আলাপ-আলোচনা হবে ‘খোলামনে’
► মূল ফোকাস অর্থনৈতিক সহযোগিতায়
► পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে আলোচনার সুযোগ
► গণতন্ত্র-মানবাধিকার নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত আলোচনা হবে
► আলোচনায় আসতে পারে দিল্লি প্রসঙ্গ
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম বারের মতো ঢাকা সফরে এসেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো একটি প্রতিনিধি দল। এই সফরে দুই দেশের মধ্যে বহুমাত্রিক সহযোগিতার বিষয়ে আলোচনা হবে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব পেতে পারে চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় সহযোগিতার বিষয়টি।
রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারকে যুক্তরাষ্ট্র যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরকে বাংলাদেশের জন্য বিশেষ সুযোগ হিসেবে দেখছেন যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির।
তিনি মনে করেন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, অর্থনৈতিক সংকট উত্তরণে সহায়তা, বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ফেরত যেতে সরকারের পদক্ষেপ এবং এক্ষেত্রে ওয়াশিংটনের সহায়তা চাওয়ার সুযোগ হবে এ সফর।
আরও পড়ুন
বর্তমানে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের (বিইআই) সভাপতির দায়িত্বে থাকা সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধি দলের সফরের বিষয়ে ঢাকা পোস্টকে বলেন, এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সফর হবে। কারণ, আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে এ সরকার গঠিত হয়েছে। বাইরের পৃথিবীর লোকজন কিন্তু বুঝতে পারছে না এটা কী করে হলো। আমাদের কাজ হবে মার্কিন দলকে বোঝানো, বাস্তব অবস্থাটা আসলে কী। গত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াটা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সেটি তুলে ধরার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা কী ছিল এবং পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা কী কী আশা করতে পারে, এটা উপস্থাপন করা জরুরি এবং এই সফর এর জন্য ভালো সুযোগ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা রোববার (১৫ সেপ্টেম্বর) অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন এবং অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। পরে তারা পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে অংশ নেবেন। ওইদিন বিকেলে প্রতিনিধি দলের প্রধান ব্রেন্ট নেইম্যান বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের সঙ্গে বৈঠক করবেন।
প্রতিনিধি দলের নেতা ব্রেন্ট নেইম্যান যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি। যেহেতু দলনেতা মার্কিন রাজস্ব দপ্তরের সেক্ষেত্রে এবারের সফরে মূল আলোচনার ফোকাস হবে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা।
আরও পড়ুন
অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে কীভাবে সহযোগিতা করতে পারে এমন প্রশ্নে বিশ্লেষক হুমায়ুন কবিবের ভাষ্য, আমরা একটা অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আছি এখন। এটা থেকে উত্তরণে আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক সমর্থন প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্র বলতে, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবির কাছে আমরা ৫ বিলিয়ন ডলার চেয়েছি, সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একটা গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। যেটা আমাদের খাদে পড়া অর্থনীতিকে তুলে আনতে সহায়তা করবে।
মার্কিন ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের ব্যাংকিং খাত সংস্কার, মুদ্রা ব্যবস্থাপনা, আর্থিক খাতে নজরদারিতে বিশেষায়িত জ্ঞান রয়েছে। এসব বিষয়ে মার্কিনিদের কাছ থেকে কীভাবে সুবিধা পেতে পারে বাংলাদেশ এমন প্রশ্নে সাবেক কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, বিপুল পরিমাণ অর্থ বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে গেছে। সেই অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খুব গুরত্বপূর্ণ একটা ভূমিকা পালন করতে পারে এবং এটা আমাদের জন্য এই মুহূর্তে খুব জরুরি। অর্থনীতিকে কেন্দ্র করে যে দুর্নীতির উৎসব হয়েছে সেগুলোকে প্রতিরোধ বা প্রতিকার করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র কিন্তু অনেকদিন ধরে বলে আসছে। এখন আবার তাদের কাছে সরাসরি বলতে হবে, আমরা তোমাদের সহযোগিতা চাই। আর এটাই মোক্ষম সময়।
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র, নির্বাচন ও সুশাসন নিয়ে বারবার প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষ করে, দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগে বেশ সরব অবস্থানের জানান দেয় ওয়াশিংটন। তবে তাতে গুরুত্ব দেয়নি শেখ হাসিনা সরকার। আর এতে করে ঢাকা ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক যেমন তলানিতে গিয়েছে তেমনি ভিসা নীতির মতো কিছু শাস্তিও পেতে হয়েছে বাংলাদেশকে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়েছে। শেখ হাসিনার পতনের তিন দিনের মাথায় ড. ইউনূসের নেতৃত্ব অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। নতুন সরকার গঠনের পর দ্রুত সময়ের মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অভিনন্দন জানিয়েছে। পাশাপাশি দেশ গঠনে ড. ইউনূসকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে। আর ইউনূস সরকারও দায়িত্ব নেওয়ার পর মানবাধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলোতে তাদের অগ্রাধিকারের কথা বলছে।
গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো বিষয়গুলো নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার উৎসাহের সঙ্গে মার্কিন প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করবে বলে ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
এই ইস্যুতে আলোচনার বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, বিগত ১৫ বছর ধরে বাংলাদেশে কত উপায়ে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে, সেগুলো আমাদের দিক থেকে তুলে আনতে হবে। সর্বশেষ, যেভাবে পাখির মতো মানুষ মারা হয়েছে, এ বিষয়গুলো তাদের সামনে তুলে আনতে হবে। এতে তাদের পক্ষে ঘটনার গভীরতা উপলব্ধি করা সহজ হবে। আমাদের বোঝাতে হবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের গভীরতা কতটা ছিল।
হুমায়ুন কবির বলেন, আমরা একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার দিকে ফেরত যাব এবং এর জন্য যে সংস্কারগুলো হাতে নেওয়া হয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা ছয়টা কমিশন করে দিয়েছেন, আমাদের মোটামুটি একটা কাঠামো দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রেও আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে সহযোগিতা চাইতে পারি এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা আমাদের এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনর্নির্মাণে সহায়তা করতে পারে। কাজেই আমি মনে করব, গত কয়েকদিনের প্রেক্ষাপট এবং অবস্থা এবং ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা- এ বিষয়গুলো নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার এটা একটা উত্তম সুযোগ। আমি আশা করি, সরকারের দিক থেকে এই সুযোগটা ব্যবহার করা হবে।
এদিকে এই প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ডোনাল্ড লু ঢাকায় আসার আগে দিল্লি গিয়েছেন। এ নিয়ে বিশেষ কৌতূহল তৈরি হয়েছে। কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, ৫ আগস্টের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কে এক ধরনের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে দিল্লিতে অবস্থান করছেন। এমন পরিস্থিতিতে দিল্লিতে ভারতের সঙ্গে মার্কিন প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে নিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উঠছে।
ঢাকা-দিল্লি সম্পর্কের অস্বস্তি এবং এক্ষেত্রে ওয়াশিংটন বরফ গলানোয় কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে কি না— জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবির বলেন, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করার ইচ্ছা আমাদের নেই। আমরা তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে চাই। তারা তাদের নীতিগত ব্যর্থতাটাকে আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছে। তারা এখানে মানুষের প্রত্যাশা ও চাহিদা বুঝতে পারেনি। এটা তাদের সমস্যা, এটা আমাদের সমস্যা নয়।
হুমায়ুন কবির বলেন, ভূ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা এমন কোনো নীতিগত অবস্থান এখনও নিইনি যাতে করে ব্যবস্থাটা কোনোভাবে নীতিগতভাবে প্রভাবিত হতে পারে। ভারতকে আমরা বলিনি আমরা তাদের সহযোগিতা করতে চাই না। ভারত তাদের ব্যর্থতাকে আমাদের ঘাড়ে চাপাতে চাইছে, সেটাও আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ব্যাখ্যা করতে পারি। যুক্তরাষ্ট্র বিষয়টা উপলব্ধি করতে পারলে প্রয়োজনে তারা ভারতকে বিষয়টা বোঝানোর চেষ্টা করবে।
উল্লেখ্য, আজ সকালে ঢাকায় পৌঁছায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজস্ব দপ্তরের ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি ব্রেন্ট নেইম্যানের নেতৃত্বে দেশটির উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু দিল্লি হয়ে বিকেলে ঢাকায় আসবেন।
এনআই/এমএ