কল্যাণপুর হবে হাতিরঝিলের চেয়েও নান্দনিক, কাজ কতদূর?
ইটপাথর আর কংক্রিটের শহর রাজধানী ঢাকায় মানুষের বুক ভরে নিঃশ্বাস নেওয়ার জায়গা অনেক কম। যানজট, কর্মব্যস্ততা, আকাশছোঁয়া অট্টালিকায় যেন ঠিকমতো দেখা যায় না আকাশ। এমন পরিস্থিতিতে রাজধানীবাসী চায় জলাধারের সংস্পর্শে নিরিবিলি পরিবেশে বসে একটু বুক ভরে নিশ্বাস নিতে, যেখানে কানে আসে পাখির ডাক। কিন্তু হাতিরঝিল, রমনা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান আর গুটিকয়েক জায়গা ছাড়া এমন পরিবেশ নেই বললেই চলে।
তবে নগরবাসীর চাহিদাকে অগ্রাধিকার দিয়ে জলকেন্দ্রিক একটি পার্ক তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। এজন্য কল্যাণপুরের রিটেনশন পন্ড বা জলাধারকে হাতিরঝিলের মতো করে গড়ে তোলা হচ্ছে। এটি যেমন নগরবাসীর জন্য উল্লেখযোগ্য একটি বিনোদনকেন্দ্র হবে তেমনি রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতেও কাজ করবে। এর ৫৩ একর জায়গা ঘিরে গড়ে তোলা হবে হাইড্রো ইকোপার্ক বা জলকেন্দ্রিক ইকোপার্ক। এটি হবে পানির ওপর জলকেন্দ্রিক পার্ক।
জলাধারের ৫৩ একর জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে। মাটি খনন ও নকশা তৈরির কাজও সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি আশপাশের সব ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ লাখ ঘনফুট মাটি ও বর্জ্য অপসারণের কাজ করেছে ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ
রিটেনশন পন্ড আসলে কী?
১৯৮৯ সালে কল্যাণপুরে জলাধারের জন্য জায়গা অধিগ্রহণ করে ঢাকা ওয়াসা। অধিগ্রহণের পর এখানে করা হয় রিটেনশন পন্ড বা জলাধারা। এখানে মূলত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকার পানি এসে জমা হতো।
রাজধানীর মোহাম্মদপুর, আদাবর, শ্যামলী, ধানমন্ডি, মিরপুর ও কল্যাণপুরের বৃষ্টির পানি আগে এ জলাধারে এসে জমা হতো। কিন্তু সেখানে কাজ সঠিকভাবে না হওয়ায় বৃষ্টি হলেই এসব এলাকায় জলাবদ্ধতা লেগে থাকে। পদ্ধতি অনুযায়ী— এখানে জমে থাকা পানি পাম্প করে নদীতে ফেলা হতো। পরবর্তীতে এটির জায়গা ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে দখল হতে থাকে। ফলে রাজধানীতে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়।
এ অবস্থায় ২০২০ সালের শেষের দিকে ঢাকা ওয়াসা ১৩টি খাল ও জলাশয় ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করে। এগুলোর মালিকানা ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব পায় ডিএনসিসি। পরে জলাবদ্ধতা নিরসনে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করে সংস্থাটি। সর্বশেষ কল্যাণপুরের এ রিটেনশন পন্ডের ৫৩ একর জায়গার ওপর জলকেন্দ্রিক ইকোপার্ক বা হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন বলছে, জলাধারের ৫৩ একর জায়গা অবৈধ দখলমুক্ত করা হয়েছে। মাটি খনন ও নকশা তৈরির কাজও সম্পন্ন হয়েছে। পাশাপাশি আশপাশের সব ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৩০ লাখ ঘনফুট মাটি ও বর্জ্য অপসারণের কাজ করেছে ডিএনসিসির প্রকৌশল বিভাগ।
কেমন হবে এই জলকেন্দ্রিক ইকোপার্ক?
কল্যাণপুরের রিটেনশন পন্ড বা জলাধারকে হাতিরঝিলের মতো করে গড়ে তোলা হবে। এটি রাজধানীর জলাবদ্ধতা দূর করতেও কাজ করবে। এর ৫৩ একর জায়গা ঘিরে গড়ে তোলা হবে হাইড্রো ইকোপার্ক বা জলকেন্দ্রিক ইকোপার্ক। এই ইকোপার্কটি হবে পানির ওপরে। এখানে থাকবে হাঁটার রাস্তা, সাইকেল লেন, শিশুদের খেলার জায়গা, কৃষি উদ্যান, প্রজাপতি ও পাখির অভয়ারণ্য, জীববৈচিত্র্যময় দ্বীপসহ নানা আয়োজন।
এ প্রকল্পে মোট ১০টি অঞ্চল থাকবে। যার মধ্যে পাঁচটিতে থাকবে প্রকৃতির ছোঁয়া লাগানো পরিবেশ। যেখানে রাখা হবে প্রজাপতির উন্মুক্ত স্থান, জীববৈচিত্র্যময় দ্বীপ, পাখির আশ্রয়স্থল, জলজ পার্কসহ জলপথ। পর্যটকরা ১০টি অঞ্চলেই নৌযানে করে ঘুরতে পারবেন। ১৪টি পয়েন্ট দিয়ে এ হাইড্রো ইকোপার্কে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারবেন। দিতে হবে না কোনো প্রবেশ মূল্য। পানির ওপর এবং পাশ দিয়ে থাকবে হাঁটার রাস্তা ও সাইকেল লেন। তার পাশে থাকবে কৃষিজমি, কোল্ড স্টোরেজ, সৌর জল শোধনাগার।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, রিটেনশন পন্ডকেন্দ্রিক হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণ হলে রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতার পানি গিয়ে এখানে জমা হবে। পরে এগুলো পাম্প করে তুরাগ নদে ফেলা হবে। পাশাপাশি নগরবাসী হাতিরঝিলের চেয়েও নান্দনিক একটি হাইড্রো ইকোপার্ক পাবে।
কল্যাণপুর জলধারের বর্তমান অবস্থা কী?
কল্যাণপুরে রিটেনশন পন্ড বা জলাধারের জায়গায় হাইড্রো ইকোপার্ক গড়ে তোলা হবে। জলাধারের প্রায় ৫৩ একর জায়গা দীর্ঘদিন ধরে দখল অবস্থায় ছিল। গড়ে উঠেছিল অবৈধ বসতি ও স্থাপনা। যে কারণে রিটেনশন পন্ড জলাধার হিসেবে কাজ করতে পারছিল না। পরে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনা করে দখলদারদের উচ্ছেদ করে। একই সঙ্গে আশপাশের সব ময়লা-আবর্জনা অপসারণ করা হয়।
আরও পড়ুন
পরে সেখানে বেশ কিছুদিন ধরে কোনো কাজ না চলায় ফের নতুন করে রিটেনশন পন্ড দখল হচ্ছে। কিছু মানুষ নতুন করে অস্থায়ী বসতি নির্মাণ করেছে। আরেক পাশ ট্রাক স্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। আপাতত হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণের কাজ চলছে না। যদিও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে— দখলদার, অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ করা হয়েছে। খননের কাজ হয়েছে। বাকি কাজগুলো খুব শিগগিরই শুরু হবে।
জলাধারের পাশের এলাকায় বসবাসকারী স্থায়ী বাসিন্দা হাবিবুর রহমান বলেন, গত বছর এই এলাকায় অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ হয়েছে। পরে এখানে খননের কাজও করেছে তারা। কিন্তু বেশ কিছুদিন যাবত আর কাজ করতে দেখছি না। এই সুযোগে আবার নতুন করে অস্থায়ীভাবে স্থাপনা নির্মাণ করেছে অনেকে। এখানে যেসব কর্মীরা কাজ করে, তারা বলছে কয়েকদিনের মধ্যেই আবার নতুন করে কাজ শুরু করবে উত্তর সিটি কর্পোরেশন।
স্থানীয় আরেক বাসিন্দা নাসির উদ্দিন বলেন, প্রথমে দেখেছি সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে আশপাশের অবৈধ দখলদার ও স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়েছে। পরে ভেকু গাড়ি দিয়ে খালের মতো করে অনেকটা জায়গা তারা খনন করেছে, সেখানকার মাটি দিয়ে আশপাশের নিচু জায়গা ভরাট করেছে তারা। এরপর থেকে তেমনভাবে আর কোনো কাজ করতে দেখা যায়নি। এখন জায়গাটি এভাবেই পড়ে আছে।
সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে চিঠি চালাচালি
গাবতলী, কল্যাণপুরে রেগুলেটিং পন্ড সংলগ্ন বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের (বিএডিসি) প্রায় ১১৭ একর জায়গায় ভারী স্থাপনা নির্মাণ না করাসহ ড্যাপের নীতিমালা অনুযায়ী জায়গাটিকে পানি সংরক্ষণাগার হিসেবে বজায় রাখতে চিঠি দিয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি)। নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে গত বছর থেকে এই চিঠি চালাচালি শুরু হয়েছে।
একটি চিঠিতে বলা হয়েছে, জলাবদ্ধতা নিরসনে নগরীর সব খালসহ রেগুলেটিং পন্ডের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম চলমান রয়েছে। গাবতলী বেড়ীবাঁধ ও কল্যাণপুর রেগুলেটিং পন্ডসংলগ্ন বিএডিসির প্রায় ১১৭ একর জায়গা রয়েছে। এ জায়গা ড্যাপের নকশা অনুযায়ী ওয়াটার বডির আওতাভুক্ত রয়েছে। ওয়াটার বডির আওতাভুক্ত ভূমিতে রাজউক কর্তৃক ছাড়পত্র গ্রহণের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এ অবস্থায় বিএডিসির জমিতে ভারী স্থাপনা নির্মাণ করা হলে নগরীর জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে ডিএনসিসি কর্তৃক গৃহীত রেগুলেটিং পন্ডের চলমান উন্নয়নমূলক কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি হবে। নগরীর জলাবদ্ধতা দূরীকরণে জনস্বার্থে কল্যাণপুর রেগুলেটিং পণ্ড সংলগ্ন বিএডিসির জায়গায় ভারী স্থাপনা নির্মাণ হতে বিরত থাকা প্রয়োজন। তাই এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
ডিএনসিসি সূত্রে জানা গেছে, শহরের জলাবদ্ধতা নিরসন ও বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য গাবতলী বেড়িবাঁধের ৫২ একর জমিসহ কল্যাণপুর রেগুলেটিং পন্ডের প্রায় ৫৩ একর জায়গা ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের নিকট হস্তান্তর করা হয়েছে। ফলে এখানে সিটি কর্পোরেশনের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রায় ১০৫ একর জমি রয়েছে।
প্রকল্পে মোট ১০টি অঞ্চল থাকবে। যার মধ্যে পাঁচটিতে থাকবে প্রকৃতির ছোঁয়া লাগানো পরিবেশ। যেখানে রাখা হবে প্রজাপতির উন্মুক্ত স্থান, জীববৈচিত্র্যময় দ্বীপ, পাখির আশ্রয়স্থল, জলজ পার্কসহ জলপথ। পর্যটকরা ১০টি অঞ্চলেই নৌযানে করে ঘুরতে পারবেন। ১৪টি পয়েন্ট দিয়ে এ হাইড্রো ইকোপার্কে সাধারণ মানুষ প্রবেশ করতে পারবেন। দিতে হবে না কোনো প্রবেশ মূল্য। পানির ওপর এবং পাশ দিয়ে থাকবে হাঁটার রাস্তা ও সাইকেল লেন। তার পাশে থাকবে কৃষিজমি, কোল্ড স্টোরেজ, সৌর জল শোধনাগার
জাপানি পার্কের আদলে হবে হাইড্রো ইকোপার্ক
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মুখপাত্র মকবুল হোসাইন বলেন, কল্যাণপুরে রিটেনশন পন্ডটি দখলমুক্ত করা অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। যদিও আমরা ইতোমধ্যে এই কাজটি করে ফেলতে পেরেছি। খননের কাজ, বর্জ্য অপসারণের কাজ ইতোমধ্যে করা হয়েছে। তবে আরো কিছু কাজ বাকি রয়েছে। যদিও এখানে বেশ কিছু ইস্যু রয়েছে, সেগুলো সমাধান করেই আমরা কাজ করব। এটি জাপানি একটি পার্কের কনসেপ্ট থেকে নেওয়া হয়েছে। বর্তমানে যাচাই-বাছাই কাজ চলমান রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, সবকিছু যাচাই-বাছাইয়ের পর এখানে হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে। এটি নির্মাণ হলে শুধু পার্কই রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে। আশা করা যায় ইকোপার্ককেন্দ্রিক ওই অঞ্চলে আর জলাবদ্ধতা হবে না।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের প্রকৌশল বিভাগ থেকে জানা গেছে, রিটেনশন পন্ডকেন্দ্রিক হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণ হলে রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতার পানি গিয়ে এখানে জমা হবে। পরে এগুলো পাম্প করে তুরাগ নদে ফেলা হবে। ফলে রাজধানীর বড় একটি অংশে আর জলাবদ্ধতা হবে না। পাশাপাশি নগরবাসী হাতিরঝিলের মতো নান্দনিক একটি হাইড্রো ইকোপার্ক পাবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, এটি করতে গিয়ে আমাদের অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। তবে যত বাধাই আসুক কল্যাণপুরে জলকেন্দ্রিক হাইড্রো ইকোপার্ক নির্মাণ হবেই। ইতোমধ্যে আমরা খনন কাজ করেছি। অবৈধ দখলগুলো উচ্ছেদ করা হয়েছে। শিশু-বৃদ্ধ থেকে শুরু করে সব বয়সীদের জন্য জলনির্ভর এই ইকো পার্কটি নির্মাণ করা হবে।
তিনি আরও বলেন, এটি যেমন সাধারণ মানুষের বিনোদনকেন্দ্রে পরিণত হবে তেমনি রাজধানীর একটি বড় অংশের জলাবদ্ধতা নিরসন করবে। এ জলাধারে সব পানি গিয়ে জমা হবে, এরপর আমরা পাম্প করে পানি তুরাগ নদে পার করে দেব। এখানে আমরা সিটি ফরেস্ট করে তুলব। সবমিলিয়ে হাতিরঝিলের মতো কল্যাণপুরেও প্রকৃতি নির্ভর এই ইকোপার্ক আমরা নির্মাণ করতে চাই।
এএসএস/এমজে