথায় থাকতো! সেই মামলার বিচার হাইকোর্ট পর্যন্ত নিষ্পত্তি হতে ২১ বছর লেগেছে!
এরমধ্যে একাধিকবার প্রাণে বেঁচে গেছেন স্রেফ নেতাকর্মীদের ভালোবাসায় আর ভাগ্যের জোরে। এরশাদ আমলে চট্টগ্রামে জনসভায় পুলিশের গুলি আর বিএনপি আমলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে গ্রেনেড হামলায় নেতাকর্মীরা মানববর্ম গড়ে নিজেরা জীবন দিয়ে তোকে বাঁচিয়েছেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১ হাইকোর্ট একটি হত্যা মামলায় ১০ জঙ্গির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখলেন।
শেখ হাসিনা যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন জনসভা মঞ্চের কাছে ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পেতে রেখেছিল জঙ্গিরা। একবার ভাবুন, সেই বোমা বিস্ফোরিত হলে আজকের বাংলাদেশ কোথায় থাকতো! সেই মামলার বিচার হাইকোর্ট পর্যন্ত নিষ্পত্তি হতে ২১ বছর লেগেছে! অন্য মামলাগুলোরই একই অবস্থা।
আরও পড়ুন : রাজনীতিই শেষ ভরসা
শেখ হাসিনা কিন্তু কোনো মামলাতেই হস্তক্ষেপ করেননি। সাধারণ গতিতেই চলতে দিয়েছেন। তিনি ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার শুরু করতে পেরেছিলেন। কিন্তু সেটি শেষ করতেও তার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় আসতে হয়েছিল। জাতির জনকের হত্যার বিচারও সাধারণ গতিতেই হয়েছিল।
শেখ হাসিনার অনেক কৃতিত্ব যেমন আছে, আছে অনেক সমালোচনাও। তবে আমি সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব মানি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। জাতিকে তিনি কলঙ্কমুক্ত করেছিলেন। আইনের শাসনের প্রতি যার এত শ্রদ্ধা, তার শাসনামলেই বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম-খুনের অভিযোগ আমি মেলাতে পারি না। অনুরাগীরা যাকে ‘গণতন্ত্রের মানসকন্যা’ বলেন, তার আমলেই দেশের সবচেয়ে খারাপ নির্বাচনের নজির আমাকে বেদনার্ত করে।
বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, যুদ্ধাপরাধী হত্যার বিচার, পদ্মা সেতু, গৃহহীনদের আশ্রয় দেয়া, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, সমৃদ্ধি, সক্ষমতা, বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে আসীন করায় শেখ হাসিনার প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতা অশেষ। তবে সেই উন্নয়ন টেকসই ও মানসম্পন্ন করতে চাই গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা আর দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র।
শেখ হাসিনা এবার নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের ধারায় মানসম্পন্ন উন্নয়নের পথে এগিয়ে নেবেন বাংলাদেশকে। শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে উন্নয়নের নতুন ধাপে তুলে নিয়েছেন। এখন দরকার আরেকটা লাফ, নতুন মাত্রায় উত্তরণ।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
[email protected]