খোঁজ নেই মেয়র-কাউন্সিলরদের, নাগরিক সেবার কী হবে?
জুলাই মাসে সরকার পদত্যাগের এক দফা দাবি আদায়ে ঢাকার রাজপথ দখলে নিয়েছিল ছাত্র-জনতা। পরে তা সরকার পতনের আন্দোলনে রূপ নিলে দেশজুড়ে সংঘাত আর তিন শতাধিক মানুষের মৃত্যুর মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন। এর আগে ও পরে আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী ও প্রশাসনের কর্মকর্তারা দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এখনও বিভিন্নভাবে দেশ ছাড়ার চেষ্টা করছেন অনেকে। বাকিরা দেশের বিভিন্ন স্থানে আত্মগোপনে রয়েছেন। যে তালিকা থেকে বাদ যাননি ঢাকার দুই দুই সিটি কর্পোরেশনের মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররাও।
ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন সূত্রে জানা গেছে, শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর থেকে মেয়র, প্যানেল মেয়র ও কাউন্সিলররা লাপাত্তা। তারা অফিস করছেন না, কারণ তারা সবাই আওয়ামী লীগ সমর্থক। ফলে দুই সিটির সেবা কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। দুই সিটির ১৭২ কাউন্সিলরের মধ্যে ১৮ জন বিএনপিপন্থি। ওই ১৮ জন ছাড়া অন্য কোনো কাউন্সিলর অফিস করছেন না।
তাপস দেশ ছাড়লেও জনসমাগম এড়িয়ে চলছেন আতিক
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম দেশ ছেড়ে যাননি। তবে তিনি অফিস করছেন না। দেশে নিরাপদ স্থানে অবস্থান নিয়েছেন। জনসমাগম বা সাধারণ মানুষের সামনে আসছেন না। এড়িয়ে চলছেন সবাইকে, লোকচক্ষুর আড়ালে রয়েছেন।
ডিএনসিসি মেয়র আতিকুল ইসলামের ঘনিষ্ঠ এক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, তিনি দেশ ছেড়ে কোথাও যাননি, দেশেই আছেন, নিরাপদে আছেন।
তিনি বলেন, মেয়র আতিকুল ইসলাম রাজনৈতিকভাবে এলেও মেয়র হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি। তিনি অন্যায়ভাবে কখনোই কারও ক্ষতি করেননি। সঠিকভাবে দায়িত্বপালন করেছেন। সব মিলিয়ে সবার কাছেই তার গ্রহণযোগ্যতা আছে, সে কারণে কারও রোষানলে তিনি পড়েননি। তবে তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে জনসম্মুখে আসছেন না, নিরাপদ স্থানে আছেন।
অন্যদিকে চলমান কোটা সংস্কার আন্দোলনে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে সিঙ্গাপুরে চলে গেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস। গত ৩ আগস্ট ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একটি ফ্লাইটে তিনি দেশ ছাড়েন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের এক কর্মকর্তা জানান, ঢাকা দক্ষিণের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বিমানের ফ্লাইটে একাই সিঙ্গাপুরে গেছেন। তার সঙ্গে পরিবারের কোনো সদস্য ছিলেন না।
প্রভাব পড়েছে সিটি কর্পোরেশনের পরিষেবায়
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের বেশিরভাগ কাউন্সিলর হয় দেশ ছেড়েছেন, নয়তো গা ঢাকা দিয়ে নিরাপদে অবস্থান করছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, দুই সিটির ১৭২ জন কাউন্সিলরের মধ্যে ১৫৪ জন গা ঢাকা দিয়েছেন। তারা কেউই অফিস করছেন না। ফলে নাগরিক সেবা নিতে এসে তাদের কার্যালয় থেকে ফিরে যাচ্ছেন সাধারণ নাগরিকরা। এ ছাড়া, মশক নিধণ কার্যক্রম, পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম ও অন্যান্য নাগরিক সেবা জাতীয় কাজগুলোতেও ছন্দপতন ঘটেছে। তবে দুই সিটির ১৮ জন বিএনপিপন্থি কাউন্সিলর তাদের কার্যক্রমগুলো পরিচালনার পাশাপাশি অফিসও করছেন।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২১ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হাবিব আহমেদ বলেন, জরুরি এক কাজের জন্য আমার নাগরিক সনদ প্রয়োজন। কিন্তু কাউন্সিলর অফিস বন্ধ, কাউন্সিলরের দেখা মিলছে না। ফলে আমি নাগরিক সনদ সংগ্রহ করতে পারছি না। এ ছাড়া, এলাকার অন্যান্য মানুষরাও বিভিন্ন সেবা নিতে এসে ফিরে যাচ্ছে।
অন্যদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকার সেগুনবাগিচার বাসিন্দা আশিকুর রহমান বলেন, শুনেছি দক্ষিণ সিটির বেশিরভাগ কাউন্সিলর পালিয়ে গেছে। তারা কেউ অফিস করছেন না। সেই প্রভাব পড়েছে সাধারণ মানুষের ওপর। কারণ, ঠিকমতো বর্জ্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে না। মনিটরিং করার করার জন্য কাউন্সিলরের দেখা নেই, উনারা লাপাত্তা। একইভাবে মশক নিধনের লোকদের দেখা নেই, মশার উৎপাত বেড়েছে, ওষুধ ছেটানো হচ্ছে না। কিন্তু সেই অভিযোগ জানানোর জন্য স্থানীয় কাউন্সিলরের দেখা মিলছে না।
তবে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে সংস্থাটির মুখপাত্র মকবুল হোসাইন ঢাকা পোস্টের কাছে দাবি করেন, ডিএনসিসির সব পরিষেবা কার্যক্রম চলমান আছে।
তিনি বলেন, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক মশক নিধন, বর্জ্য অপসারণ ও অন্যান্য উন্নয়ন কার্যক্রমসহ সব সেবামূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমরা সেবা কার্যক্রম পরিচালনায় তৎপর রয়েছি।
আরও পড়ুন
মেয়র-কাউন্সিলদের অনুপস্থিতিতে করণীয় কী, সিদ্ধান্ত নেবে নতুন সরকার
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মেয়র-কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে কিছু কিছু কাজ অবশ্যই বিঘ্নিত হচ্ছে। তবে নাগরিক সেবা কার্যক্রমসহ আমাদের রুটিন কাজ আমরা পরিচালনা করে যাচ্ছি।
সেবাগ্রহীতারা বলছেন, এখন ডেঙ্গুর মৌসুম। এ সময় মেয়র-কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে পূর্ব প্রস্তুতির কার্যক্রম পরিচালনা ব্যাহত হচ্ছে। এ ছাড়া নাগরিক সনদ, জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধনসহ ১৭ ধরনের সনদ ইস্যু করার কাজ করা যাচ্ছে না।
এমন পরিস্থিতিতে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মিজানুর রহমান কাউন্সিলরদের নিয়ে গত বৃহস্পতিবার একটি সভা ডাকেন। কিন্তু দক্ষিণ সিটির ৭৫ জন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের মধ্যে প্যানেল মেয়রসহ ৬৫ জনই উপস্থিত ছিলেন না। পরে তিনি বাকি ১০ কাউন্সিলর নিয়ে সভা করেন। সেখানে বর্জ্য অপসরণ, মশক নিধণ, সড়ক বাতিসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।
মিজানুর রহমান বলেন, মেয়র-কাউন্সিলরদের অনেকের সঙ্গেই যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। এই অবস্থায় আমরা নাগরিক সেবা ঠিক রাখতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, সড়ক বাতি, মশক নিধন কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করার জন্য কাজ শুরু করেছি।
ডিএনসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মীর খায়রুল আলম বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে চলা শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের ফলে আমাদের সড়ক বাতি, ফুটপাত ও রাস্তার ডিভাইডার ব্যাপকভাবে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সেগুলো সংস্কারের কাজ চলছে। মেয়র-কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতিতে আমাদের করণীয় কী হবে, সে বিষয়ে নতুন সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।
এএসএস/এমজে