আমাদের ঘুম ভাঙবে কবে?
অবশেষে জামিন হলো হৃদয় মণ্ডলের। জামিনে মুক্তি পেয়েছেন তিনি। এর জন্যে আদালতে তিনবার আবেদন করতে হলো তাকে। মুক্তির দাবি নিয়ে রাস্তায় নামতে হয়েছিল বরেণ্য শিক্ষক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের। ওদিকে এখনো থমথমে হয়ে আছে হৃদয় মণ্ডলের বাড়ি থেকে প্রায় শ’পাঁচেক কিলোমিটার দূরে নওগাঁর মহাদেবপুর। সহকারী প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনী পালের পরিবার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। নিজের বাড়িতে থাকলেও আছেন নিরাপত্তা ঘেরা পাহারায়।
পুলিশের বিশেষ নজরদারি আছে মহাদেবপুরের বারবাকপুর ও এর আশেপাশের এলাকায়। তারপরেও সেই পাহারা উপেক্ষা করে এখনো কেউ কেউ ফেসবুক লাইভে এসে বলার চেষ্টা করছেন আমোদিনী হিজাব পরার অপরাধে ছাত্রীদের পিটিয়েছেন। ঘটনা মিথ্যা। তারপরও কেন এই চেষ্টা?
এদিকে মুক্তি পেলেও হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে যারা ধর্ম বিরোধিতার অভিযোগ এনেছিলেন তারা ঘরে উঠে যাননি। এখন সাংবাদিক দেখলেই গালি দিচ্ছে। বলছে এদের কারণে সমাজটা উচ্ছন্নে যাচ্ছে।
খুব কাছাকাছি সময়ের দু'টি ঘটনা। একটি মুন্সিগঞ্জ সদরে অন্যটি নওগাঁর মহাদেবপুরের। আমার হিসাবে ঘটনা দু'টি একটি আরেকটির কপি। আমার দেশের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী খুব দ্রুত এরকম ঘটনা আরও কয়েকটি ঘটবে। আসলে ঘটে সবসময়। চোখে পড়ে না। কিন্তু যখন কোনো ঘটনা প্রচার পায়, সেই সময় এর কাছাকাছি কোনো খবর হলে সংবাদের পরিভাষায় সেটা ‘পেগ’ হয়ে যায়। তখন সবগুলো মিলিয়ে প্রচার হতে থাকে।
এই দু’টি খবরে অনেক মিল। প্রধান যে মিল সেটা হলো দু'টিতেই কোনো সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলতে ধর্মের ব্যবহার করা হয়েছে। যদিও মানুষকে বিপদে ফেলতে ধর্মের ব্যবহার আমাদের দেশে খুব জনপ্রিয়। কিন্তু এর আগে এতটা প্রকাশ্য ছিল না। রাখঢাক থাকতো। কিন্তু ১৫ বছর ধরে আমরা দেখছি ব্যক্তি স্বার্থে জয়ী হতে ধর্মের ব্যবহার হচ্ছে সবার সামনে। সেই বগুড়ার চাঁদ দেখা থেকে শুরু করে আজকের আমোদিনী পালের শিক্ষার্থী শাসন পর্যন্ত।
ব্যবহার বলাটা বোধহয় ঠিক হচ্ছে না। অপব্যবহার বলাই উচিত। কারণ প্রতিটি ক্ষেত্রেই বলা হচ্ছে, ধর্ম অবমাননার বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে কেউ বা কারা। কিন্তু দ্রুত বের হয়ে আসছে পেছনের গল্প। যেমন আমোদিনীর পালের প্রধান শিক্ষিকা হওয়া আটকাতে তাকে দেওয়া হলো হিজাব পরায় শাস্তি দেওয়ার অভিযোগ।
ধর্মের বাণী চেষ্টা করে মানুষের অন্তর চক্ষু খুলতে। অন্যকে রক্ষার বোধ জাগাতে। মানুষকে একত্র করতে। এটা কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীরা জানে। তাই সে নিজের স্বার্থে মানুষকে মানুষ হতে দেয় না।
হৃদয় মণ্ডলের বিরুদ্ধে ধর্মের বিপক্ষে বলার দায়। একই রকম অভিযোগ ছিল রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে আগুন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলে পাড়ার তাণ্ডব এবং ২০২১ সালের রংপুরের জেলে পল্লীতে আগুনের ক্ষেত্রেও।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই যে দিনের পর দিন ধর্মের আড়ালে অধর্ম হচ্ছে, বহু মানুষ সেটা বুঝতে পারছেন না। একসঙ্গে কাজ করছেন, খাচ্ছেন, সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নিচ্ছেন, তবু তাদের মাথার কোথাও লুকিয়ে থাকছে ভয়ঙ্কর এক দানব। অথচ ধর্ম এসেছিল সমাজে শৃঙ্খলা রক্ষা করতে। মানবতার কল্যাণে।
ধর্মের বাণী চেষ্টা করে মানুষের অন্তর চক্ষু খুলতে। অন্যকে রক্ষার বোধ জাগাতে। মানুষকে একত্র করতে। এটা কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীরা জানে। তাই সে নিজের স্বার্থে মানুষকে মানুষ হতে দেয় না। দরকার হলে টাকা ঢালে। তারপরেও বেশিরভাগ মানুষের ভেতরের দানবকে জাগিয়ে রাখে।
ধর্ম ব্যবসায়ী আরও জানে, কখন-কীভাবে সেই দানবকে খুঁচিয়ে জাগিয়ে দিতে হবে। ধর্ম ব্যবসায়ী তার কালো টাকা নিয়ে সবসময় প্রস্তুত থাকে। যে কারণে চোখের নিমেষে তার এজেন্ডা বাস্তবায়নে লোকজন জড়ো হয়ে যায়।
আমাদের প্রতিটি সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা বিশ্লেষণ করে দেখেন। আমার কথা ঠিক ঠিক মিলে যাবে। একটি কথা না বললেই নয় সেটা হচ্ছে, ধর্ম ব্যবসায়ীরা প্রকৃত কোনো ধর্মের অনুসারী নয়। এদের কাছে স্বার্থটাই আসল। যে ধর্মের পক্ষে গেলে স্বার্থ রক্ষা হবে এরা সেদিকেই হেলে পড়বে।
আজকের এই পরিস্থিতির জন্যে অনেকে সরকার এবং রাষ্ট্রকে দোষ দেয়। দোষ দেওয়া তো সহজ। কিন্তু যারা এলাকার সচেতন নাগরিক তারা কী এই দায় একেবারে এড়িয়ে যেতে পারেন? আজকাল গ্রামে গ্রামে স্কুল-কলেজ। একটু সামনে গেলেই বিশ্ববিদ্যালয়। এখনো কেন মানুষকে ধর্মের ঠুলি পরানো সম্ভব হবে?
কেন মুহূর্তেই একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞান শিক্ষক একা হয়ে যাবেন? তার স্কুলে আরোপিত বিক্ষোভের সময় কেন কেউ তার পক্ষে দাঁড়াবে না? বিস্মিত হতে হয়, প্রথম দিকে এলাকার কেউ সাংবাদিকদের সাথে কথাও বলতে চাননি। কেউ বলার সাহস দেখাতে পারেননি যে, হৃদয় মণ্ডল যেটা বলছেন সেটা অ্যাকাডেমিক তত্ত্ব। কাউকে অসম্মানিত করার লক্ষ্যে তিনি একথা বলেননি।
সবাই জানেন, আমোদিনী পালের সঙ্গে স্কুল কর্তৃপক্ষের বিরোধ। প্রধান শিক্ষক ধরণী কান্তের অবসরের পর আমোদিনী প্রধান শিক্ষিকা হয়ে যান এটা চাইছেন না। স্কুলের বর্তমান কর্তৃপক্ষ চায় না তাদের লম্বা দুর্নীতি ফাঁস হয়ে যাক। যে কারণে স্কুল ড্রেস হয়ে যায় হিজাব। এটা ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক ইস্যু হতে পারত। কেউ কেউ আমোদিনী পালের পক্ষে ছিলেন দেখে তা গড়ায়নি।
কেন মুহূর্তেই একজন জনপ্রিয় বিজ্ঞান শিক্ষক একা হয়ে যাবেন? তার স্কুলে আরোপিত বিক্ষোভের সময় কেন কেউ তার পক্ষে দাঁড়াবে না? বিস্মিত হতে হয়, প্রথম দিকে এলাকার কেউ সাংবাদিকদের সাথে কথাও বলতে চাননি। কেউ বলার সাহস দেখাতে পারেননি...
এত কথা বলতে বলতে আরেকটি বড় মিলের কথা ভুলেই গেলাম। সেটা হচ্ছে দু’টি ঘটনার উত্তাপই শুরুতে ছড়িয়েছিল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম তথা ফেসবুকে। সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলা হবে, অথচ ফেসবুক থাকবে না সেটা কী করে হবে? কারণ আমাদের ধর্ম ব্যবসায়ীরা তো যথেষ্ট প্রযুক্তি বান্ধব। আটঘাট না বেঁধে তারা নামে না। তারা ভালো করেই জানে আমাদের ফেসবুক কতটা উর্বর। বীজ ছড়ালেই হলো। বিশেষ করে সেটা যদি ঘৃণার বীজ হয়। তাহলে তো সেটা তরতরিয়ে বেড়ে গেল লতায় পাতায়।
তারা জানে, ফেসবুকে কীভাবে মানুষকে হেনস্থা করতে হয়। যারা করবে তারা আরও জানে আমার দেশে যারা এই মন্দ লোকদের তাৎক্ষণিকভাবে কিছু করা যায় না। নানা জটিলতা পেরিয়ে ফেসবুক যতক্ষণে ব্যবস্থা নেয়, ততক্ষণে ঘটনা প্রায় শেষ।
একই সঙ্গে শেষ হয় একজন হৃদয় মণ্ডল এবং একজন আমোদিনী পালের দীর্ঘ অর্জন। সামাজিকভাবে তারা যে অসম্মানিত হলেন, আদালতে বারবার নির্দোষ প্রমাণিত হলেও কি তাদের সেই ক্ষতি পূরণ হবে?
একই পরিস্থিতি আমরা দেখেছি, রামুর বৌদ্ধ মন্দিরে হামলা, দুর্গাপূজায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া হামলা, রংপুরের জেলে পল্লীতে হামলার ক্ষেত্রেও। আমার যতদূর মনে পড়ে, বাংলাদেশের কোনো সাম্প্রদায়িক বিশৃঙ্খলার ন্যূনতম দায় ফেসবুক কর্তৃপক্ষ নেয়নি। কিন্তু ২ হাজার কোটি টাকার বিজ্ঞাপন ঠিকই নিচ্ছে।
বারবার তাগিদ দেওয়ার পরেও তারা বাংলাদেশে একটি অফিস দেয়নি। আইনজ্ঞরা বলেন, তাদেরকে নিয়ন্ত্রণহীন চলতে দেওয়ার দায় রাষ্ট্রের। কারণ আমাদের ফেসবুক চালানোর কোনো নীতিমালাই এখনো তৈরি হয়নি। এই সুযোগ তো সুযোগ সন্ধানীরা নেবেই।
নওগাঁ এবং মুন্সিগঞ্জের যত অন্তমিলের কথাই বলি, যত অসভ্যতার উদাহরণ টানি না কেন আমি এখনো এসব বন্ধের কোনো সুবাতাস পাচ্ছি না। কিন্তু হতাশও হচ্ছি না। কারণ আমি মনে করি, মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িকতার পরিবেশ তৈরি আছে। কী কারণে যেন সব ঘুমিয়ে গেছে। একটা ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দিতে পারলেই হলো। আমি নিশ্চিত ভাবেই বিশ্বাস করি, সেই ধাক্কা দেওয়ার কাজটি কঠিন নয়।
পলাশ আহসান ।। যুগ্ম প্রধান বার্তা সম্পাদক, একাত্তর টেলিভিশন
[email protected]