বিচার প্রক্রিয়ায় দোষী সাব্যস্ত না হওয়ার আগে মিডিয়া ট্রায়াল নয়

বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া চূড়ান্ত প্রতিবেদনে এ সুপারিশ করেছে পুলিশ সংস্কার কমিশন।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো প্রায়শই গ্রেপ্তারের পর অভিযুক্ত ব্যক্তিকে গণমাধ্যমের সামনে এমনভাবে উপস্থাপন করে থাকে বা তাদের ছবি ও পরিচয় প্রচার করে থাকে এবং তথাকথিত জব্দ করা জিনিসপত্র সাজিয়ে রেখে এমনভাবে উপস্থাপন করে থাকে ও বর্ণনা তুলে ধরে, যাতে বিচারের আগেই সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সমাজের চোখে দোষী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যান। অনেক সময় অনেকের ক্ষেত্রে নানারকম আপত্তিকর বিশেষণও ব্যবহার হয়। এমন ক্ষেত্রে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দেওয়া হয় না। এতে যে সম্মানহানি ঘটে তা আর কোনো কিছুর দ্বারা পূরণ হয় না।
এমনকি, পরে আদালত কর্তৃক নির্দোষ প্রমাণিত হলেও তা পুনরুদ্ধার হয় না। ফলশ্রুতিতে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি এবং তার পরিবারকে পরবর্তীতে নানারকম অসম্মান ও অপমানের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। নারীদের জন্য এটা হয় আরও বিব্রতকর ও অপমানজনক। বিষয়টি কেবল মানহানিকরই নয়, মানবাধিকারেরও সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। এ ধরনের কর্মকাণ্ড বন্ধে বিভিন্ন সময়ে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও এগুলো এখনো পুরোপুরি বন্ধ হয়নি।
আরও পড়ুন
বাংলাদেশের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে নাগরিকদেরকে যেসব মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে, তন্মধ্যে ৩২ অনুচ্ছেদে আইনানুযায়ী ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি স্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত না করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে জীবনের অধিকার অর্থ সম্মানজনক জীবনকে বোঝানো হয়েছে। কিন্তু গ্রেপ্তার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের সময় অভিযুক্তকে যেভাবে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়, তা উক্ত বিধানের পরিপন্থি।
৩৫ অনুচ্ছেদে- কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রণা না দেয় কিংবা নিষ্ঠুর, অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দণ্ড না দেওয়া কিংবা কারও সঙ্গে অনুরূপ ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু গ্রেপ্তার পরবর্তী সময়ে গণমাধ্যমে উপস্থাপনের সময় অভিযুক্তকে যেভাবে অসম্মানজনকভাবে উপস্থাপন করা হয়, তাতে তার মানবিক মর্যাদা ভূলুণ্ঠিত হয়। ৩৫(৪) অনুচ্ছেদে- অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে নিজের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু অনেক সময় গ্রেপ্তার পরবর্তী সময়ে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে গণমাধ্যমে উপস্থাপন করে কৃত অপরাধের বিস্তারিত বর্ণনা দিতে বাধ্য করা হয়, যা উক্ত বিধানের পরিপন্থি।
বিচার করার এখতিয়ার কেবল আদালতের। যতক্ষণ পর্যন্ত উপযুক্ত আদালত কর্তৃক একজন অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচার প্রক্রিয়া শেষে সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে দোষী সাব্যস্ত না হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত চূড়ান্তভাবে বলা যায় না যে, তিনি প্রকৃত অপরাধী বা তার দ্বারাই অপরাধ সংঘটিত হয়েছে। তাই অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পরে বিচারের আগেই যদি পুলিশ মিডিয়ায় ঘোষণা দিয়ে বলে যে, তিনি অপরাধ করেছেন, তাহলে বিচারের প্রয়োজনীয়তা অর্থহীন হয়ে যায়।
কাজেই মৌলিক অধিকার লঙ্ঘন করে গণমাধ্যমের সামনে গ্রেপ্তার ব্যক্তিকে উপস্থাপনের সংস্কৃতি থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।
এ বিষয়ে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশ
বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা যাবে না।
জেইউ/এসএসএইচ