খাল উদ্ধার কার্যক্রমের অগ্রগতি কতদূর?
একটু বৃষ্টি হলেই ‘ডুবে যায়’ ঢাকা। ভোগান্তিতে পড়ে রাজধানীবাসী। এই ভোগান্তি দূর করতে দরকার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা। এমন পরিস্থিতিতে ২০২০ সালের ৩০ ডিসেম্বর দুই সিটি করপোরেশনকে খাল ও ড্রেনেজের দায়িত্ব হস্তান্তর করে ঢাকা ওয়াসা। সিটি করপোরেশন জলাবদ্ধতা নিরসনের দায়িত্ব পাওয়ায় আশার আলো জ্বলে শহরবাসীর মনে।
দায়িত্ব পেয়ে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন খালগুলোকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করে। বেশ হাঁকডাক দিয়েই কাজ শুরু হয়। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে অনেকটাই কমে গেছে সেই কাজের গতি।
এমন পরিস্থিতিতে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, খাল উদ্ধার করে দ্রুত পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনতে হবে। না হলে আগামী বর্ষাতেও ভোগান্তি পিছু ছাড়বে না।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্রে জানা গেছে, খাল দখলমুক্ত করে ঢেলে সাজানোর কাজ চলছে। প্রথমে খালে স্বচ্ছ পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনা হবে। এরপর খাল এলাকায় সৌন্দর্য বর্ধন করা হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ বাস্তবায়ন হলে বর্ষাকালে সামান্য বৃষ্টিতেই ডুববে না রাজধানী। মুষলধারে বৃষ্টি হলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পানি খাল ও ড্রেন দিয়ে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু নদীতে নেমে যাবে।
কাজের অগ্রগতি কত?
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ফলে নতুন বছরের প্রথম দিন থেকেই খাল ও নালার সব দায়িত্ব গিয়ে পড়ে দুই সিটি করপোরেশনের ওপর। এর আগে ঢাকা মহানগরীতে প্রধান ড্রেন লাইনগুলো নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। আর শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল।
ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তরের পর খালগুলোর জায়গা দখল করে গড়ে ওঠা বেশ কিছু অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। পাশাপাশি খালগুলোর শাখা-প্রশাখা, বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।তবে আগের তুলনায় কাজের গতি অনেকটাই কমে গেছে। পুরোপুরি কাজ শেষ হতে আরও সময় লাগবে বলে জানা গেছে দুই সিটি করপোরেশন সূত্রে।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন
দায়িত্ব পাওয়ার পর গত ১১ মাসে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আওতায় থাকা খালগুলো থেকে ৭৯ হাজার টনের বেশি ক্ষতিকর বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে বলে সংস্থাটির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে।
এ বিষয়ে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসেই খালগুলো থেকে প্রায় ৬৯ হাজার ২৩৮ টন ভাসমান বর্জ্য এবং নাব্যতা বৃদ্ধির জন্য আরও প্রায় ১০ হাজার মেট্রিক টন স্লাজ অপসারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে যেসব খাল থেকে বর্জ্য অপসারণ করা হয়েছে সেসব খালের পানিপ্রবাহও বৃদ্ধি পেয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জনগণের সহায়তায় খাল উদ্ধার ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সহযোগিতায় খালগুলোর সীমানা নির্ধারণ করা হবে। সবাই মিলে সবার ঢাকাকে দখল, দূষণ ও দুষ্ট লোকের কবল থেকে মুক্ত করে সবার বাসযোগ্য সুস্থ, সচল ও আধুনিক ঢাকায় পরিণত করতে হবে।
জানা গেছে, খাল উদ্ধার করে পানি প্রবাহ ফিরিয়ে আনার পাশাপাশি খালের রূপ বদলে দিতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সে অনুযায়ী কাজ করছে সংস্থাটি। সাগুফতা খাল, রামচন্দ্রপুর খাল, ইব্রাহিমপুর খাল, গোদাগারি খাল, রূপনগর খালসহ ১৪টি খাল থেকে বর্জ্য অপসারণে বেশ কিছু কাজ করেছে ডিএনসিসি। চারটি নদীর সাথে এসবের সংযোগ স্থাপন করতে চায় ডিএনসিসি। এছাড়া হাতিরঝিল থেকে কালাচাঁদপুর, বনানী কবরস্থান, কড়াইল বস্তিতে যেন নৌপথে যাওয়া যায় সেই ব্যবস্থার পাশাপাশি কয়েকটি ব্রিজ উঁচু করার জন্য একটি প্রকল্প গ্রহণ করেছে তারা।
পাশাপাশি খাল দখলমুক্ত করা, সীমানা নির্ধারণ করে সৌন্দর্য বর্ধনে তিন ধাপে কাজ করবে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি)। সেক্ষেত্রে স্বল্পমেয়াদি, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘমেয়াদি এই তিনটি ধাপে কাজগুলো করা হবে। প্রথম ধাপে খাল দখলমুক্ত করে বর্জ্য অপসারণ করে পানির প্রবাহ ফেরানো হবে। এরপর খালের পারে গাছ লাগানো, ওয়াকওয়ে ও সাইকেল লেনের কাজ দুই ধাপের মাধ্যমে করবে সংস্থাটি। কাগজ-কলমে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এলাকার মধ্যে ২৬টি খাল রয়েছে। এই খালগুলোর দুই পাড়ের সীমানা নির্ধারণ করা এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খালের জায়গাগুলো উন্মুক্ত করতে প্রথমে কাজ করছে ডিএনসিসি।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ওয়াসার কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেওয়ার পর ২ জানুয়ারি থেকে জিরানি, মান্ডা, শ্যামপুর, কালুনগরসহ খালগুলোর শাখা-প্রশাখা এবং পান্থপথ ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট থেকে বর্জ্য অপসারণ কার্যক্রম শুরু করে। তারমধ্যে এসব খাল ও বক্স কালভার্ট থেকে ১ লাখ ৩ হাজার ৫শ টনের বেশি বর্জ্য ও ৬ লাখ ৭৯ হাজার টন পলি অপসারণ করা হয়েছে। এছাড়াও ওয়াসার কাছ থেকে বুঝে পাওয়া অচল দুটি পাম্প স্টেশনের তিনটি পাম্প মেশিন সচল করতে সক্ষম হয় তারা। বাকি তিনটি সচল করতে কাজ শুরু হয়। এছাড়াও ওয়াসার কাছ থেকে পাওয়া বদ্ধ নর্দমা ও উন্মুক্ত নর্দমাগুলো পরিষ্কারের কাজ চলমান ছিল।
ডিএসসিসি বলছে, কাজ শেষ হলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা অনেকাংশেই কমে যাবে। আগামী ২ বছরের মধ্যে জলাবদ্ধতাকে একটি সহনীয় মাত্রায় আনতে সক্ষম হবে।
অন্যদিকে রাজধানীর চারটি খাল উদ্ধার করে সেগুলোকে দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে তুলতে ৯৮১ কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ডিএসসিসির কালুনগর, জিরানি, মান্ডা ও শ্যামপুর খালের জন্য প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়েছে। এই খালগুলো উদ্ধার করে দুই পাড়ে বানানো হবে ওয়াকওয়ে, থাকবে বাইসাইকেল লেন, মাছ ধরার শেড, বাগান, ফোয়ারা, ফুটওভার ব্রিজ, ইকোপার্ক, পাবলিক টয়লেট, খেলার মাঠসহ আরও নানান উদ্যোগ। এছাড়া ধোলাইখাল বক্স কালভার্ট, পান্থপথ বক্স কালভার্ট ও সেগুনবাগিচা বক্স কালভার্ট পরিষ্কারে ৩০ কোটি টাকার আরেকটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন।
জানা গেছে, জলাবদ্ধতা নিরসনের অংশ হিসেবে ঢাকা ওয়াসা শহরের খাল, প্রায় ৩৮৫ কিলোমিটার নালা ও চারটি পাম্পস্টেশন রক্ষণাবেক্ষণ করে আসছিল। এছাড়া দুই সিটি করপোরেশন দেখভাল করতো প্রায় ২ হাজার ২১১ কিলোমিটার নালা। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়। এর আগে ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনা ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদফতরের হাতে ছিল। এরপর পৌরসভা এ দায়িত্ব পালন করত। ১৯৮৮ সালে এটি ঢাকা ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়।
জানা গেছে, খালের দায়িত্ব পাওয়ার পর খাল ও নালা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সরকারের কাছে ২৬১ কোটি টাকা বরাদ্দ চেয়েছে দুই সিটি করপোরেশন। আগে খাল রক্ষণাবেক্ষণে ঢাকা ওয়াসার নিজস্ব বরাদ্দ ছিল না। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছ থেকে ওয়াসা এ খাতে বছরে ৪০ থেকে ৬০ কোটি টাকা পেত।
খাল উদ্ধারের কার্যক্রম বিষয়ে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকার খাল ও জলাশয়কে সুনির্দিষ্ট নেটওয়ার্কের মধ্যে আনতে যেসব খাল সিটি করপোরেশনের আওতার বাইরে রয়েছে সেগুলোকেও সিটি করপোরেশনের হাতে ন্যস্ত করা জরুরি। খাল ও জলাশয় কেন্দ্রিক নগর পরিকল্পনার ধারণাকে সন্নিবেশিত করে মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে; যেখানে জলাশয়কেন্দ্রিক গণপরিসর, হাটার স্থান, সবুজায়নের মাধ্যমে জনগণের অংশীদারিত্ব বাড়ানোর মাধ্যমে খালের দখল ও দূষণ প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
এএসএস/এইচকে/