ভারতীয় ঋণ যেন গলার কাঁটা, আশা ছাড়ল কর্তৃপক্ষ!
দেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প বাস্তবায়ন মানেই দীর্ঘসূত্রতা। জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় অনুমোদনের পর বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবসময়ই নানা জটিলতায় ভোগে এসব প্রকল্প। যেমন- কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প, গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দিন আহমেদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্প।
মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট বেশির ভাগ প্রকল্পই হয় রাজনৈতিক কারণে, না হয় প্রকল্পের ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সমস্যার কারণে বাস্তবায়নের মেয়াদ যেন শেষই হতে চায় না। ‘শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন’ জামালপুর (প্রথম সংশোধিত) শীর্ষক প্রকল্পেও এমন ভূত জেঁকে বসেছে।
জানা গেছে, প্রকল্পটির বাস্তবায়নের মেয়াদ শেষ হওয়ার পথে। এখনও শুরু হয়নি এর মূল কাজ। কারণ, ভারতীয় ঋণে প্রকল্প বাস্তবায়ন! দরপত্র জাটিলতায় ঝুলে আছে কাজ। চলতি মাসের (নভেম্বর) ১১ তারিখ প্রকল্পটির স্টিয়ারিং কমিটির (পিএসসি) সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সূত্রে এমন তথ্য জানা গেছে।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সিনিয়র সচিব লোকমান হোসেন মিয়ার সভাপতিত্বে ওই সভায় প্রকল্পটির ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা হয়।
প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা জানান, ‘শেখ হাসিনা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল এবং নার্সিং কলেজ স্থাপন’ প্রকল্পটি জুন ২০১৬ থেকে ডিসেম্বর ২০২১ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে অনুমোদন দেয় একনেক। প্রকল্পটির মূল অনুমোদিত ব্যয় ধরা হয় ৯৫০ কোটি ৫০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। এর মধ্যে ৬৭০ কোটি ৫০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা সরকারি কোষাগার থেকে ব্যয় হওয়ার কথা। বাকি ২৮০ কোটি টাকা ভারতীয় লাইন অব ক্রেডিট (এলওসি) ঋণ থেকে ব্যয় করার কথা।
লাইন অব ক্রেডিট কী
লাইন অব ক্রেডিট অর্থ হলো, এ ঋণের অর্থ খরচ করবে বাংলাদেশ, তবে তা বিশেষ কিছু শর্তের আওতায়। বিশেষ কিছু প্রকল্পেই কেবল এ অর্থ ব্যয় করা যাবে এবং সেই ব্যয়ের সিংহভাগই ঋণদাতা দেশের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করতে হবে
প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতির বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. অলিউল্লাহ, এনডিসি ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রকল্পটির মূল কাজ অর্থাৎ হাসপাতাল ভবন নির্মাণের কথা ছিল ভারতীয় ঋণের টাকায়। কিন্তু এক্ষেত্রে ইতোমধ্যে তৃতীয়বার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে।
‘প্রথমবার আহ্বান করা দরপত্রে ভারতীয় দরদাতাদের উদ্ধৃত মূল্য উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) উল্লেখিত ব্যয় অপেক্ষা বেশি হওয়ায় সেটি বাতিল করা হয়। দ্বিতীয়বার আহ্বান করা দরপত্রে একজন দরদাতা অংশগ্রহণ করেন। দরদাতার উদ্ধৃত মূল্য ডিপিপিতে উল্লেখিত ব্যয় অপেক্ষা বেশি হওয়ায় সেটিও বাতিল হয়। তৃতীয়বার কোভিডজনিত কারণে কোনো দরদাতা পাওয়া যায়নি।’
মূলত টেন্ডার কার্যক্রম যথাসময়ে করতে না পারায় হাসপাতাল ভবন নির্মাণে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এজন্য প্রকল্পটি এলওসি তালিকা থেকে বাদ দিয়ে জিওবি’তে (সরকার) আনা এবং হাসপাতাল ভবনের নির্মাণকাজ শুরু করতে না পারায় প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো প্রয়োজন— মনে করেন মো. অলিউল্লাহ।
পিএসসি সভায় প্রকল্প পরিচালক জানান, গত বছরের জুন পর্যন্ত শুধু সরকারি খাত থেকে এ প্রকল্পে ২০৬ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। সরকারি অর্থায়নে কাজের অগ্রগতি ৮০ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি ৭৮ শতাংশ। কিন্তু এলওসি ঋণ থেকে কোনো টাকা খরচ করা সম্ভব হয়নি।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা) মো. অলিউল্লাহ, এনডিসি ঢাকা পোস্টকে আরও বলেন, গত ২৭ ও ২৮ অক্টোবর এলওসি’র আওতায় গৃহীত প্রকল্পগুলোর অগ্রগতির বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) ১৯তম বাংলাদেশ-ভারত দ্বিপাক্ষিক পর্যালোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে এলওসি বাদ দিয়ে জিওবি অর্থায়নে হাসপাতাল ভবন নির্মাণের বিষয়টি আলোচিত হয়। ওই সভার সিদ্ধান্তের আলোকে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং প্রকল্পের মেয়াদ যৌক্তিকভাবে বাড়াতে হবে। এজন্য প্রকল্পটির সংশোধন প্রয়োজন।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও পরামর্শক ড. জাহিদ হোসেন ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলওসি ঋণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন শর্ত থাকে। যেমন- প্রকল্পের মূল কাজ ওদের (ভারতীয়) ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান করবে অথবা মালামাল তাদের কাছ থেকে নিতে হবে— এমন অনেক শর্ত থাকে। এ কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা হয়।
‘এছাড়া, আমাদের দেশের বেশির ভাগ প্রকল্পই বাস্তবায়নে কালক্ষেপণ হয়। এটি যে শুধু অর্থায়নের ওপর নির্ভর, এমনও নয়। সরকারি অর্থায়ন বা ঋণ, অধিকাংশ প্রকল্পই বাস্তবায়নে দেরি হয়।’
গত পাঁচ বছরে কোনো অর্থই ছাড় করেনি ভারত। ফলে কর্তৃপক্ষ সরকারি অর্থায়নে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও ঋণের অর্থ ছাড় না করায় সরকারের কী করা উচিত— এমন প্রশ্নের জবাবে ড. জাহিদ বলেন, ‘আমার মতে, ঋণের টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন খুব দ্রুতই সরলীকরণ করাটা ঠিক হবে না। এলওসি’র অধীনে যেসব প্রকল্প হচ্ছে, সবগুলো কিন্তু একই অবস্থায় নাই। একেক প্রকল্পে একেক ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। এজন্য এলওসি প্রজেক্ট থেকে বের হয়ে আসলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এমন ধারণাও ঠিক নয়।’
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বলছে, আমাদের যতটুকু কাজ করার আমরা তা করেছি কিন্তু সহযোগী সংস্থাগুলো অর্থছাড় না করলে বা টেন্ডারে অংশগ্রহণ না করলে আমরা কী করব— এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন সহযোগীদের অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এভাবেই বক্তব্য দেয়। এটা তাদের কমন (প্রচলিত) বক্তব্য। টেন্ডার দেওয়ার পরও যদি উন্নয়ন সহযোগীরা না আসে, তাহলে চুক্তিতে যেভাবে বলা আছে সেভাবে পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। কারণ, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে ঋণ নিতে হলে সরকার একটি চুক্তি করে। ওই চুক্তিতে অর্থায়নের সার্বিক বিষয়ে বর্ণনা থাকে। সুতরাং যে সমস্যার কথা মন্ত্রণালয় বলছে, সেই সমস্যা যদি হয়েই থাকে তাহলে চুক্তি অনুযায়ী পদক্ষেপ নিতে পারে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।’
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ঢাকা পোস্টকে বলেন, অনেক উন্নয়ন সহযোগীর ঋণের টাকা আমাদের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়ে আমি বিস্তারিত কিছু বলতেও চাই না।
‘বন্ধুত্বের খাতিরে অনেক সহযোগীর কাছ থেকে আমাদের ঋণ নিতে হয়। ভারত আমাদের বন্ধুপ্রতিম দেশ। তাদের কাছ থেকেও আমাদের ঋণ নিতে হয়, তারাও আমাদের উন্নয়নে সহযোগী হতে চায়। তবে কী কারণে ঋণের টাকা দিল না বা টেন্ডারে অংশগ্রহণ করল না— এটা বিস্তারিত না জেনে বলতে পারব না। যেকোনো প্রকল্পের শেষ সময়ে এসে এ ধরনের সিদ্ধান্ত আমাদের জন্য ক্ষতিকর।’
মন্ত্রী আরও বলেন, ‘এ পর্যায়ে প্রকল্পটি যদি পরিকল্পনা কমিশনে আসে, সেক্ষেত্রে মেয়াদ তো বাড়াতেই হবে। কারণ, প্রকল্পে সরকারের কিছু অংশ ইতোমধ্যে বিনিয়োগ হয়েছে। আমার মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব আসলে যত দ্রুত সম্ভব প্রকল্পটির সংশোধনের প্রক্রিয়া শেষ করব।’
এসআর/এমএআর/এমএইচএস