তৈয়বের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খোয়া, ধূলিসাৎ বিদেশ যাওয়ার স্বপ্নও
রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন জামালপুরের মেলানদহ থানা এলাকার শামীম আহমেদ (২৮)। চাচার সঙ্গে ১৫ বছর ধরে খিলক্ষেতে কাজ করতেন শামীম। কয়েকবছর আগে চাচার সঙ্গে পরিচয় সূত্রে সৌদি আরবে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় আবু তৈয়ব। তৈয়ব অনেক লোক পাঠিয়েছিল বলে তাকে (শামীম) প্রলুব্ধ করেছিল।
সৌদিতে গেলে কপাল ফিরবে শামীমের। রোজগার হবে অনেক টাকা। তৈয়বের কথায় আর চাচা প্ররোচনায় প্রলুব্ধ শামীম কয়েক দফায় দিয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এরপর দুই বছর পেরিয়ে যায়, কিন্তু সৌদি যাওয়া হয়নি শামীমের।
শামীম বলছেন, দেশেই ভালো ছিলাম। যা করছিলাম তাতেই পেট চলছিল। কিন্তু দুই বছর আগে ভিসা করেও যাওয়া হয়নি, মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। দেখা মেলে না তৈয়বের। ফোন দিলে কেটে দেয়, কখনো বন্ধ রাখে। আবার কখনো ফোন ধরে তৈয়ব বলে, ‘বাপ মরেছে, আপনেও ভালো করে মরেন।’
তৈয়ব বলেছিল, সৌদি যেতে হলে অপেক্ষা করতে হবে শামীমকে। কিন্তু শামীমের অপেক্ষা আর ফুরোয় না।
শুধু শামীম নয়, বিদেশ যেতে ইচ্ছুক এমন শত ভুক্তভোগীর সঙ্গে প্রতারণা করে চা দোকানি থেকে ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের মালিক বনে গেছেন মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের আবু তৈয়ব। চায়ের দোকানদার হলেও তৈয়ব পরিচয় দিতেন স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে। এর আড়ালে টুটুলের মানবপাচার চক্রে জড়িয়ে বহু লোককে প্রতারণার মাধ্যমে বিদেশে পাঠানো এবং দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা।
সম্প্রতি কয়েকজন নারী ভুক্তভোগীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যে মানবপাচারকারী চক্রের অন্যতম হোতা মেহেরপুরের গাংনীর বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম ওরফে টুটুল ও প্র্রধান সহযোগী তৈয়বসহ ৮ জনকে আটক করে র্যাব-৪।
আটক হওয়া বাকিরা হলেন, গোপালগঞ্জের শাহ্ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন (৩৮), মেহেরপুরের মারুফ হাসান (৩৭), জাহাঙ্গীর আলম (৩৮) ও লালটু ইসলাম (২৮), শরীয়তপুরের আলামিন হোসাইন (৩০), কুষ্টিয়ার আব্দুল্লাহ আল মামুন (৫৪)।
র্যাব বলছে, টুটুল-তৈয়বের চক্রে তৈয়বই মূলত সরল বিশ্বাসে বিদেশ পাঠানো ফাঁদ পেতে প্রলোভন দেখাতেন। টুটুলের বাড্ডা এলাকার লিংক রোডে অবৈধ টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজের মাধ্যমে লোক পাঠাতে পারতো না। সেজন্য বৈধ অন্য জনশক্তি রফতানি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মানবপাচার করে আসছিল।
তৈয়বের প্রলোভনে ৪ লাখ ৩০ হাজার টাকা খোয়ানোর পরও গত দুই বছরেও বিদেশ যেতে পারেননি ভুক্তভোগী শামীম।
বুধবার দুপুরে শামীম ঢাকা পোস্টকে বলেন, এসএসসি ফেল করার পর ঢাকায় খিলক্ষেতে চাচার কাছে রাজমিস্ত্রির কাজ শিখি। দিন ভালোই যাচ্ছিল। স্বচ্ছলতা না থাকলেও অভাবে ছিলাম না। কিন্তু দুই বছর আগে তৈয়বের খপ্পরে পড়ে সৌদি আরবে একটি মার্কেটে ক্লিনার হিসেবে ভিসা করি। কিন্তু যাওয়া আর হয়নি। চার লাখ ৩০ হাজার নিয়ে লাপাত্তা ছিল তৈয়ব।
ধার আর ঋণের দেনায় জর্জরিত শামীম সৌদি যাবার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। শুধু দাবি, কেউ যদি টাকাগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন!
প্রায় একইভাবে সরল বিশ্বাসে সৌদি আরবে যাবার প্রলোভনে জমি বিক্রি আর সুদের ওপর ঋণ করে ৩ লাখ টাকা অপরিচিত তৈয়বের হাতে তুলে দিয়েছিলেন ঠাকুরগাঁও বালিয়াডাঙ্গির রতনদিঘির হাফিজুর রহমান (২৫)।
হাফিজুর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৪ বছর ধরে আমি হেমায়েতপুরে একটি গার্মেন্টসে চাকরি করি। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে অনেকে সৌদি যাচ্ছিল। নিজেও চেষ্টা করছিলাম। পাসপোর্ট করতে দিয়ে মিরপুর-১৪ এলাকায় পরিচয় হয় তৈয়বের সঙ্গে। প্রলোভনে পড়ে তার হাতে তুলে দেই পাসপোর্ট। প্রথমে মালয়েশিয়ার কথা বলেছিল তৈয়ব। ৩ লাখ টাকা নিয়ে ঘোরাতে থাকে তৈয়ব। মালয়েশিয়াতে না পেরে সৌদির কথা জানায়। এরপর দেখা নেই তৈয়বের।
গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি যাবার কথা ছিল বগুড়ার মোর্শেদা বেগমের। তৈয়বের খপ্পরে আড়াই লাখ টাকা দিয়ে এখন নিঃস্ব মোর্শেদা। ভিসা আর পাসপোর্টও এখন তৈয়বের কব্জায়।
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ভাবছিলাম কপাল ফিরবে। কষ্ট করে হলেও টাকা রোজগার করবো, সন্তানদের মানুষ করবো। কোনোটাই হলো না। উল্টো আড়াই লাখ টাকা ঋণের ঘানি নিয়ে ঘুরতেছি।
আরেক ভুক্তভোগী বগুড়ার শিবগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম। তিনি পারিবারিক ও অন্যের জমি বর্গা নিয়ে কৃষি কাজে জড়িত ছিলেন। তৈয়বের বাড়ি রংপুর মিঠাপুকুরে। সেখানে ফুফুর বাসা। ফুফুর মাধ্যমেই তৈয়বের সঙ্গে পরিচয়। রবিউলকে ইরাকে পাঠানোর কথা বলে ভিসা ও পাসপোর্ট নিয়ে নেয় তৈয়ব, এরপর আদায় করে ৩ লাখ ১০ হাজার টাকা।
র্যাব-৪ এর অধিনায়ক(সিও) অতিরিক্ত ডিআইজি মোজাম্মেল হক বলেন, এইচএসসি পাস টুটুল মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার কামন্দী গ্রামে মুদি দোকানদার হিসেবে কাজ করতো। মাঝে মধ্যে ঢাকায় আসতো। লোভে পড়ে মানবপাচারকারী চক্রের জড়িয়ে পড়ে। শুরুতে চক্রের দালাল হিসেবে বিভিন্ন এজেন্সির মাধ্যমে বিদেশে লোক পাঠানো শুরু করেন। পরে নিজেই রাজধানীর বাড্ডা এলাকায় খুলে বসেন টুটুল ওভারসিজ, লিমন ওভারসিজ ও লয়াল ওভারসিজ নামে তিন ওভারসিজ এজেন্সি। এর মাধ্যমে বিভিন্ন অঞ্চলের বেকার ও শিক্ষিত বহু নারী এবং পুরুষকে বিদেশে পাঠানোর কথা বলে তাদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা প্রতারণামূলকভাবে গ্রহণ করেছে টুটুল।
আবু তৈয়ব টুটুলের প্রতারণার অন্যতম সহযোগী। শুরুতে ছিলেন তৈয়ব চা দোকানি। তেমন পড়াশুনা না থাকলেও টুটুলের হাত ধরে মানবপাচার চক্রে জড়িয়ে প্রতারণা শুরু করেন। বিদেশে মানবপাচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি দেওয়ার নামে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। অনেককে দিয়েছেন চাকরির ভূয়া নিয়োগপত্রও। নিজেকে পরিচয় দিতেন স্বনামধ্যম এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার হিসেবে।
বিদেশে পাচারের উদ্দেশ্যে প্রতারণার কৌশল
র্যাব-৪ জানায়, প্রতারক টুটুল ও তৈয়বের নির্দেশে চক্রের সদস্যরা টার্গেট সংগ্রহে দেশের বেকার ও অস্বচ্ছল তরুণ-তরুণীদের সৌদি আরব, জর্ডান ও লেবাননসহ বিভিন্ন দেশের বাসা-বাড়িতে লোভনীয় বেতনে কাজ দেওয়ার নাম করে প্রলুব্ধ করতো। এরপর বিদেশ যেতে আগ্রহীদের ঢাকায় মূলহোতা টুটুল ও তৈয়বের কাছে পাঠাতো।
টাকা সংগ্রহ
মোজাম্মেল হক বলেন, টুটুল ও তৈয়ব তাদের অফিসে এনে ভিকটিমদের বিদেশে বাসাবাড়িতে কাজের নামে পাঠানোর ভুয়া মানি রিসিট প্রদান করে। এ বাবদ প্রতিজনের কাছ থেকে ২ থেকে ৫ লাখ টাকা নিত তারা। প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রেও পাচারকারী চক্রের কয়েকজন সদস্য নিজেদের উচ্চশিক্ষিত বলে পরিচয় দিতেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের বাসাবাড়িতে কাজের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভিকটিমদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা আদায় করতেন চক্রের সদস্যরা।
মানবপাচার চক্রের অন্যতম সহযোগী শাহ মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন লিমন ও মারুফ হাসান ছিলেন বেতনভুক্ত কর্মচারী। জাহাঙ্গীর আলম, লালটু ইসলাম, আলামিন হোসাইন ও আব্দল্লাহ আল মামুন টার্গেট সংগ্রহ, প্রার্থীর পাসপোর্টের ব্যবস্থা, কথিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, টাকা সংগ্রহ, প্রাথমিক মেডিকেল সম্পন্ন করাসহ অন্যান্য কাজে সহায়তা করে আসছিল। কথিত মেডিকেল টেস্ট শেষে নারী ভিকটিমদের বাসাবাড়িতে বিক্রি এবং পুরুষ ভিকটিমদের অমানবিক কাজে নিয়োজিত করার উদ্দেশ্যে সৌদি আরবের জেদ্দা ও রিয়াদ এবং জর্ডান ও লেবাননে টাকার বিনিময়ে বিক্রি করতো। পাচার হওয়া ভিকটিমরা বিদেশে গিয়ে পরিবারের সঙ্গে আর কোনো যোগাযোগ করতে পারতো না। যাদের বিদেশে পাঠানো সম্ভব হতো না তারা টাকা ফেরতে যোগাযোগ করলে ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হতো।
চাকরি দেওয়ার নামেও তৈয়বের প্রতারণা
তৈয়ব নিজেকে স্বনামধন্য এয়ারলাইন্সের ম্যানেজার পরিচয় দিয়ে শিক্ষিত বেকার তরুণ-তরুণীদের উচ্চ বেতনে লোভনীয় চাকরির কথা বলে যোগাযোগ করতো। এরপর নিজ কার্যালয়ে নিয়ে আসতো। বিভিন্ন বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনে চাকরিসহ আরও কিছু প্রতিষ্ঠানে ভূয়া চাকরির যোগদানপত্র দিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাত করেছে বলে র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে স্বীকার করেছে তৈয়ব।
জানতে চাইলে মোজাম্মেল হক বলেন, তাদের তিন ওভারসিজ প্রতিষ্ঠানের বৈধতা না থাকায় বৈধ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করে এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক মানুষকে পাচার করেছে। এছাড়া শতাধিক মানুষকে বিদেশে পাঠানো কথা বলে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ২৫ জনের মতো ভুক্তভোগী র্যাবে যোগাযোগ করেছে। প্রতারিত ভুক্তভোগীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
জেইউ/এসএম