মারধরের শিকার কে এই ওসি নেজাম?
চট্টগ্রাম নগরের আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা মোহাম্মদ নেজাম উদ্দিন। নগরের সদরঘাট, বাকলিয়া ঘুরে ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থানা’ কোতোয়ালির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ছিলেন তিনি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জেলা পুলিশের আওতাধীন পটিয়া থানার ওসি ছিলেন নেজাম। ওই সময় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার অভিযোগে তাকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর থেকে কুমিল্লায় পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) কর্মরত।
পুলিশের অত্যন্ত প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন নেজাম উদ্দিন। ছাত্রজীবনে শিবিরের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার তকমা ছিল তার বিরুদ্ধে। যদিও পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে দায়িত্ব পালনকালে বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীদের ওপর নিপীড়নের অভিযোগও রয়েছে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বাদ দিলে অপরাধ দমনে ওসি নেজামের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। এ ছাড়া হত্যা, ছিনতাই, ডাকাতিসহ চাঞ্চল্যকর ক্লুলেস মামলার রহস্য উন্মোচনে নেজামের দক্ষতা পুলিশ বিভাগে বেশ আলোচিত।
গত ৬ জানুয়ারি নগরের পাঁচলাইশ থানা এলাকায় স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মী পরিচয়ে নেজাম উদ্দিনের ওপর হামলা করে একদল লোক। এ সংক্রান্ত একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে চট্টগ্রামজুড়ে আলোচনা চলছে। বিশেষ করে পুলিশ বিভাগেও এর প্রভাব পড়েছে।
এ ঘটনার পর থেকে আওয়ামী লীগের আমলে বিভিন্ন থানায় দায়িত্বপালনকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। কখন কোন দিক থেকে হামলার শিকার হন, সেটি ভেবে উৎকণ্ঠায় রয়েছেন তারা। আবার ওসি নেজামের ওপর হামলা আওয়ামী লীগের আমলে দলীয়ভাবে ব্যবহার হওয়া পুলিশ কর্মকর্তাদের জন্য নেতিবাচক বার্তা বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের নির্বাচনী এলাকা বাকলিয়া-কোতোয়ালী থানা। এই এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে তার বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ বিরোধীদের ওপর নির্যাতন ও হামলার অভিযোগ রয়েছে ওসি নেজামের বিরুদ্ধে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নেজাম ছিলেন বাকলিয়ার ওসি। ওই সময় নওফেলের হয়ে বিএনপির প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেনের জনসভায় হামলা ও বাধা দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। তৎকালীন সময়ে ডা. শাহাদাতের একটি জনসভায় বাধা দিতে গিয়ে ওসি নেজামের বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ার একটি ভিডিও সম্প্রতি ছড়িয়ে পড়েছে। এতে ওসি নেজামকে ডা. শাহাদাতের সঙ্গে উগ্র মেজাজে কথা বলতে দেখা যায়।
আরও পড়ুন
নগরের বাকলিয়া ও কোতোয়ালি এলাকায় দায়িত্ব পালনকালে শিবিরের মেসে-অফিসে অভিযানে নেতৃত্ব দেন নেজাম। এসব এলাকায় অবস্থিত বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের বাসায় অভিযান পরিচালনা এবং গ্রেপ্তারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া, বিএনপি-জামায়াতের মিছিল-সমাবেশে অকারণে হামলা ও সেখান থেকে নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার করে নির্যাতন করার অভিযোগ রয়েছে ওসি নেজামের বিরুদ্ধে।
২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার পূজা মণ্ডপে কোরআন রাখার জেরে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। ওই সময় ঘটনাটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং চট্টগ্রাম নগরের জেএমসেন পূজামণ্ডপে হামলার ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনার সময় কোতোয়ালি থানার ওসি ছিলেন নেজাম। এটি নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের দলের নেতাকর্মীদের ওপর চড়াও হওয়ার অভিযোগ রয়েছে ওসি নেজামের বিরুদ্ধে।
নগর পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, বিএনপি-জামায়াতের জোট সরকারের আমলে ২০০৪ সালে ক্যাডেট উপ-পরিদর্শক (এসআই) হিসেবে নিয়োগ পান নেজাম উদ্দিন। আওয়ামী লীগের আমলে ২০১৩ সালে পরিদর্শক পদে পদোন্নতি পান তিনি। ২০১৫ সালে তিনি আইজিপি পদক এবং ২০১৯ সালে প্রেসিডেন্ট পুলিশ মেডেল (পিপিএম-সেবা) পান তিনি। তার গ্রামের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলায়। ছাত্রশিবিরের নিয়ন্ত্রণে থাকাকালে নগরের মহসিন কলেজ থেকে অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করেন ওসি নেজাম। ২০২৩ সালে সরকারের দায়িত্বশীল একটি সংস্থার গোপনীয় অনুসন্ধানে নেজাম মহসিন কলেজে থাকাকালে শিবিরের 'সাথী পদে' ছিলেন বলে উল্লেখ করা হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশ সুপার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা জানান, কোতোয়ালি ও বাকলিয়ায় দায়িত্ব পালনকালে ওই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য ও শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের প্রতি একান্ত অনুগত থাকাটাই কাল হয়েছে ওসি নেজামের। ওই সময় আওয়ামী লীগ বিরোধী নেতাকর্মীদের চোখে পড়ে যান নেজাম। নওফেলের প্রশ্রয়ে নেজামের বেপরোয়া হয়ে যাওয়াটা ভালোভাবে নেননি তৎকালীন ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তারা। তাকে শিবির ট্যাগ দিয়ে ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন নওফেল। আবার নওফেলের অনুগত থেকে লাভও হয়েছে নেজামের। চকরিয়ার বড়ইতলী নিজ এলাকায় নওফেলের বদান্যতায় একটি মাদ্রাসা গড়ে তোলেন তিনি। নগরে পুলিশের মধ্যে প্রভাবশালী হয়ে যান নেজাম।
তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা বাদ দিলে নেজাম একজন দক্ষ অফিসার। চট্টগ্রামে বিভিন্ন ক্লুলেস ও চাঞ্চল্যকর মামলা তদন্তে ডাক পড়ত ওসি নেজামের। অপরাধ দমনেও নেজামের ভূমিকা প্রশংসনীয়। পুলিশের জুনিয়র কর্মকর্তা বিশেষ করে তরুণ এসআই ও পরিদর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় নেজাম। তার হাতে পুলিশিং শিখেছেন অনেক কর্মকর্তা। যারা বর্তমানে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত রয়েছেন। পরিদর্শক নেজামের ওপর হামলা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে পুলিশ উল্লেখযোগ্য কর্মকর্তাদের মধ্যে। বিশেষ করে যখন পুলিশ ৫ আগস্টের হামলার ট্রমা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করছে ঠিক সেই মুহূর্তে হামলার ঘটনা ঘটে নেজামের ওপর।
জানা গেছে, ওসি নেজামের স্ত্রী চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। কুমিল্লায় চাকরি হলেও নেজামের পরিবার থাকে চট্টগ্রামে। সোমবার ছেলেকে আনতে জাতিসংঘ পার্ক এলাকায় আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের পাশে অবস্থিত একটি বেসরকারি স্কুলে যান নেজাম। ওই সময় তাকে চিনে ফেলেন স্বেচ্ছাসেবক দলের কয়েকজন নেতাকর্মী। সেদিন দুপুরেই ওসি থাকাকালে নেজামের হাতে নির্যাতনের অভিযোগ তুলে কয়েকজন লোক তাকে ঘিরে ফেলেন।
সামাজিক মাধ্যমে সরাসরি প্রচার হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা শহীদ ভাইয়ের নামে সবাইকে জড়ো হতে বলা হচ্ছে। এরপর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় গালাগাল করা হচ্ছে ওসি নেজামকে। একজন নেজামকে উদ্দেশ্য করে বলেন, তোর জন্য আমি বাচ্চার মুখ দেখতে পারি নাই। তুই আমাদের নেতা শাহাদাত ভাইকে (চসিকের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন) লাঞ্ছিত করেছিস। তুই শেখ হাসিনার দোসর। এ সময় নেজামকে বলতে শোনা যায়— আমি শাহাদাত ভাইকে বাঁচিয়েছি। লাঞ্ছিত না করার জন্য তিনি বারবার স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতাকর্মীদের প্রতি অনুরোধ জানান। কিন্তু তা না শোনে নেজামকে চড়-থাপ্পড় দেওয়া হয়, তার পরনের কাপড়টি ছিঁড়ে ফেলা হয়। নেজাম তখনও আকুতি জানিয়ে বলেন, পুলিশে তাকে জামায়াত-শিবির তকমা দিয়ে কোণঠাসা করে রাখা হয়েছিল।
এদিকে, নেজামের ওপর হামলার খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থলে হাজির হয়। এরপর তাকে পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে যাওয়া হয়। পরবর্তীতে ওসি নেজামের হাতে নির্যাতনের শিকার লোকজন থানায় জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন এবং স্লোগান দিয়ে তার বিরুদ্ধে শাস্তি দাবি করেন।
পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ সোলাইমান মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুলিশ পরিদর্শক নেজামের বিরুদ্ধে কোনো থানায় মামলা নেই। তা ছাড়া আদালতে দায়ের হওয়া নালিশি মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। আইনানুযায়ী তদন্তাধীন এসব মামলায় কাউকে গ্রেপ্তার দেখানোর সুযোগ নেই। হামলায় আহত পরিদর্শক নেজামকে চট্রগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। খবর নিয়ে জেনেছি সুস্থ হওয়ার পর তিনি হাসপাতাল ছেড়েছেন।
তিনি আরও বলেন, পরিদর্শক নেজামের বিরুদ্ধে কেউ লিখিত অভিযোগ দেননি। এ ছাড়া হামলায় আহত নেজামও অভিযোগ দেননি।
অপরদিকে, পরিদর্শক নেজামের ওপর হামলার ঘটনাটি মঙ্গলবারও সিএমপির বিভিন্ন কক্ষে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল। এ সময় পুলিশ কর্মকর্তারা নেজামের ওপর হামলার ঘটনাটি নিয়ে বিশ্লেষণ করতে থাকেন। কী কারণে এই হামলা, এভাবে হলে পুলিশ কীভাবে দায়িত্ব পালন করবে তা নিয়ে উদ্বিগ্ন দেখা যায় পুলিশ কর্মকর্তাদের। বিষয়টি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের চট্টগ্রাম মহানগর শাখার নেতাকর্মীরাও। মঙ্গলবার হামলার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে শহীদুল ইসলাম শহীদ নামে এক নেতাকে বহিষ্কার করা হয়। শহীদ চকবাজার থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সদস্যসচিব।
পুলিশের পরিদর্শক পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, আওয়ামী লীগ দীর্ঘ ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে সরকারে থাকায় অনেক পুলিশ কর্মকর্তা দলীয় দাসে পরিণত হয়েছিল। কিন্তু বাচ্চার সামনে একজন পুলিশের কর্মকর্তাকে মারধর করা কোনোভাবেই উচিত হয়নি। এ দৃশ্য অনেকেই মানতে পারছেন না। তার অবশ্যই দোষ থাকতে পারে। তাকে পুলিশের হাতে সোপর্দ করা যেত। এটির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে পুলিশের মধ্যে।
জানতে চাইলে নগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক বেলায়েত হোসেন বুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশে সরকার আছে, আইন আছে। আমাদের কাউকে তো মানুষ ধরে থানায় দেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ঘটনাটি দলীয়ভাবে তদন্ত করা হবে। যারাই জড়িত থাকুক, তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ওসি নেজামের ওপর হামলার ঘটনার একটি নিউজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে শেয়ার করে আকরাম হোসেন রানা নামে এক সংবাদকর্মী লিখেন, কারো ওপর শারীরিক হেনস্তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। তবে এই ঘটনাটা একটা ‘শিক্ষা’ হতে পারে পুলিশ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের জন্য। পুলিশ আগে আওয়ামী লীগের পোষ্য সংস্থার মতো কাজ করতো, এখনও তারা একই ভূমিকায় আছে। আজকাল পুলিশ বিএনপি-জামায়াত আর হালের ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের কথায় ওঠাবসা করে। ক্ষমতার কাছাকাছি থাকা লোকজনের প্রেসক্রিপশনে নিরীহ লোকজনকে ধরে-বেঁধে মামলার আসামি করে। পুলিশ প্রশাসন ততদিন মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না, যতদিন ক্ষমতাসীনদের কর্তৃত্ব রুখে স্বতন্ত্র অবস্থান নিশ্চিত করতে না পারবে। কাজেই মেরুদণ্ড সোজা হয়ে থাকা ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প তাদের হাতে নেই।
এমআর/এমজে