সীমান্ত ‘ম্যানেজ’ করে ভারতে ৫০০ নারী পাচার
সীমান্ত ম্যানেজ করে কাঁটা তারের বেড়া কেটে গত আট বছরে ৫০০ নারীকে ভারতে পাচার করেছে— এমন একটি চক্রকে গ্রেফতার করেছে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)। ভারতে পাচারের পর এসব নারীকে মাদক সেবনসহ নানাভাবে নির্যাতন করে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করা হতো। নারীপ্রতি তারা ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা পেত ভারতীয় দালালদের কাছ থেকে। এছাড়া মাসিক একটা কমিশনও পেত তারা।
মঙ্গলবার (১ জুন) সন্ধ্যায় র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে নারীপাচার চক্রের সদস্যদের সম্পর্কে এমন তথ্য দেন সংস্থাটির লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে বাংলাদেশি এক তরুণীকে বিবস্ত্র করে কয়েকজন যুবকের যৌন নির্যাতনের ভিডিও ভাইরালের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচিত হয়। ওই ঘটনায় ভুক্তভোগীর বাবা গত ২৭ মে হাতিরঝিল থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক নারীপাচার চক্রের অন্যতম হোতা আশরাফুল মন্ডল ওরফে বস রাফিসহ চার সদস্যকে গ্রেফতার করে র্যাব সদস্যরা।
চক্রের বাকি তিন সদস্য হলেন- বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী সাহিদা বেগম ওরফে ম্যাডাম সাহিদা (৪৬), মো. ইসমাইল সরদার (৩৮) ও মো. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ (২৬)।
দেশ থেকে ভারতে নারীপাচারের বিষয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, হাতিরঝিল থানায় ভুক্তভোগী ওই তরুণীর বাবা গত ২৭ মে মানবপাচার ও পর্নোগ্রাফি আইনে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় টিকটক হৃদয় বাবুসহ অজ্ঞাতনামা আরও চারজনকে আসামি করা হয়। বাংলাদেশি তরুণীকে নির্যাতনের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে ব্যাপক চাঞ্চল্য তৈরি হয়। পরবর্তীতে আরও কয়েকটি এ জাতীয় ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে র্যাব ওই ঘটনার ছায়া তদন্ত শুরু করে এবং জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করে। এর ধারাবাহিকতায় গত সোমবার (৩১ মে) থেকে মঙ্গলবার (১ জুন) পর্যন্ত র্যাব সদরদফতরের গোয়েন্দা ইউনিট ও র্যাব-৩ এর সদস্যদের অভিযানে ঝিনাইদহ সদর, যশোরের অভয়নগর ও বেনাপোল থেমে নারীপাচার চক্রের মূলহোতা মো. আশরাফুল ইসলাম ওরফে বস রাফিসহ চারজনকে গ্রেফতার করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ‘চক্রটি উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে নারীদের পাশের দেশে পাচার করতো। দেশি-বিদেশিসহ প্রায় ৫০ জন এ চক্রের সঙ্গে জড়িত বলে আমরা জানতে পেরেছি। টিকটক হৃদয় বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহার করে একটি গ্রুপ খোলে। ওই গ্রুপের মাধ্যমে বিভিন্ন বয়সের নারী ও তরুণীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে। সেখানে (গ্রুপ) যেসব তরুণী ছিল তাদের মডেল বানানোসহ ও বিভিন্ন চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে টিকটক হৃদয় আকৃষ্ট করতো। পরবর্তীতে পাশের দেশের বিভিন্ন সুপার মল, সুপার শপ ও বিউটি পার্লারে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তরুণী ও নারীদের বস রাফির সহযোগিতায় বিদেশে পাচার করতো। পাশের দেশে পাচারের পর প্রথমে একটি সেফ হাউজে নেওয়া হতো তাদের।’
তিনি আরও বলেন, সেফ হাউজে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অথবা জোর করে তাদের মাদক সেবনে বাধ্য করা হতো। মাদক সেবনের পর জোরপূর্বক যৌন নির্যাতন করে এসব ঘটনার ভিডিও ধারণ করা হতো। যাতে পরবর্তীতে তাদের ব্ল্যাকমেইল করা যায়।
জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতারদের দেওয়া তথ্য উল্লেখ করে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘ভিকটিমদের বৈধ বা অবৈধ উভয় পথে সীমান্ত অতিক্রম করানো হতো। তারা কয়েকটি ধাপে পাচারের কাজটি সম্পূর্ণ করতো। প্রথমত, ভিকটিমদের তারা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সীমান্তবর্তী জেলা যশোর, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহে আনতো। এরপর সীমান্তবর্তী বিভিন্ন সেফ হাউজে নিয়ে অবস্থান করতো। সেখান থেকে সুবিধাজনক সময়ে লাইনম্যানের মাধ্যমে অরক্ষিত এলাকা দিয়ে সীমান্ত অতিক্রম করতো। এরপর পাশের দেশের এজেন্টরা তাদের গ্রহণ করে সীমান্তের নিকটবর্তী সেফ হাউজে রাখত।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘সুবিধাজনক সময়ে কলকাতার সেফ হাউজে তাদের পাঠানো হতো। এর পরের ধাপে কলকাতা থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলের বেঙ্গালুরুতে পাঠানো হতো। বেঙ্গালুরু পৌঁছানোর পর গ্রেফতার বস রাফি তাদের গ্রহণ করে বিভিন্ন সেফ হাউজে অবস্থান করতো। পরে ব্ল্যাকমেইল ও মাদকাসক্তে অভ্যস্থকরণ, অমানবিক নির্যাতনের মাধ্যমে পতিতাবৃত্তিতে বাধ্য করানো হতো। সেফ হাউজগুলো থেকে তাদের ১০ থেকে ১৫ দিনের জন্য বিভিন্ন খদ্দেরের কাছে সরবরাহ করা হতো। এক্ষেত্রে পরিবহন ও খদ্দেরের নির্ধারিত স্থানে অবস্থানের জন্য বিশেষ নিরাপত্তা নেওয়া হতো। পাশের দেশের এজেন্ট তাকে (বস রাফি) খদ্দেরপ্রতি ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা কমিশন দিত। ক্ষেত্রবিশেষে নারীদের অর্থের বিনিময়ে বিক্রি করা হতো।’
র্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার রাফি আরও জানায়, ভারতে কিশোরগঞ্জের নির্যাতিত ওই নারী দুই বাংলাদেশি নারীকে দেশে পালিয়ে আসতে সহায়তা করে। এ কারণে তার ওপর নির্মম নির্যাতন চালানো হয়। তাকে হুমকি দেওয়া হয় যে, সেও যদি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে তাহলে ধারণ করা ভিডিও তার স্বজনদের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
চক্রের মূলহোতা বস রাফির পরিচয়
রাফি সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেফতার বস রাফির শিক্ষাগত যোগ্যতা অষ্টম শ্রেণি। আট বছর আগে থেকে ভারতের দক্ষিণাঞ্চলে তার গমনাগমন। সে সেখানে ট্যাক্সি ড্রাইভার, হোটেল বা রিসোর্ট কর্মচারী অথবা কাপড়ের ব্যবসা করতো। সে বিগত পাঁচ বছর ধরে নারী পাচারের সঙ্গে জড়িত। দুই বছর আগে টিকটকের মাধ্যমে হৃদয়ের সঙ্গে তার পরিচয়। সে টিকটক হৃদয়ের মাধ্যমে প্রায় অর্ধশতাধিক তরুণীকে পার্শ্ববর্তী দেশে পাচার করেছে। টিকটক হৃদয় ছাড়াও তার অন্যান্য এজেন্ট রয়েছে।’
তিনি বলেন, সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া ভিডিওর ভিকটিমকে পাচারের উদ্দেশ্যে টিকটক হৃদয়কে বস রাফি প্রলুব্ধ করে। পরে রাফি ভিকটিমকে টিকটক হৃদয়ের সাহায্যে গত বছরের অক্টোবর মাসে পাচার করে বেঙ্গালুরুতে আনে এবং সেফ হাউজে অবস্থান করে। সেখানে নির্যাতন করে ভিডিওটি ধারণ করা হয়।
কে এই ম্যাডাম সাহিদা
গ্রেফতার ম্যাডাম সাহিদা বস রাফির অন্যতম সহযোগী উল্লেখ করে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘গ্রেফতার বস রাফির অন্যতম নারী সহযোগী ম্যাডাম সাহিদা। তার একাধিক বিয়ে হয়েছিল। ম্যাডাম সাহিদা এবং তার দুই মেয়ে সোনিয়া ও তানিয়া পাচার চক্রের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও সক্রিয়ভাবে জড়িত। সোনিয়া ও তানিয়া বর্তমানে বেঙ্গালুরুতে অবস্থান করছে বলে গ্রেফতার সাহিদা জানায়। ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে তানিয়াকে সহযোগী হিসেবে দেখা গেছে। সাহিদা বাংলাদেশ এলাকায় একটি সেফ হাউজ পরিচালনা করতো। সেখানে নারী সংক্রান্ত বিভিন্ন অবৈধ কার্যক্রম চালানো হয়। অবৈধ এ ব্যবসায় সে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে জড়িত।
এছাড়া গ্রেফতার ইসমাইল ও মো. আব্দুর রহমান শেখ ওরফে আরমান শেখ মূলহোতা বস রাফির বিশেষ সহযোগী হিসেবে পাচার তদারকি করতো। তারাও নারীপাচারের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
গ্রেফতার ম্যাডাম সাহিদা সম্পর্কে র্যাবের এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘ম্যাডাম সাহিদা গত ১০ বছর ধরে ভারতে মানবপাচারকারী চক্রের সঙ্গে জড়িত। যশোরের সীমান্ত এলাকায় সাহিদার তত্ত্বাবধানে একটি সেফ হাউজ রয়েছে। এছাড়া বেনাপোল সীমান্তে বিভিন্নভাবে মানবপাচারে সহায়তা করেছে।’
সীমান্ত কীভাবে ম্যানেজ করে দালালরা
দালালরা সীমান্ত কীভাবে ম্যানেজ করে— এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাবের এ কমান্ডার বলেন, দালালরা বিভিন্নভাবে সীমান্ত ম্যানেজ করতো। তারা সুযোগের অপেক্ষায় থাকতো। সীমান্তে যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা শিথিল থাকতো তখন পাচারকারীরা কাজটি করতো। অনেক সময় কাঁটাতারের বেড়া কেটে ভারতে নারীদের পাচার করতো তারা।
রাফি দীর্ঘদিন কীভাবে ভারতে মানবপাচার করছে— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘গ্রেফতার বস রাফি গত আট বছর ধরে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে ছিলেন। প্রথমে সেখানে গিয়ে গাড়ির ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতেন। পরবর্তীতে রিসোর্টে চাকরি করেছেন। সে তামিল ভাষায় খুব দক্ষ৷ ভারতের ব্যাঙ্গালুরুর যেসব হোটেল-রিসোর্টে অবৈধ কার্যক্রম হতো সেখানকার লোকদের সঙ্গে রাফির ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। এটি কাজে লাগিয়ে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে গত আট বছরে ৫০০ নারী ও তরুণীকে রাফি ভারতে পাচার করেছে। প্রাথমিকভাবে এমন তথ্য পেয়েছি আমরা।’
কত টাকার বিনিময়ে ভারতে নারীদের পাচার করা হতো— জানতে চাইলে তিনি বলেন, মাত্র ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় পাচার করা হতো। এছাড়া মাসিক একটি কমিশনও পেত চক্রটি।
পাচারের জন্য কাদের টার্গেট করা হতো—জানতে চাইলে র্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, তারা মধ্যবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির নারী ও তরুণীদের টার্গেট করতো। ভারত থেকে দুবাইয়ে ভালো চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে তাদের পাচার করা হতো। এছাড়া নিম্ন-মধ্যবিত্ত নারীদের ভারতে উচ্চ বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখানো হতো।
এমএসি/এমএআর