বিল্ডিং কোড-মহাপরিকল্পনা না মানলে নগরে ভূমিকম্প বিপর্যয় ডেকে আনবে

বিল্ডিং কোড ও মহাপরিকল্পনা অনুসরণ না করলে নগরে ভূমিকম্প মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে বলে মনে করছে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)।
বিজ্ঞাপন
শনিবার (২৯ মার্চ) আইপিডির পরিচালক অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান এবং নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম এক যৌথ বিবৃতিতে এ কথা বলেন।
তারা বলেন, ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ বড়-মাঝারি-ছোট শহরগুলোই ভূমিকম্প দুর্যোগ মোকাবিলায় একেবারেই অপ্রস্তুত বলে মনে করে ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি)। শুক্রবারে মিয়ানমারে সংঘটিত ৭.৭ মাত্রার ভূমিকম্পজনিত ক্ষয়ক্ষতি ও আশপাশের দেশ ও অঞ্চলে তার সামগ্রিক প্রভাব আরও একবার বাংলাদেশের নগরগুলোর ভূমিকম্প প্রস্তুতি না থাকা এবং ভবন নির্মাণে ভবনগুলোর বিল্ডিং কোড এবং মহাপরিকল্পনা ও ভূমি ব্যবহার জোনিং না মানার প্রবণতার কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ছোট ছোট অনেকগুলো ভূমিকম্প বড় আকারের ভূমিকম্পের আসন্ন পূর্বাভাস দিলেও আমাদের প্রস্তুতি প্রায় শূন্য। ফলে যে কোনো সময় ভূমিকম্পে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ঘটার আগেই ভূমিকম্প ঝুঁকি কমাতে পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই যথাযথ উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে আইপিডি।
বিজ্ঞাপন
আরও পড়ুন
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে অনেকগুলো সংস্কার কমিশন করলেও দেশের পরিকল্পিত নগরায়ন, টেকসই আবাসন ও ভবনের নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ক কোনো কমিশন করেনি– বিষয়টিকে অনভিপ্রেত বলে মনে করে আইপিডি। বরং এটি আইপিডিসহ অনেকের কাছেই বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে যে আবাসন ব্যবসায়ীদের চাপে ঢাকা মহানগরীতে যত্রতত্র নির্বিচারে বহুতল ভবন বানানোর স্বেচ্ছাচারী কর্মকাণ্ডের অনুমোদন করার জন্য সাতজন উপদেষ্টাকে নিয়ে ড্যাপ সংশোধনের জন্য উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি গঠন করেছে। অথচ ভূমিকম্প কিংবা যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় এলাকা ভিত্তিক পার্ক-খেলার মাঠ-উদ্যান-উন্মুক্ত স্থান কীভাবে নগরে বাড়ানো যায়, সেই আলোচনা সরকারি মহলে কোথাও শোনা যাচ্ছে না। বরং কাঁঠালবাগান ও তৎসংলগ্ন এলাকার জন্য দুর্যোগের সময়ে ঠাঁই নেওয়ার একমাত্র খোলা জায়গা পান্থকুঞ্জ পার্ক রক্ষার্থে একশত দিনের সামাজিক আন্দোলনেও সরকার নির্লিপ্ত আচরণ করছে।
বিজ্ঞাপন
রাজউক এবং গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অনেকেরই বিরুদ্ধে আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বিভিন্ন আঁতাত করে দুর্নীতির মাধ্যমে যত্রতত্র অনুমোদনহীন ভবন গড়ে উঠতে দেওয়া এবং পরবর্তীতে মহাপরিকল্পনা সংশোধনের নামে সেই সব ভবন ও প্রকল্পের বৈধতা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার এই দুর্নীতিগ্রস্ত সিন্ডিকেটকে শনাক্ত করার এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। বরং এ চক্রের সঙ্গে আপস করবার মাধ্যমে রাজউক ও মন্ত্রণালয় ঢাকার বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা (ড্যাপ) ও ইমারত বিধিমালা সংশোধন করার সাম্প্রতিক যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো বাস্তবায়িত হলে ঢাকায় ভূমিকম্পে ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি আরও ব্যাপক হারে বাড়বে। সরু রাস্তায় বহুতল ভবন নির্মাণের অবাধ স্বাধীনতা কিংবা ১০তলা পর্যন্ত আবাসিক ভবনকে বহুতল বিবেচনা না করে কাঠামোগত ও অগ্নি নিরাপত্তায় ছাড় দেওয়ার উদ্যোগগুলো অত্যন্ত বিপদজনক। নাগরিক, পেশাজীবী ও পরিকল্পনাবিদদের পক্ষ থেকে এই বিষয়গুলোকে বারংবার তুলে ধরা হলেও রাজউক ও মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মানুষের জীবনের নিরাপত্তাকে উপেক্ষা করে আবাসন ব্যবসায়ীদের গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষায় অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মনে করছে আইপিডি।
আইপিডি আরও মনে করে, ঢাকার ভূমি ব্যবহার পরিকল্পনায় মাটির ভূতাত্ত্বিক গঠন ও গুণাগুণকে বিবেচনায় নিয়ে ভূমি ব্যবহার এবং ভবনের আকার-আয়তন নির্ধারণ করা প্রয়োজন। অথচ ঢাকার নগর পরিকল্পনায় এ বিষয়গুলোকে সেভাবে বিবেচনায় নিয়ে পরিকল্পনা করা হচ্ছে না। ঢাকার পূর্ব ও পশ্চিমাঞ্চলসহ ঢাকার চারিদিকে বন্যা প্রবাহ অঞ্চল ও জলাশয়-জলাভূমি ভরাট করে অধিকাংশ অনুমোদনহীন যেসব আবাসিক প্রকল্প গড়ে উঠেছে, সেখানে ইতোমধ্যেই অসংখ্য বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। দুর্বল মাটির ওপর গড়ে ওঠা এসব ভবনের ভূমিকম্প ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে তুরস্কের ভূমিকম্পেও এই প্রবণতা দেখা গেছে। ঢাকার ড্যাপে এলাকাভিত্তিক ভিন্নতাকে মাথায় নিয়ে ভবনের আকার-আয়তন নির্দিষ্ট করার প্রস্তাবনা থাকলেও ইমারত নির্মাণ বিধিমালার সংশোধন প্রস্তাবনায় মন্ত্রণালয় এলাকাভিত্তিক ভিন্নতাকে বাদ দিয়ে পুরো ঢাকা মহানগরীর জন্য একই ধরনের এফএআর বা ফার মান প্রস্তাব করেছে। পৃথিবীর কোন শহরের নগর পরিকল্পনায় এ ধরনের পরিকল্পনা ও নির্মাণ কৌশল না থাকলেও এভাবেই চলছে ঢাকার মতো অত্যন্ত অবাসযোগ্য ও ঝুঁকিপূর্ণ শহরের নগর পরিকল্পনা। এ ধরনের আত্ম-বিধ্বংসী প্রবণতা থেকে বের না হতে পারলে ঢাকার কাছাকাছি এপিসেন্টারে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্পেও জীবন ও সম্পদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আমাদের নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত আয়ের জনবসতির লোকজনের জন্যও এ ক্ষয়ক্ষতি ব্যাপক আকারে হতে পারে, যা হাইতির ভূমিকম্পে দেখা গিয়েছিল।
এএসএস/এসএসএইচ