এবার ঘাট স্থানান্তর নিয়ে শুরু হয়েছে ‘রাজনীতি’
পদ্মা বহুমুখী সেতুর বিভিন্ন খুঁটিতে একের পর এক ফেরির ধাক্কার ঘটনায় সড়কমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী থেকে শুরু করে সরকারের উচ্চপর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বেশ উদ্বিগ্ন ও বিব্রত। গত ২৩ জুলাই পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর খুঁটিতে ফেরির ধাক্কার পর গঠিত তদন্ত কমিটি ঘাট স্থানান্তরের সুপারিশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ সেতু বিভাগের পক্ষ থেকে বলা হয়, ঘাট স্থানান্তরের কোনো প্রয়োজন নেই।
সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা ঢাকা পোস্টকে বলেন, একটি ঘাট স্থানান্তরে অন্তত ২০০ কোটি টাকার সরকারি অর্থের অপচয় হয়। শুধু অর্থের অপচয় নয়, ঘাট স্থানান্তর হলে পদ্মা সেতুর নদীশাসন কাজেরও ব্যাঘাত ঘটবে। তারপরও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) ঘাট স্থানান্তরের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ‘রাজনীতি’ শুরু হয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তীব্র স্রোতের কারণে তৈরি হওয়া ঘূর্ণনে ফেরিগুলো বারবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে পদ্মা সেতুর খুঁটিতে। এ কারণে ঘাট স্থানান্তর জরুরি। সংস্থাটির একটি পক্ষ বাংলাবাজার ঘাট জাজিরার মাঝিরকান্দি স্থানান্তরের পক্ষে। পাশাপাশি ঘাট স্থানান্তর না হওয়া পর্যন্ত বাংলাবাজার-শিমুলিয়া রুটে রো রো ফেরি না চালানোর পক্ষেও তোড়জোড় চলছে বলে সংস্থাটি সূত্রে জানা গেছে।
সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুর খুঁটিতে যতগুলো ফেরির ধাক্কার ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান জরুরি। যেসব তদন্ত হচ্ছে সেগুলো গভীরভাবে হচ্ছে না। গভীরভাবে অনুসন্ধান হলে আসল কারণ বেরিয়ে আসবে। আসল কারণ না জানা পর্যন্ত ঘাট স্থানান্তর করা উচিত হবে না। তাতে সরকারের অর্থের অপচয় হবে
তবে বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ মনে করছেন, সাম্প্রতিক সময়ে পদ্মা সেতুর খুঁটিতে যতগুলো ফেরির ধাক্কার ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ অনুসন্ধান জরুরি। যেসব তদন্ত হচ্ছে সেগুলো গভীরভাবে হচ্ছে না। গভীরভাবে অনুসন্ধান হলে আসল কারণ বেরিয়ে আসবে। আসল কারণ না জানা পর্যন্ত ঘাট স্থানান্তর করা উচিত হবে না। তাতে সরকারের অর্থের অপচয় হবে।
এমন বিতর্কের মধ্যে সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের গতকাল শুক্রবার (১৩ আগস্ট) মুন্সিগঞ্জের মাওয়াপ্রান্তে পদ্মা সেতুর প্রকল্প এলাকা পরিদর্শন করেন। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, পদ্মা সেতুর মতো জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে একের পর এক ফেরির ধাক্কা লাগার ঘটনা ‘সর্ষের মধ্যেই ভূত’ থাকার মতো ঘটনা হতে পারে।
তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুর পিলারে (খুঁটি) কেন ফেরির ধাক্কা, এ প্রশ্ন আমারও। এ নিয়ে চারবার ধাক্কার ঘটনা ঘটল। এগুলো তুচ্ছ কোনো ঘটনা বা নিছক কোনো দুর্ঘটনা বা চালকের অদক্ষতা বলে এড়িয়ে যাওয়া ভুল হবে। এখানে কোনো ষড়যন্ত্র আছে কি না, অন্তর্ঘাত আছে কি না— তদন্ত করে দেখতে হবে। সর্ষের মধ্যেই ভূত আছে কি না— তাও খতিয়ে দেখতে হবে।’ অর্থাৎ মন্ত্রী নিজেও গভীর অনুসন্ধানের ওপর জোর দিচ্ছেন।
এদিকে, পদ্মা সেতুর সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি ষড়যন্ত্র থাকে তবে তা অনুসন্ধানের মাধ্যমে বের করে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
ঘাট স্থানান্তরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কি না— এমন প্রশ্নের জবাবে বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান সৈয়দ মো. তাজুল ইসলাম শুক্রবার রাতে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ফেরি চলাচলের পথে পদ্মা সেতু এলাকা এড়ানোর জন্য বাংলাবাজার ঘাট স্থানান্তরের বিষয়ে মতামত পাওয়া গেছে। বাংলাবাজার ঘাট মাঝিরকান্দিতে স্থানান্তরের পক্ষে অনেকে। তবে এখনও এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খুব ব্যস্ত সময় পার করছি।
বিআইডব্লিউটিসি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাবাজার ঘাটটি শরীয়তপুরের জাজিরার মাঝিরকান্দি ঘাটে নেওয়ার বিষয়ে একটি পক্ষ ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। তারা বলছে, ঘাটটি স্থানান্তর করতে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগবে। অন্যদিকে, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের একাধিক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী ঢাকা পোস্টকে নাম প্রকাশ না করে বলেন, ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান না করে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে হঠাৎ করে ঘাট স্থানান্তর করা উচিত হবে না। বিআইডব্লিউটিসির পক্ষ থেকে এ ঘাট স্থানান্তরে দেড় মাস সময় লাগবে বলে বলা হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে এটি সরাতে অন্তত ছয় মাস সময় লাগবে।
পদ্মা সেতু প্রকল্পের জাজিরা অংশের নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত এক বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, যে ঘাট স্থানান্তরের কথা বলা হচ্ছে সেটি দ্রুত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করা সম্ভব হবে না। কারণ, সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যমান যেসব রাস্তা রয়েছে সেগুলো আরও প্রশস্ত করতে হবে। বর্তমানে রাস্তাগুলো দিয়ে পাশাপাশি দুটো গাড়ি চলাচল করতে পারে না। তাই দেড় মাসের মধ্যে ঘাট স্থানান্তরের বিষয়টি বাস্তবসম্মত নয়।
গত ২৩ জুলাই পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর খুঁটিতে ধাক্কা দেয় রো রো ফেরি শাহ জালাল। বিষয়টি তদন্তের জন্য বিআইডব্লিউটিসি একটি কমিটি গঠন করে। গত মাসেই কমিটি বিআইডব্লিউটিসির কাছে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়। কমিটি পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে শিমুলিয়া ফেরিঘাট পুরাতন মাওয়া ঘাটে অথবা বাংলাবাজার ঘাটটি মাঝিরকান্দিতে স্থানান্তরের সুপারিশ করে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের বিষয়টি গত ২৫ জুলাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। ঘাট সরানোর সুপারিশের চিঠি পদ্মা সেতু প্রকল্পের পরিচালক ও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছেও দেয় বিআইডব্লিউটিসি।
পদ্মা সেতুর নির্বাহী প্রকৌশলী রজব আলী শুক্রবার রাতে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পদ্মা নদীর একটি খুঁটি থেকে আরেকটি খুঁটির দূরত্ব ১৫০ মিটার। নৌযান চলাচলের জন্য যা যথেষ্ট। বিজ্ঞানসম্মতভাবে এ দূরত্ব রাখা হয়েছে। কী কারণে ফেরিগুলো পদ্মা সেতুর খুঁটিতে বারবার ধাক্কা দিচ্ছে তার ব্যাপক অনুসন্ধান দরকার।
কমিটি পদ্মা সেতুর নিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে অনতিবিলম্বে শিমুলিয়া ফেরিঘাট পুরাতন মাওয়া ঘাটে অথবা বাংলাবাজার ঘাটটি মাঝিরকান্দিতে স্থানান্তরের সুপারিশ করে। তদন্ত কমিটির সুপারিশের বিষয়টি গত ২৫ জুলাই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সেতু বিভাগের কাছে পাঠানো হয়
পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক শফিকুল ইসলাম এর আগে গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ঘাট সরানোর পক্ষে তারা নন।
প্রসঙ্গত, ২০২০ সালের নভেম্বর মাসে নদীশাসন কাজের সুবিধার জন্য প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে কাঁঠালবাড়ি থেকে ঘাটটি বাংলাবাজারে স্থানান্তর করা হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, এবার ঘাট সরালে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এটি করলেও কোনো লাভ হবে না। উল্টো পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ব্যাহত হতে পারে নদীশাসনের কাজ।
গত ২৩ জুলাই পদ্মা সেতুর ১৭ নম্বর পিলারের সঙ্গে শিমুলিয়া-বাংলাবাজার নৌপথের রো রো ফেরি শাহজালালের ধাক্কা লাগে। ২০ জুলাই রো রো ফেরি শাহ মখদুম ১৬ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খায়। ২৩ জুলাইয়ের ঘটনায় বিআইডব্লিউটিসি একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এতে চালক মাস্টার আব্দুল রহমানসহ দুজনকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়।
২০২০ সালের নভেম্বর মাসে নদীশাসন কাজের সুবিধার জন্য প্রায় ১৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে কাঁঠালবাড়ি থেকে ঘাটটি বাংলাবাজারে স্থানান্তর করা হয়। পদ্মা সেতু প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা বলছেন, এবার ঘাট সরালে কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা খরচ হবে। এটি করলেও কোনো লাভ হবে না। উল্টো পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ব্যাহত হতে পারে নদীশাসনের কাজ
গত ৯ আগস্ট সন্ধ্যায় বাংলাবাজার থেকে ছেড়ে আসা ফেরি বীরশ্রেষ্ঠ জাহাঙ্গীর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুটির ১০ নম্বর পিলারে আছড়ে পড়ে। এতে পিলার ও ফেরিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ সময় ফেরিতে থাকা গমভর্তি একটি ট্রাক উল্টে দুটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে। এ দুর্ঘটনায় আহত হন বেশ কয়েকজন যাত্রী।
সর্বশেষ গতকাল শুক্রবার (১৩ আগস্ট) সকাল ৮টার দিকে কাকলী নামের কে-টাইপের একটি ফেরি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সেতুর ১০ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা খায়। এতে ফেরিতে থাকা যাত্রীদের কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি। তবে পিলারের কোনো ক্ষতি হয়েছে কি না, তা তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি।
পিএসডি/এমএআর/