চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে বঞ্চিত প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তা
জনপ্রশাসনের শীর্ষ দুই কর্মকর্তাসহ বর্তমানে ৮৩ সচিবের মধ্যে ১৮ জনই চুক্তিতে কর্মরত। এ ধরনের নিয়োগ নিয়ে খোদ কর্তাদের মধ্যেই অসন্তোষ রয়েছে। কারণ, একজন কর্মকর্তা চাকরির মেয়াদ শেষে অবসরে গেলে সেই পদ খালি হয়। ওই পদে নতুন একজন কর্মকর্তার পদোন্নতি বা পদায়ন হয়। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে বঞ্চিত হন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি কারও কাজ অপরিহার্য মনে করে, সেক্ষেত্রে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া স্বাভাবিক। তবে, ঢালাওভাবে নিয়োগ দেওয়া অনুচিত।
চুক্তিতে কারা কর্মরত
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন ও প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া— জনপ্রশাসনের এই শীর্ষ দুই কর্মকর্তা বর্তমানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন। এর মধ্যে মাহবুব হোসেন গত বছরের (২০২৩) ৩ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ সচিব হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করে গত বছরের ১৩ অক্টোবর থেকে অবসরে যাওয়ার কথা ছিল তার।
নিয়মানুযায়ী তাকে অবসর দিয়ে ওই বছরের ৩ অক্টোবর প্রজ্ঞাপনও জারি করেছিল জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর পৃথক আরেকটি প্রজ্ঞাপনে ১৪ অক্টোবর থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য তাকে এ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কথা জানানো হয়।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব থাকাকালে ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর মুখ্য সচিব হিসেবে নিয়োগ পান সিনিয়র সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। চাকরির স্বাভাবিক মেয়াদ শেষ করে গত বছরের (২০২৩) ৪ জুলাই তোফাজ্জল হোসেন মিয়ার অবসরে যাওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু ওই বছরের (২০২৩) ২৫ জুন তার অবসরোত্তর ছুটি এবং এ সংক্রান্ত সুবিধা স্থগিতের শর্তে ৫ জুলাই থেকে পরবর্তী এক বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়।
প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকের স্বপ্ন থাকে এক দিন সচিব হবেন, বড় মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পাবেন। কিন্তু বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে অনেকে সেই স্বপ্নপূরণ থেকে বঞ্চিত হন। এটি কাম্য নয়
এদিকে, আরও এক বছরের জন্য প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব হিসেবে ইতোমধ্যে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পেয়েছেন তোফাজ্জল হোসেন মিয়া। আগামী ৫ জুলাই অথবা যোগদানের তারিখ থেকে পরবর্তী এক বছর মেয়াদে এ পদে পুনরায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে গত বুধবার (২৬ জুন) জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়।
এ ছাড়া জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সিনিয়র সচিব) মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব এবং জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) শেখ ইউসুফ হারুন, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী চেয়ারম্যান (সিনিয়র সচিব) লোকমান হোসেন মিয়া, জাতীয় সংসদ সচিবালয়ের সিনিয়র সচিব কে এম আব্দুস সালাম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক (সিনিয়র সচিব) মো. আখতার হোসেন, পরিকল্পনা বিভাগের সিনিয়র সচিব সত্যজিত কর্মকার চুক্তিতে কর্মরত আছেন।
এ তালিকায় আরও আছেন— জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব) শাহাবুদ্দিন আহমদ, রাষ্ট্রপতির কার্যালয়ের জনবিভাগের সচিব মো. ওয়াহিদুল ইসলাম খান, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মোকাম্মল হোসেন, ইরাকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত (সচিব) মো. ফজলুল বারী, বিশ্ব ব্যাংকের বিকল্প নির্বাহী পরিচালক (লিয়েনে কর্মরত) বেগম শরিফা খান, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী, রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব ড. মো. হুমায়ুন কবীর, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব বেগম ওয়াহিদা আক্তার এবং বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিআইডিএ) নির্বাহী সদস্য (সচিব) মো. খাইরুল ইসলাম।
কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মানে একজন কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা। একটি পদ খালি হওয়ার পর আরেকজন কর্মকর্তা সেই পদে বসবেন, এটিই নিয়ম। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে ওই পদে আগের কর্মকর্তাই থেকে যাচ্ছেন। ফলে নতুন করে যার দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তিনি বঞ্চিত হলেন। এক সময় দেখা গেল তার নিজেরই চাকরির মেয়াদ শেষ। ফলে মনে কষ্ট নিয়ে তাকে সরকারি চাকরি থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিয়ে কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তোষ রয়েছে। সচিবালয়ে অবস্থিত একটি মন্ত্রণালয়ের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে ঢাকা পোস্টকে বলেন, প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পাওয়ার পর অনেকের স্বপ্ন থাকে এক দিন সচিব হবেন, বড় মন্ত্রণালয়ে দায়িত্ব পাবেন। কিন্তু বছরের পর বছর চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে অনেকে সে স্বপ্ন পূরণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এটি কাম্য নয়।
অপর কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মানে একজন কর্মকর্তাকে বঞ্চিত করা। একটি পদ খালি হওয়ার পর আরেকজন কর্মকর্তা সেই পদে বসবেন, এটাই নিয়ম। কিন্তু চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের কারণে ওই পদে আগের কর্মকর্তাই থেকে যাচ্ছেন। ফলে নতুন করে যার দায়িত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা ছিল তিনি কিন্তু বঞ্চিত হলেন। এক সময় দেখা গেল তার নিজেরই চাকরির মেয়াদ শেষ। ফলে মনে কষ্ট নিয়ে তাকে সরকারি চাকরি থেকে বিদায় নিতে হচ্ছে।
ঢালাওভাবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ উচিত নয়
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, তবে ঢালাওভাবে এমন নিয়োগ উচিত নয়। এটি করলে যোগ্য লোক তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হবেন।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, অবসরের সময় এলে অবসর নেওয়া স্বাভাবিক বিষয়। তবে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের বিষয়টিও প্রচলিত আছে। সরকার যদি কারও সার্ভিস অপরিহার্য মনে করে, এটি করতে পারে। তবে, ঢালাওভাবে নয়। এখন প্রশ্ন আসতে পারে, কোন ব্যক্তি অপরিহার্য সেটি কে নির্ধারণ করবে। এ জন্য নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষ থাকবে। সচিবদের ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী করবেন।
যা বলছেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
এ বিষয়ে জনপ্রশাসনমন্ত্রী মো. ফরহাদ হোসেন বলেন, আমাদের দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদ, সচিব-পদ শূন্য হয়। যেহেতু সামনে নির্বাচন এবং পদগুলো গুরুত্বপূর্ণ, সেখানে কিন্তু রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ চালিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। নির্বাচনের সময় আমাদের দেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডও চালাতে হয়। আবার একজন মন্ত্রী, তাকে কিন্তু তার নির্বাচনের জন্য কাজ করতে হয়। সেক্ষেত্রে আমাদের অনেক বিষয় থাকে।
“যিনি অভিজ্ঞ, দেশের জন্য তাকে কাজে লাগানোই ভালো। নির্বাচনের সময়টা যেহেতু খুব গুরুত্বপূর্ণ, তখন সচিবকে ‘এক্সট্রা অ্যাফোর্ড’ দিতে হয়। কারণ, মন্ত্রীরা তাদের নির্বাচনী এলাকায় নির্বাচনী কাজে সময় দেন। বিশেষ করে তিন মাস কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। সেসব বিবেচনায় নির্বাচনের আগে কয়েকটি পদে আমাদের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।”
মন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রী সবসময় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ নিরুৎসাহিত করেন। সেক্ষেত্রে আমরা এখন সাবধান হওয়ার চেষ্টা করছি। বর্তমানে যারা চুক্তিভিত্তিক নিয়োগে রয়েছেন তাদের চুক্তির মেয়াদ শেষে সেখানে নতুন অনেককে নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে।
‘আমরা এটি সবসময় নিরুৎসাহিত করি। প্রধানমন্ত্রীরও অনুশাসন আছে। কারণ, একজনকে নিয়োগ দিলে এক্ষেত্রে কিন্তু যার সুযোগ ছিল তিনি হয়তো বঞ্চিত হন। প্রধানমন্ত্রী সবসময় বিষয়টি খেয়াল রাখেন। বিশেষ কারণে ওই সময়ে আমাদের দিতে হয়েছিল, দেশের স্বার্থে ও কল্যাণে কাজগুলো এগিয়ে নেওয়ার জন্য।’
এসএইচআর/এমএ/এমএআর/