দুর্নীতিকে প্রশ্রয় আর স্বজনপ্রীতিতে ডুবে ছিলেন আতিক
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পদত্যাগ করে শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার এক দিন আগেই আত্মগোপনে চলে গিয়েছিলেন ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম।
তারপর গোপন নথিপত্র সরিয়ে নিতে গত ১৮ আগস্ট রাতে ঢুকেছিলেন নগর ভবনে। কিন্তু দ্রুত ঘটনাটি জানাজানি হলে কর্মচারীরা জড়ো হন নগর ভবনে। শুরু করে বিক্ষোভ। উপায়ান্তর না দেখে পালিয়ে যান পেছনের সিঁড়ি দিয়ে। এরপর থেকে লোকচক্ষুর আড়ালেই ছিলেন তিনি। নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন অন্যদের কাছ থেকে। কিন্তু তাতেও শেষ রক্ষা হলো না শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেন তিনি।
দীর্ঘ সময় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালন করার সময় নানা দুর্নীতিতে তার প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ উঠে এসেছে। পাশাপাশি ভাতিজা-ভাগিনাসহ আত্মীয়-স্বজনকে নিয়ে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনকে (ডিএনসিসি) পরিবারিক একটি সিন্ডিকেটে পরিণত করেছিলেন সদ্য সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। ডিএনসিসির ছোট-বড় সব খাত থেকে অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ লুটপাট এবং দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তার বিরুদ্ধে। পাশাপাশি দীর্ঘসময় মেয়র থাকাকালীন স্বজনপ্রীতিতে ডুবে ছিলেন আতিকুল ইসলাম।
বুধবার (১৬ অক্টোবর) রাজধানীর মহাখালী ডিওএইচএস এলাকা থেকে আতিকুল ইসলামকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মোহাম্মদপুর থানায় দায়ের করা পৃথক তিনটি হত্যা মামলায় তাকে আগেই আসামি করা হয়েছিল। গত ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন থানায় দায়ের হওয়া একাধিক মামলায়ও তার নাম রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পরও অফিসে এসেছিলেন সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম। তবে ১৮ আগস্ট রাতে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের (ডিএনসিসি) কার্যালয় থেকে সাবেক এ মেয়রের পালানোর একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়।
আতিকুল ইসলাম ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের উপনির্বাচনে প্রথম মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি পুনরায় মেয়র নির্বাচিত হন।
সরকার বদলের প্রেক্ষাপটে গত ১৯ আগস্ট দেশের ১২টি সিটি কর্পোরেশনের মেয়রকে অপসারণ করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। এ তালিকায় ছিলেন সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলামও। এর আগে ২০১৩-১৪ মেয়াদে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
আতিকুল ইসলাম উত্তর সিটির মেয়র থাকাকালীন সময়ে তার আত্মীয় চক্রের দাপট ছিল সংস্থাটিতে। ২০২২ সালে ৫ জন উপদেষ্টা নিয়োগ দেন আতিকুল ইসলাম। তাদের মধ্যে চারজন বিশেষজ্ঞ থাকলেও নিজের বড় ভাইয়ের ছেলে ইমরান আহমেদ কোনো বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। পারিবারিক সদস্য হওয়ার কারণে তিনি হয়ে যান মেয়রের উপদেষ্টা। এছাড়া উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সরাসরি নিয়োগ না দিলেও মেয়রের মেয়ে বুশরা আফরিন ‘চিফ হিট অফিসার’ নিয়োগ পাওয়ার পর ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি হয়। চিফ হিট অফিসারের পরামর্শে নগরীর বিভিন্ন আইল্যান্ডে কিছু গাছ লাগায় ডিএনসিসি। রাজধানীর কয়েকটি সড়কে গাড়ি থেকে ওপরের দিকে পানি ছিটিয়ে কৃত্রিম বৃষ্টি বলে চালিয়ে দেওয়া হয়। এই কৃত্রিম বৃষ্টির নামে অন্তত ২ কোটি টাকা খরচ দেখানো হয়েছে। আতিকের ভাতিজা মেয়রের উপদেষ্টা ও ভাগনে ছিলেন ঠিকাদার ও কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রক। ভাগনে তৌফিক ডিএনসিসিতে পরিচিত ছিলেন দ্বিতীয় মেয়র হিসেবে। তার দাপটে চুপসে থাকতে হতো কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে ২০২৩ সালের শুরুতে ডিএনসিসির ১৯তম বোর্ড সভায় বৃক্ষরোপণের জন্য শক্তি ফাউন্ডেশনের সঙ্গে একটি চুক্তি অনুমোদন করে ডিএনসিসি। ওই চুক্তির অধীনে সবুজায়ন এবং পরিবেশ উন্নয়নে নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করার কথা ছিল। পরে সবুজায়ন সংক্রান্ত আরও একটি প্রকল্প দেওয়া হয় ওই শক্তি ফাউন্ডেশনকেই। এই প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা এবং নির্বাহী পরিচালক হুমায়রা ইসলাম। তিনি আতিকুলের শ্যালিকা। ওই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তির মাধ্যমে এখানেও প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে আত্মীয় চক্রকে।
অন্যদিকে ঠিকাদারদের কাছ থেকে কমিশন, নিয়োগ, বদলি, বর্জ্য অপসারণ বাণিজ্যসহ ঘনিষ্ঠজনদের নিয়ে অনিয়ম, দুর্নীতিতে যুক্ত ছিল আতিকের আত্মীয় চক্র। মেয়রের ভাগিনা তৌফিকের মাধ্যমে ঠিকাদার ম্যানেজসহ সিটি কর্পোরেশনের প্রায় সব ধরনের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। ঠিকাদার ও কর্মচারী-কর্মকর্তারা তাকে দ্বিতীয় মেয়র হিসেবেই চিনতেন। অভিযোগ রয়েছে সাবেক মেয়র আতিকের আত্মীয় চক্রের নানা দুর্নীতি, অস্বাভাবিক হিসেবে অনুমোদন বা সহযোগিতা না করলে বদলি করে দেওয়া হতো কর্মকর্তাদের।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএনসিসির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এমন কোনো খাত নেই যেখানে দুর্নীতি লুটপাট হয়নি। সাবেক মেয়রের আত্মীয়রা দাপট দেখিয়ে জিম্মি করে রাখতেন কর্মকর্তাদের। সে সময় কেউ কোনো প্রতিবাদ বা কথা বলতে পারেননি। লুটপাটে সহযোগিতা না করলে বদলি ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের।
সিটি কর্পোরেশনের ইতিহাসে নজিরবিহীনভাবে জনগণের ট্যাক্স এবং সরকারের দান-অনুদানের কয়েকশ কোটি টাকা লোপাটের রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন আতিকের ছত্রছায়ায় তার সহযোগীরা। ২০২১ সালের ২৩ অক্টোবর ‘ঠিকানা রিসোর্ট’ এ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা সম্পর্কিত মতবিনিময় সভা করেন আতিকুল ইসলাম। ওই সভায় খরচ হয় ১০ লাখ টাকা।
উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রোগ্রামের নামে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমে টাকা তুলে নিতেন মেয়র আতিকের সহযোগীরা। যা পুরোটাই জানতেন মেয়র আতিক। কিন্তু তিনি এসব দুর্নীতি করার সুযোগ দিয়েছেন।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে আগের সব প্রথা ভেঙে প্রথমবারের মতো ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তা এবং পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে মুন্সীগঞ্জের একটি ব্যয়বহুল রিসোর্টে অনুষ্ঠিত হয় ডিএনসিসির বোর্ড সভা। সেখানে ডিএনসিসির সব কর্মকর্তা এবং তাদের পরিবারের সদস্যরা দুদিন অবস্থান করেন। ঢাকা থেকে যাতায়াত করা হয় এসি বাসে। সেখানে সব খরচ বাবদ সিটি কর্পোরেশনের তহবিল থেকে খরচ করা হয়েছে ৬৪ লাখ ৮১ হাজার ২৬৫ টাকা।
শুধু এই রিসোর্টে বোর্ড সভা বা বনভোজন নয়, জাতীয় শোক দিবস, মেট্রোরেল উদ্বোধনী অনুষ্ঠান, জেলহত্যা দিবসের আয়োজনের ব্যয়ের পুরোটাই দেখানো হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সমাজকল্যাণ ও বস্তি উন্নয়ন খাত থেকে। সংস্থাটি এসব খাতে সর্বমোট ব্যয় দেখিয়েছে ২ কোটি ৬৪ লাখ ৩৯ হাজার ২২৬ টাকা।
নথি থেকে জানা গেছে, ২০২২ সালের ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বনানী কবরস্থানে আগমন উপলক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন শুধু প্যান্ডেল, গেট, লাইট বাবদ খরচ দেখিয়েছে ৪৯ লাখ ১১ হাজার ৬৮০ টাকা।
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা ও পরিবারের সদস্যদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে খরচ দেখানো হয়েছে ৪০ লাখ ৩০ হাজার ৬৮১ টাকা, মেট্রোরেল উদ্বোধন অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের এলাকায় ব্র্যান্ডিং সংক্রান্ত কাজ বাবদ ব্যয় দেখানো হয়েছে ৪১ লাখ ২১ হাজার ৬০০ টাকা। এসব অনুষ্ঠানে অতিরিক্ত খরচ দেখিয়ে ভুয়া ভাউচার বানিয়ে বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়েছেন সাবেক মেয়র আতিকের ছত্রছায়ায় থাকা ব্যক্তিরা। এভাবেই দুর্নীতিকে প্রশ্রয় আর স্বজনপ্রীতিতে ডুবে ছিলেন সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম।
এএসএস/এসএম