দেশ ছাড়ার আগের কয়েক ঘণ্টা কেমন ছিল শেখ হাসিনার?
গত এক মাসের বেশি সময় ধরে চলা কোটাবিরোধী আন্দোলন যখন শেষ পর্যন্ত ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিলো তখনও বলপ্রয়োগ করে টিকে থাকতে চেয়েছিলেন শেখ হাসিনা সরকার। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার মাটি কামড়ে ক্ষমতা ধরে রাখা সম্ভব হলো না। যদিও তিনি সব রকম চেষ্টাই করেছিলেন। ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষণ-নির্যাতনের খড়গ চালাতে নির্দেশ দিয়েছেন। সোমবার (৫ আগস্ট) রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে দেশ ছাড়েন গত ১৫ বছর ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা শেখ হাসিনা।
সূত্রে জানা যায়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়করা দেশের মানুষকে ‘মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে গণভবন ঘেরাওয়ের ঘোষণা দেন। এরপর সোমবার সকালে প্রায় এক ঘণ্টা বিভিন্ন বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভৈঠক করেন এবং পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য চাপ দেন। তবে পরিস্থিতি যে একেবারেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে, সেটা তিনি কিছুতেই মানতে চাচ্ছিলেন না। পরে পরিবারের সদস্যরাসহ বোঝানোর পর পদত্যাগে রাজি হন। এরপর দ্রুততম সময়ে পদত্যাগ করে সামরিক হেলিকপ্টারে করে গোপনে বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা।
জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের বরাত দিয়ে এক প্রতিবেদনে শেখ হাসিনার ক্ষমতা ছাড়ার শেষ চার ঘণ্টার একটা বিবরণ পাওয়া গেছে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলা হয়ে বর্তমানে দিল্লিতে অবস্থান করছেন শেখ হাসিনা। সেখান থেকে তার যুক্তরাজ্য যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
প্রতিবেদনে বিভিন্ন বাহিনীর উচ্চপর্যায়ের একাধিক সূত্রে বরাতে উল্লেখ করা হয়, সকাল সাড়ে ১০টার দিকে তিন বাহিনীর প্রধান ও পুলিশের মহাপরিদর্শককে (আইজিপি) প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন গণভবনে ডাকা হয়। নিরাপত্তা বাহিনী কেন পরিস্থিতি সামাল দিতে পারছে না, সেটার জন্য ক্ষোভ প্রকাশ করেন। আন্দোলনকারীরা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁজোয়া যানে উঠে লাল রং দিয়ে দিচ্ছেন, সামরিক যানে পর্যন্ত উঠে পড়ছেন—এর পরও কেন তারা কঠোর হচ্ছে না, সেটা নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি। এ ছাড়া বিশ্বাস করে এই কর্মকর্তাদের শীর্ষ পদে বসিয়েছেন—সেটাও তিনি উল্লেখ করেন।
আরও পড়ুন
একপর্যায়ে শেখ হাসিনা আইজিপিকে দেখিয়ে বলেন, তারা (পুলিশ) তো ভালো করছে। তখন আইজিপি জানান, পরিস্থিতি যে পর্যায়ে গেছে, তাতে পুলিশের পক্ষেও আর বেশি সময় এ রকম কঠোর অবস্থান ধরে রাখা সম্ভব নয়।
ওই সময়ে শীর্ষ কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, বলপ্রয়োগ করে এই পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে না। কিন্তু শেখ হাসিনা সেটা মানতে চাচ্ছিলেন না। তখন কর্মকর্তারা শেখ রেহানার সঙ্গে আরেক কক্ষে আলোচনা করেন। তাঁকে পরিস্থিতি জানিয়ে শেখ হাসিনাকে বোঝাতে অনুরোধ করেন। শেখ রেহানা এরপর বড় বোন শেখ হাসিনার সঙ্গে আলোচনা করেন। কিন্তু তিনি ক্ষমতা ধরে রাখতে অনড় থাকেন। একপর্যায়ে বিদেশে থাকা সজীব ওয়াজেদ জয়ের সঙ্গেও ফোনে কথা বলেন একজন শীর্ষ কর্মকর্তা। এরপর জয় তাঁর মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর শেখ হাসিনা পদত্যাগে রাজি হন। তিনি তখন একটা ভাষণ রেকর্ড করতে চান জাতির উদ্দেশে প্রচারের জন্য।
ততক্ষণে গোয়েন্দা তথ্য আসে যে বিপুলসংখ্যক ছাত্র-জনতা শাহবাগ ও উত্তরা থেকে গণভবন অভিমুখে রওনা হয়েছে। দূরত্ব বিবেচনায় ৪৫ মিনিটের মধ্যে শাহবাগ থেকে গণভবনে আন্দোলনকারীরা চলে আসতে পারে বলে অনুমান করা হয়। ভাষণ রেকর্ড করতে দিলে গণভবন থেকে বের হওয়ার সময় না-ও পাওয়া যেতে পারে। এই বিবেচনায় শেখ হাসিনাকে ভাষণ রেকর্ডের সময় না দিয়ে ৪৫ মিনিট সময় বেঁধে দেওয়া হয়।
এরপর ছোট বোন রেহানাকে নিয়ে তেজগাঁওয়ের পুরোনো বিমানবন্দরে হেলিপ্যাডে আসেন শেখ হাসিনা। সেখানে তাদের কয়েকটি লাগেজ ওঠানো হয়। তারপর তারা বঙ্গভবনে যান। সেখানে পদত্যাগের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে বেলা আড়াইটার দিকে সামরিক হেলিকপ্টারে করে ছোট বোনসহ ভারতের উদ্দেশে উড্ডয়ন করেন শেখ হাসিনা।
জানা গেছে, হেলিকপ্টারটি ভারতের আকাশে প্রবেশের পর কিছুক্ষণ উড্ডয়ন করে। পরে আগরতলায় বিএসএফের একটা হেলিপ্যাডে অবতরণ করে। তারপর সেখান থেকে দিল্লি যান বলে ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর বের হয়েছে।
ভারতীয় গণমাধ্যমে এক প্রতিবেদনে বলা হয়, শেখ হাসিনা নয়াদিল্লির কাছের গাজিয়াবাদে (উত্তর প্রদেশ) ভারতীয় সেনাবাহিনীর হিন্দন বিমানঘাঁটিতে দেশটির স্থানীয় সময় ৫টা ৩৬ মিনিটে অবতরণ করেন। ভারতের সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা তাকে স্বাগত জানান। সেখান থেকে তিনি লন্ডনে যেতে পারেন বলে জানা গেছে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন এ বছরের ১১ জানুয়ারি। এর আগে ১৯৯৬ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদে নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ভোটে বিএনপি জয়ী হলে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলে যায়। তখন সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রী হন শেখ হাসিনা।