হলি আর্টিজানে হামলার ৫ বছর : যে ধ্বংসযজ্ঞে স্তম্ভিত ছিল জাতি
![হলি আর্টিজানে হামলার ৫ বছর : যে ধ্বংসযজ্ঞে স্তম্ভিত ছিল জাতি](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2021May/holy-top-20210701033046.jpg)
২০১৬ সালের ১ জুলাই গুলশান-২ এর লেক পাড়ের হলি আর্টিজান বেকারিতে ঘটে দেশের ইতিহাসের সব থেকে বড় জঙ্গি হামলা। নারকীয় এই হত্যাযজ্ঞে দুই পুলিশ কর্মকর্তা ও ১৭ জন বিদেশি নাগরিকসহ নিহত হন ২২ জন। সেই দিন রাত ৮টা ৫০মিনিট থেকে ১২ ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস এক জঙ্গি হামলার ভয়াবহতার সাক্ষী হয়েছিল গোটা জাতি। ২ জুলাই সকালে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো সদস্যদের পরিচালিত ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ অবসান হয় জিম্মিদশার, নিহত হয় হামলাকারী ৫ জঙ্গি।
অভিযানে নিহত জঙ্গিরা হলেন : মালয়েশিয়ার মোনাশ ইউনিভার্সিটির ছাত্র নিবরাস ইসলাম, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকার সাবেক ছাত্র মীর সামিহ মোবাশ্বের, বগুড়ার বিগিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদরাসার সাবেক ছাত্র খায়রুল ইসলাম পায়েল, বগুড়ার সরকারি আযিযুল হক কলেজের ছাত্র শফিকুল ইসলাম উজ্জ্বল।
হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তে উঠে আসে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য। তদন্ত সূত্রে জানা যায়, কোনো ধরনের বিদেশি সহায়তা ছাড়াই হোম গ্রোন জঙ্গিরা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড চালায়। 'নব্য জেএমবি' সদস্যরা দেশে উগ্রবাদী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা অংশ হিসবে এ হামলা চালায়।
তদন্ত সূত্রে জানা যায়, হলি আর্টিজান হামলার প্রথম ২০ মিনিটেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ চালায় জঙ্গিরা। তারা দেশি-বিদেশিদের গুলি করে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে/গলাকেটে মৃত্যু নিশ্চিত করে। হত্যার পর ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে বাইরে অবস্থানরত নব্য জেএমবির নেতা তামিম চৌধুরী ও মারজানের কাছে পাঠায় তারা।
![dhakapost](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2021May/holy-new-2-20210701032303.jpg)
যদিও হলি আর্টিজান হামলার পর দেশ থেকে জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদকে নির্মূল করতে এক যোগে অভিযানে নামে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট। এসব অভিযানে দেশে পরিচালিত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের অনেক সক্রিয় সদস্য গ্রেফতার ও বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দীর্ঘ দিনের অভিযানের ফসল হিসবে দেশে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
তবে নিয়ন্ত্রণে থাকলেও বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন অনলাইন প্লাটফর্ম ব্যবহার করে মাঝে মধ্যেই মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার চেষ্টা করে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া নজরদারি এবং গ্রেফতার অভিযানের কারণে এতে সফল হয়ে উঠতে পারছে না জঙ্গি সংগঠনগুলো।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, দীর্ঘ দিনের অভিযানের ফলে জঙ্গি সংগঠনগুলোর কোমর ভেঙে গেছে। তাদের পক্ষে দেশে বড় কোনো জঙ্গি হামলার ঘটানোর সামর্থ্য এখন আর নেই। তবে এতে তুষ্ট না হয়ে জঙ্গি সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স নীতি নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।
সে দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণ
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাত ৮ টা ৪০ মিনিটে গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) রিপন কুমার দাস ওয়্যারলেসে খবর পান হলি আর্টিজান বেকারিতে গোলাগুলি হচ্ছে। খবর পেয়ে তিনি একটি টিম নিয়ে রাত ৮টা ৫০মিনিটে ঘটনাস্থলে পৌঁছান। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন প্রচণ্ড গোলাগুলি হচ্ছে। কিন্তু পুলিশের আসার খবর পেয়ে রিপন কুমার দাসের টিমের ওপর গুলি ছোড়াসহ গ্রেনেড নিক্ষেপ করে জঙ্গিরা। এতে তার সঙ্গে থাকা কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হন।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় রিপন কুমার দাস তার ঊর্ধ্বতন অফিসারদের বিষয়টি ফোন করে জানান। পরে ডিএমপির তৎকালীন কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়াসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এসে ঘটনাস্থলে হাজির হন। এ সময়ের মধ্যে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে হলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার খবর। পরিস্থিতি বেসামাল দেখে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা হলি আর্টিজানসহ পুরো গুলশান এলাকা ঘিরে ফেলেন।
ডিএমপি কমিশনার ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের উপস্থিতি টের পেয়ে জঙ্গিরা রাত ১০টার দিকে হলি আর্টিজানের প্রধান গেটে আবারও গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে অন্তত ৩০ থেকে ৩৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হন। গ্রেনেড নিক্ষেপে আহত হয়ে ওই দিন রাত সাড়ে ১১টায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় বনানী থানার তৎকালীন অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. সালাহউদ্দিন খান ও ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) মো. রবিউল করিম মারা যান।
![dhakapost](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2021May/holy-new-3-20210701032325.jpg)
এর মধ্যে সাড়ে ১১টায় ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হন তৎকালীন র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। তিনি এ সময় সাংবাদিকদের জানান, হলি আর্টিজানের ভেতরে অন্তত ২০ জন বিদেশিসহ কয়েকজন বাংলাদেশিও আটকা পড়েছেন। ভেতরে যারা আছেন, তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য তারা বিপথগামীদের সঙ্গে কথা বলতে চান।
এরপর রাতভর চলতে থাকে জিম্মিদশা। হাজার চেষ্টা করেও জঙ্গিদের সঙ্গে কোনো প্রকার যোগাযোগ স্থাপন করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। এর মধ্যে রাত দেড়টার দিকে সাইট ইন্টেলিজেন্স গ্রুপে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলাকারী পাঁচ তরুণের ছবি প্রকাশ করে হামলার দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)।
জিম্মিদশার অবসান ঘটে ২ জুলাই
রাতভর চেষ্টা করেও সফল না হওয়ায় পর দিন ২ জুলাই সকালে শুরু হয় ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’। সকাল ৭টা ৪০মিনিটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ পরিচালনা করে ১২ ঘণ্টার জিম্মিদশার অবসান ঘটায়। মাত্র ১২ থেকে ১৩ মিনিটের মধ্যেই সব সন্ত্রাসীকে নির্মূল করে ওই এলাকায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে প্যারা কমান্ডো ব্যাটালিয়ন। ‘অপারেশন থান্ডারবোল্টে’ পর জঙ্গিদের হাতে নিহত ২০ জনের মরদেহ বের করে নিয়ে আসা হয় হলি আর্টিজান থেকে। এদের মধ্যে ৯ জন ইতালির নাগরিক, ৭ জন জাপানের, ১ জন ভারতের ও ৩ জন বাংলাদেশি।
পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি বিচার কাজ
হলি আর্টিজানের হামলার ঘটনার পর দায়ের করা মামলার তদন্তের দায়িত্ব পায় ডিএমপির কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিট। সিটিটিসি হামলার দুই বছরেরও বেশি সময় পর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় ২০১৮ সালের ৩ জুলাই। পরে ২০১৯ সালের ২৭ নভেম্বর গুলশানের হলি আর্টিজানে হামলার মামলায় ৭ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং এক আসামিকে খালাস দেন বিচারিক আদালত। ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান এ রায় দেন।
দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন জাহাঙ্গীর হোসেন ওরফে রাজীব গান্ধী, আসলাম হোসেন ওরফে র্যাশ, আব্দুস সবুর খান, রাকিবুল হাসান রিগ্যান, হাদিসুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ওরফে খালেদ এবং মামুনুর রশিদ রিপন। এছাড়া ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার বিষয়ে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় মিজানুর রহমান ওরফে বড় মিজানকে বেকসুর খালাস দেন আদালত।
![dhakapost](https://cdn.dhakapost.com/media/imgAll/BG/2021May/holy-new-4-20210701032347.jpg)
একই বছরের ৩০ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৭ আসামির ডেথরেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টে আসে। এর পরেই প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এই মামলার পেপারবুক প্রস্তুতের নির্দেশ দেন।
কিন্তু ২০২০ সালের প্রথম থেকে করোনার আঘাত শুরু হলে স্বাভাবিক আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। উচ্চ আদালতে অনেক আলোচিত মামলার বিচার থমকে যায়। এর মধ্যেও হলি আর্টিজান মামলার আপিল ও ডেথ রেফারেন্স শুনানি জন্য পেপারবুক তৈরি শেষ করা হয়। নিয়মানুযায়ী, প্রধান বিচারপতি এখন এই মামলার আপিল শুনানির জন্য হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নির্ধারণ করে দেবেন।
মামলার তদন্তে যা উঠে আসে
সিটিটিসির তদন্ত সূত্রে জানা যায়, দেশে অবস্থানরত বিদেশি নাগরিকদের হত্যা করার পরিকল্পনা থেকে হলি আর্টিজানে হামলা ঘটায় নব্য জেএমবির সদস্যরা। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে নব্য জেএমবির শুরাকমিটি গাইবান্ধার সাঘাটায় এক বৈঠকে এই হামলার পরিকল্পনা হয়।
হলি আর্টিজান মামলার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণ
হলি আর্টিজান জঙ্গি হামলার রায়ে আদালতের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, তথাকথিত জিহাদ কায়েমের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হলি আর্টিজান হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
এমএসি/এসকেডি