সিনেমার গল্পকেও হার মানিয়েছেন ডাচ বাংলার আইটি অফিসার
সিনেমার গল্পকে বাস্তবে রূপ দিয়ে তিন বছরে আড়াই কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন ডাচ বাংলা ব্যাংকের এডিসি ডিভিশনের (ঢাকা) সিনিয়র অফিসার মীর মো. শাহারুজ্জামান রনি। বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে রনি দেশ ছেড়েছেন।
মূল পরিকল্পনাকারী রনিকে গ্রেফতার করতে না পারলেও ডাচ বাংলা ব্যাংকের ২ কোটি ৫৭ লাখ টাকা আত্মসাতের ঘটনায় জড়িত অপর চারজনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এই চারজনকে ব্যবহার করেই মূলত টাকা হাতিয়ে নেওয়ার কাজটি সেরেছেন শাহারুজ্জামান রনি। এর জন্য ব্যবহার করা হয়েছে ৬৩৭টি অ্যাকাউন্ট।
যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে তারা হলেন- সায়মা আক্তার, আল-আমিন বাবু, মেহেদি হাসান মামুন ও আসাদুজ্জামান আসাদ। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের একটি টিম বিশেষ অভিযান চালিয়ে মঙ্গলবার (১৫ জুন) তাদের ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ জেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেফতার করে।
পুলিশ বলছে, রনি দীর্ঘদিন ধরে তার স্ত্রীসহ অন্য সহযোগীদের দিয়ে এটিএম বুথে লেনদেন করাতেন। লেনদেনের পর এটিএমের ইলেক্ট্রনিক জার্নাল এমনভাবে পরিবর্তন করে দিতেন যে টাকা তুলেও তথ্য সংরক্ষণ হতো ‘এটিএম থেকে টাকা উত্তোলন ব্যর্থ হয়েছে’ মর্মে।
এটিএম মনিটরিং রোস্টার টিমে কর্মরত অবস্থায় রনি নিজে উপস্থিত থেকে এবং কৌশলে বিভিন্ন এটিএমের ইলেকট্রনিক জার্নাল পরিবর্তন করে ১৩৬৩টি লেনদেনের মাধ্যমে ২ কোটি ৫৭ লাখ ১ হাজার টাকা আত্মসাৎ করে দেশ ত্যাগ করেন। তদন্তে রনির স্ত্রীর অ্যাকাউন্টে বিপুল পরিমাণ অর্থের সন্ধান পেয়েছে ডিবি পুলিশ।
আজ (বুধবার) ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরা হয়। সংবাদ সম্মেলনে গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার বলেন, কয়েকটি ধাপে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে।
প্রথম ধাপে ডাচ বাংলা ব্যাংকের কোনো অনুমোদিত এজেন্টের মাধ্যমে বহুল শ্রমিক সম্বলিত প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগাযোগ করে ওই প্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের স্যালারি/অন্যান্য অ্যাকাউন্ট খোলা হয়।
দ্বিতীয় ধাপে স্বাভাবিক নিয়মে অ্যাকাউন্ট তৈরি হওয়ার পর প্রতিটি অ্যাকাউন্টের বিপরীতে একটি করে এটিএম কার্ড গ্রাহকের কাছে পাঠানোর উদ্দেশ্যে সংশ্লিষ্ট এজেন্টের কাছে পাঠানো হয়।
এজেন্টের কাছে কার্ডগুলো পৌঁছানোর পর তৃতীয় ধাপে এই কার্ড গ্রাহকের কাছে না গিয়ে, টাকার বিনিময়ে পৌঁছায় অপরাধী চক্রের হাতে। গ্রাহক এ পর্যায়ে জানতেও পারেন না তার ডেবিট কার্ড হাতবদল হলো।
এ পর্যায়ে অ্যাকাউন্টগুলোতে মূলত কোনো অর্থ জমা থাকে না। চতুর্থ পর্যায়ে তাই অ্যাকাউন্টগুলোতে কিছু অর্থ জমা করা হয়।
টাকা জমা হয়ে যাওয়ার পরই শুরু হয় পঞ্চম ধাপের প্রক্রিয়া। আর এ ধাপেই ইলেক্ট্রনিক জার্নালে পরিবর্তনের কাজটা করে ফেলা হয়। এ ধাপে কাজ হয় দুটি অংশে। একটি অংশে সাধারণ গ্রাহকের মতো ওই অ্যাকাউন্টগুলো থেকে টাকা তুলতে রনির কোনো একজন সহযোগী এটিএম বুথে যান। তার সাথে আগে থেকেই শাহারুজ্জামান রনির (ব্যাংকের আইটি অফিসারের) যোগাযোগ থাকে। টাকা উত্তোলনের সময় এটিএম বুথ কর্তৃক অ্যাকাউন্টের বিপরীতে যে জার্নাল সৃষ্টি হয়, তা ডাচ-বাংলা ব্যাংকের জার্নাল সংরক্ষণ সার্ভারে যাওয়ার আগে রনি পরিবর্তন করে দেন।
পরবর্তী ধাপের কাজটি থাকে সার্ভার সংযোগ সাময়িক বিচ্ছিন্ন করার। এ কাজটি করা হয় টাকা তোলার ঠিক আগের মুহূর্তে। যে জার্নাল সংরক্ষণ সার্ভারের সাথে থার্ড পার্টি সফটওয়্যারের মাধ্যমে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এটিএম বুথগুলো পরিচালিত হয়, সেই সার্ভারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এ কাজটিও করেন রনি।
জার্নাল সংরক্ষণ সার্ভারের সাথে এটিএম বুথের থার্ড পার্টি সফটওয়্যারের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে এটিএম বুথের টাকা উত্তোলনের সময় যে জার্নাল সৃষ্টি হয়, তা জার্নাল সংরক্ষণ সার্ভারে জমা হয় না। এই সময়ের মধ্যেই প্রতিবার আরও একটি কাজ করেন রনি। সৃষ্ট জার্নালের বিভিন্ন পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘টাকা উত্তোলন সফল’ হওয়ার বার্তাকে ‘টাকা উত্তোলন ব্যর্থ’ হওয়ার বার্তায় পরিণত করেন। ফলে এই বার্তা পরবর্তীতে জার্নাল সার্ভারে গেলেও তা আর ‘সাকসেসফুল ম্যাসেজ’ হিসেবে গণ্য হয় না।
এ পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে এটিএম বুথ থেকে যিনি টাকা তুলতে গেলেন তিনি টাকা তুলে ফেললেও রনির কারসাজিতে ব্যাংকের হিসাবে তখনও তিনি টাকা তুলতে পারেননি। পরবর্তী ধাপে স্বাভাবিক গ্রাহকের মতো টাকা উত্তোলনকারী ব্যক্তি ব্যাংকের হট লাইনে ফোন করে অভিযোগ করেন- এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলতে যাওয়ার সময় তার ব্যালেন্স কেটে নেওয়া হয়েছে, কিন্তু মেশিন থেকে তিনি টাকা পাননি।
অভিযোগের প্রেক্ষিতে ব্যাংকের পক্ষ থেকে এর সত্যতা যাচাই করা হয়। ব্যাংকের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে দেখা হয়, কার্ডটি এটিএম বুথে প্রবেশ করানো হয়েছিল কি না এবং হয়ে থাকলে সৃষ্ট জার্নাল সাকসেসফুল কি না। এটি যাচাই করতে গিয়ে দেখা যায়- টাকা উত্তোলনের জন্য কার্ডটি এটিএমে প্রবেশ করানো হয়েছিল, কিন্তু জার্নালটি ‘আনসাকসেসফুল,’ তখন ওই অভিযোগের প্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট অ্যাকাউন্টে ব্যালেন্স সমন্বয় করে দেওয়া হয়। এর মধ্যে দিয়েই অ্যাকাউন্টগুলোতে চলে আসে টাকা।
শাহারুজ্জামান রনি ২০১৮ সাল থেকে অভিনব এই প্রতারণার কাজটি করছিলেন বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তা হাফিজ আক্তার।
এক পর্যায়ে ব্যালেন্সে অসামঞ্জস্যতার বিষয়টি অডিট টিমের নজরে আসে। তারা কয়েকজনকে সন্দেহের তালিকায় রেখে মামলা করেন। কিন্তু রনি ততদিনে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বর্তমানে তিনি দেশের বাইরে আছেন বলে জানান হাফিজ আক্তার।
জেইউ/এনএফ/জেএস