নিয়োগ বিতর্ক : বারবার সিদ্ধান্ত বদল করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়

বিভিন্ন পদে নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের। সমালোচনার পর সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হচ্ছে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়টি। এতে প্রশাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা।
ছাত্র-জনতার বিক্ষোভের মুখে গত ৫ আগস্ট পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এরপরই পাল্টে যায় দৃশ্যপট। প্রশাসনে শুরু হয় ব্যাপক রদবদল। ইতোমধ্যে কয়েকটি নিয়োগ নিয়ে বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত বদল করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিতর্কের পর সিদ্ধান্ত বদলের এসব ঘটনা প্রশাসনেরই দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে যে, তারা সত্যিকার অর্থে যাচাই-বাছাই না করে নিয়োগগুলো দিচ্ছে। এজন্য প্রশাসনের ভাবমূর্তিও ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
ডিসি নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক
গত ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর দুই দিনে দেশের ৫৯ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এ পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ তুলে ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে হট্টগোল করেন নিজেদের বঞ্চিত দাবি করা উপসচিব পর্যায়ের একদল কর্মকর্তা। নিয়োগ পাওয়া বেশ কয়েকজন ডিসিকে নিয়েও আপত্তি জানান তারা।
বঞ্চিত কয়েকজন উপসচিবের অভিযোগ, ডিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়া বেশির ভাগ কর্মকর্তার আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা এবং সাবেক মন্ত্রীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ছিল। কয়েকজনের শেয়ারবাজারে মোটা অঙ্কের বিনিয়োগ রয়েছে। কারও কারও বিরুদ্ধে সহকর্মীকে হেনস্তা করার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া কয়েকজনের মাঠপ্রশাসনে কাজ করার অভিজ্ঞতা নেই।
১০ সেপ্টেম্বর দুপুরে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন যুগ্মসচিব কে এম আলী আযম ও জিয়াউদ্দিনের কক্ষে হট্টগোল করেন ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তারা। বিকেল ৩টা থেকে তারা এ দুই যুগ্মসচিবের কক্ষ অবরুদ্ধ করে রাখেন। কর্মকর্তাদের রোষ থেকে নিজেকে বাঁচাতে যুগ্মসচিব আলী আযম পাশের রুমের টয়লেটে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেন। প্রায় দুই ঘণ্টা পর সিনিয়র কর্মকর্তারা সেখানে গিয়ে তাকে বের করে আনেন।
ওই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নতুন নিয়োগ পাওয়া ৫৯ জন ডিসির মধ্যে গত ১২ সেপ্টেম্বর নয়জনের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। একই সঙ্গে চার জেলার ডিসি পদে রদবদল আনা হয়। এরপর খালি হওয়া পদে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
এক দিনের মাথায় খাদ্য সচিব ইলাহী দাদ খানের নিয়োগ বাতিল
নিয়োগের এক দিনের মাথায় গত ১ অক্টোবর খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ইলাহী দাদ খানের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এর আগের দিন অর্থাৎ ৩০ সেপ্টেম্বর এ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয় বিসিএস খাদ্য ক্যাডারের অবসরপ্রাপ্ত এ কর্মকর্তাকে।
তাকে দুই বছরের জন্য নিয়োগ দিয়ে ওই দিন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হলেও বিতর্কের মুখে পরের দিন তা বাতিল করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইলাহী দাদ খান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) একটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি।
২০২৩ সালের ২৬ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের জেলা ম্যাজিস্ট্রেসি নীতি শাখার চিঠিতে বলা হয়, ইলাহী দাদ খানের কর্মকাণ্ড দণ্ডবিধি ৪১৮/৪২০/৪৭৭(ক) ও ১০৯ ধারা এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারায় অপরাধযোগ্য। চিঠিতে খাদ্য মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়। এরপর তিনি অবসরে যান।
৪৩তম বিসিএসে বাদ পড়া নিয়ে বিতর্ক
৪৩তম বিসিএস থেকে দুই হাজার ১৬৩ জনকে ক্যাডার পদে নিয়োগের জন্য ২০২৩ সালের ২৬ ডিসেম্বর সুপারিশ করেছিল সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। সুপারিশের দীর্ঘ ১০ মাস পর এ বিসিএস থেকে নিয়োগ দিয়ে প্রথমে ১৫ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। সেই প্রজ্ঞাপন বাতিল করে গত ৩০ ডিসেম্বর নতুন প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। এতে বিভিন্ন ক্যাডারে বাদ পড়েন ১৬৮ চাকরিপ্রার্থী। এর আগে ১৫ অক্টোবরের প্রজ্ঞাপনে বিভিন্ন ক্যাডারে বাদ পড়েছিলেন ৯৯ জন। সবমিলিয়ে ৪৩তম বিসিএস থেকে মোট বাদ পড়েন ২৬৭ জন।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন থেকে বাদ পড়া প্রার্থীরা গত ১ জানুয়ারি সচিবালয়ের সামনে অবস্থান নেন। সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সুপারিশ পাওয়ার পর দ্বিতীয় প্রজ্ঞাপনে তারা কেন বাদ পড়েছেন তা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা। এ ছাড়া প্রজ্ঞাপনে আবারও অন্তর্ভুক্তির দাবি জানান তারা।
এ বিষয়ে ব্যাখ্যাও দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে ২২৭ জন এবং স্বাস্থ্য পরীক্ষায় অনুপস্থিত থাকায় ৪০ জনকে বাদ দেওয়া হয়।
তবে, বাদ পড়াদের পুনর্বিবেচনার আবেদন করার সুযোগ দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। তাদের আবেদন নিয়ে গত ৯ জানুয়ারি সচিবালয়ে সভাও করা হয়। সভা শেষে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান জানান, গুরুতর অপরাধ ছাড়া বাদ পড়া বাকিরা নিয়োগ পাচ্ছেন।
আরও পড়ুন
বিতর্ক ওঠায় পিএসসির ৬ সদস্যের নিয়োগ বাতিল
বিতর্ক ওঠায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) ছয় সদস্যের নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ১৩ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ বাতিল করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
নিয়োগ বাতিল হওয়া পিএসসির সদস্যরা হলেন– অধ্যাপক ডা. সৈয়দা শাহিনা সোবহান, সাব্বির আহমেদ চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এ এফ জগলুল আহমেদ, মো. মুনির হোসেন, অধ্যাপক ড. শাহনাজ সরকার ও ড. মো. মিজানুর রহমান।
জানা গেছে, গত ২ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে তিনজনের নিয়োগ নিয়ে বিতর্ক ওঠে। তারা আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বলে সমালোচনা হয়। ১২ জানুয়ারি বিতর্কিত তিন সদস্যের নিয়োগ বাতিলের জন্য কর্তৃপক্ষকে ২৪ ঘণ্টার সময়ও বেঁধে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষার্থী।
এর মধ্যে ডা. শাহিনা সোবহানের বাবা জামালপুর-৫ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য। আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে তিনি এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। এ ছাড়া ডা. শাহিনা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বান্ধবী।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এ এফ জগলুল আহমেদ ডিজিএফআইয়ের সাবেক ডিজি। ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত তিনি এ পদে দায়িত্বপালন করেন। তার সময়ে ‘আয়নাঘরে’ অনেকেই বন্দি ছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এ ছাড়া ড. মো. মিজানুর বিসিএস ৮৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা। তিনি আওয়ামী লীগের সময়ে বিয়াম ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।
প্রশাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে : ফিরোজ মিয়া
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ ফিরোজ মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘এটি প্রশাসনের জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক। প্রশাসনের দুর্বলতা প্রকাশ পাচ্ছে যে, তারা সত্যিকারের যাচাই-বাছাই না করে নিয়োগগুলো দিচ্ছে। যে দক্ষতা দেখানোর দরকার ছিল হয়তা সে দক্ষতা দেখাতে পারেনি। এজন্য প্রশাসনের ভাবমূর্তি খুবই খারাপ হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আন্দোলন করলেই ঢালাওভাবে নিয়োগ বাতিল করা যাবে না। কারণ, সবাই যে খারাপ তা তো ঠিক না। নিয়োগের ক্ষেত্রে যে কমিটি (ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বদলি, শৃঙ্খলা ও নিয়োগের ক্ষেত্রে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি) করা হয়েছে এটি কাজের গতিকে মন্থর করবে। এসব কাজে যোগ্য ও দক্ষ কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিলেই এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।’
এসএইচআর/এসএসএইচ