সেবার ‘মান নেই’, দামে ব্যস্ত ওয়াসা
করোনা মহামারির মধ্যে আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এতে ক্ষুব্ধ হয়েছেন নগরবাসী। তারা বলছেন, করোনাকালে এমনিতেই অসহায় অবস্থায় আছেন সাধারণ মানুষ। এর মধ্যে পানির দাম বাড়ানোর বিষয়টি সত্যিই অমানবিক। ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে পানির মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাব অযৌক্তিক। এটি গ্রাহকের ওপর এক ধরনের চাপিয়ে দেওয়া।
সোমবার (২৪ মে) ওয়াসার বোর্ড সভায় আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে প্রতি ইউনিট (এক হাজার লিটার) পানির দাম পাঁচ শতাংশ হারে বাড়ানো হয়েছে। যা কার্যকর হবে আগামী ১ জুলাই থেকে। এ সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে অংশ নেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান।
ওয়াসা সূত্র জানিয়েছে, দাম বাড়ানোর পর আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম বেড়ে দাঁড়াবে ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। বর্তমানে এক হাজার লিটার পানির দাম ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা করে দিতে হচ্ছে। অন্যদিকে, নতুন দাম কার্যকর হলে বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম দিতে হবে ৪২ টাকা। যা আগে দিতে হতো ৪০ টাকা।
ওয়াসার বোর্ড সভা সূত্রে জানা গেছে, ওয়াসার সর্বশেষ বোর্ড সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে অংশ নেন সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। ওয়াসার বোর্ড সভার সদস্য ১৩ জনের মধ্যে কয়েকজন মত দেন যে, সার্বিক বিবেচনায় এখনই পানির দাম বাড়ানো ঠিক হবে না। কিন্তু পানির দাম বাড়াতে শুরু থেকেই তাকসিম সবচেয়ে তৎপর ছিলেন। আইন অনুযায়ী প্রতিবছর পানির দাম বাড়ানো যায় এবং দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়াতে হবে এমন সব যুক্তিতে পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়।
করোনার শুরুর দিকে গত বছরের এপ্রিলেও এক দফা পানির দাম বাড়িয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। সে সময় প্রতি ইউনিটে দাম বাড়ানো হয়েছিল ২ টাকা ৮৯ পয়সা। এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে যখন করোনা আরও খারাপ রূপ ধারণ করছে, সে সময়ে এসে ফের পানির দাম বাড়িয়ে দিল ওয়াসা।
এই করোনাকালে পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘অনেক এলাকাতে মানুষ ওয়াসার পানি ঠিকমতো পায় না। নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের দিকে ওয়াসার কোনো নজর নেই। আবার অনেক এলাকাতে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধের অভিযোগ রয়েছেই। চলছে করোনাকাল, এতে অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে মানুষ। এ সময় এসে সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে ঢাকা ওয়াসা তাদের পানির দাম বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারল? তাদের সেবার মানে প্রায় সব গ্রাহক অসন্তুষ্ট, সেবার মান না বাড়িয়ে বছর বছর তারা পানির দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে। করোনাকালে অন্তত পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া ঠিক হয়নি।
এদিকে, পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্তকে অযৌক্তিক ও জনবিরোধী হিসেবে আখ্যা দিয়ে সিদ্ধান্তটি বাতিলের দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ)। বুধবার (২৬ মে) প্রেরিত এক বিবৃতিতে পার্টির চেয়ারম্যান জেবেল রহমান গানি ও মহাসচিব এম. গোলাম মোস্তফা ভুইয়া বলেন, ‘নগরবাসীকে নিরাপদ ও বিশুদ্ধ পানি দিতে পরিপূর্ণ ব্যর্থ ঢাকা ওয়াসা পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অনৈতিক ও জনবিরোধী। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ওয়াসার সরবরাহ করা পানি পান করা যায় না। রাজধানীতে ওয়াসার পানির বিল বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত বাতিল করতে হবে। পর্যাপ্ত পানির সরবরাহ ও সেবার মান না বাড়িয়ে ইচ্ছেমতো পানির মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।’
রাজধানী বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা মিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘প্রায় দেড় মাস ধরে আমাদের এলাকায় ওয়াসার পানি সরবরাহ ঠিক নেই। বেশিরভাগ সময়ই পানি পাওয়া যায় না। বাড়ির মালিকরা নিয়মিত ওয়াসার গাড়ি থেকে পানি কেনার পর আমাদের ব্যবহার করতে হচ্ছে। করোনা ও গত রজমান মাসেও আমরা পানি পাইনি। এ অবস্থার মধ্যেও ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ। প্রতিমাসে পানির বিল ঠিকই দেই, তাও পানি পাই না। করোনাকালে মানুষ অসহায় অবস্থায় আছে, কিন্তু এসব কিছু বিবেচনা না করে ওয়াসা তাদের পানির দাম বাড়িয়ে দিল। সাধারণ একজন নাগরিক হিসেবে ওয়াসার কাছে আবেদন জানিয়ে বলতে চাই, এই করোনার দুর্যোগের এ সময়ে অসহায় নগরবাসীর কথা বিবেচনা করে পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসুন।
এদিকে ওয়াসা বলছে, ঢাকা ওয়াসার এক হাজার লিটার পানির উৎপাদন খরচ ২৫ থেকে ২৮ টাকা। সে কারণে পানির দাম বাড়ানো জরুরি প্রয়োজন। এছাড়া মূল্যস্ফীতি সমন্বয় করতেও মূল্যবৃদ্ধি করা দরকার। ওয়াসা আইন ১৯৯৬ এর ২২ (২) ধারা অনুযায়ী ওয়াসা বোর্ড অনধিক পাঁচ শতাংশ হারে পানি ও পয়ঃঅভিকর সমন্বয় করতে পারে।
ওয়াসার এমন সিদ্ধান্তকে তুলে ধরে সমালোচনা করে বিভিন্ন গণমাধ্যম এ বিষয়ে প্রতিবেদনও প্রকাশ করে। এমন প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে ঢাকা ওয়াসার পক্ষ থেকে তাদের বক্তব্য জানিয়ে প্রতিবাদও জানানো হয়েছে।
ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের পক্ষে থেকে সংস্থাটির উপ-প্রধান জনতথ্য কর্মকর্তা এ এম মোস্তফা তারেক লিখিত বক্তব্যে বলেন, ‘বাৎসরিক মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পানির দাম সমন্বয় ওয়াসার একটি রুটিন প্রক্রিয়া। ঢাকা ওয়াসা আইন অনুযায়ী মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে পানির আংশিক সমন্বয় করেছে মাত্র। এছাড়া ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ঢাকা ওয়াসার পানির দাম বাড়ানো-কমানোর কোনো ক্ষমতা রাখে না। এটি সম্পূর্ণরূপে ওয়াসার আইন ১৯৬৬ মোতাবেক বোর্ডের এখতিয়ার। নগরবাসীর সুষ্ঠু টেকসই ও উন্নত গ্রাহক সেবা প্রদানের স্বার্থে ঢাকা ওয়াসা প্রতি বছরই এই প্রক্রিয়া অনুসরণ করে থাকে। ঢাকা ওয়াসা বর্তমানে ভর্তুকি দিয়ে নগরবাসীকে সেবা দিয়ে আসছে এবং প্রস্তাবিত সমন্বয়ের পরও সেটা অব্যাহত থাকবে।’
এএসএস/এফআর