যে কারণে স্বামীকেই ‘খুনি’ বলছে পুলিশ, অকাট্য প্রমাণের অপেক্ষা
আগের বিয়ের তথ্য গোপন করায় পারিবারিক ও দাম্পত্য কলহ তৈরি হয়। সেই থেকে আলাদা বাসায় থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে গোপনে যোগাযোগ ছিল। তবে সেটি জানত না দুজনের পরিবার। তাদের গোপন মেলামেশাতেও কমেনি দাম্পত্য কলহ। এর জেরেই চিকিৎসক কাজী সাবিরা রহমানকে স্বামী এ কে সামছুদ্দিন আজাদ খুন করেছেন বলে মনে করছে পুলিশ।
এ সংক্রান্ত বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে বলে দাবি করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। তবে ঘটনার পর সামছুদ্দিনকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলেও তিনি জড়িত থাকার বিষয়টি স্বীকার করেননি। অভিযুক্ত সামছুদ্দিন বর্তমানে জামিনে আছেন।
২০২১ সালের ৩১ মে কলাবাগানের ৫০/১ ফার্স্ট লেনের ভাড়া বাসা থেকে ডা. সাবিরার দগ্ধ মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। তিনি রাজধানীর বেসরকারি গ্রিন লাইফ হাসপাতালের কনসালট্যান্ট (সনোলজিস্ট) ছিলেন।
মরদেহ উদ্ধারের পর সুরতহাল প্রতিবেদনে উঠে আসে সাবিরার পিঠে দুটি ও গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করা হয়েছিল। এছাড়াও তার শরীরের বিভিন্ন অংশে আঘাতের চিহ্ন ছিল।
আলামত সংগ্রহের পর সিআইডির ক্রাইম সিন ইউনিট জানায়, সাবিরাকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা (ব্রুটালি কিলড) করা হয়েছে। তাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাতের পর বিছানায় আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। ময়নাতদন্তেও একই তথ্য উঠে এলেও হত্যাকাণ্ডের সময় রাতে নাকি সকালে ছিল তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ওই ঘটনায় সাবিরার ভাই রেজাউল হক বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলার তদন্ত থানা পুলিশ থেকে গোয়েন্দা শাখা (ডিবি), পরে ডিবি থেকে যায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) হাতে।
আরও পড়ুন
পিবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, চিকিৎসক সাবিরা হত্যার ঘটনায় অন্তত দুই ডজন পরিচিত বন্ধু, স্বজন, আত্মীয় ও বাসাটির বাসিন্দাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। ঘটনাস্থলের আশপাশের একাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করেও গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্য মেলেনি, শনাক্ত করা যায়নি খুনি কে।
পিবিআই সূত্রে জানা গেছে, ডা. সাবিরার ভাড়া বাসায় তিনটি কক্ষ। একটিতে সাবিরা নিজে থাকতেন ও বাকি দুটি সাবলেট দিয়েছিলেন। কানিজ সুবর্ণা ও নুরজাহান নামের দুই তরুণী ওই দুই কক্ষে থাকতেন। সাবিরাকে আরবি পড়াতেন নুরজাহান। হত্যাকাণ্ডের আগে তিনি বাড়িতে গিয়ে আর ফেরেননি। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবসায় প্রশাসনে (বিবিএ) পড়তেন। আর মডেল কানিজ সুবর্ণাকে কয়েক দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা। তবে তিনি জড়িত নন বলে তথ্য মিলেছে।
তাহলে ডা. সাবিরার খুনি কে? জানতে চাইলে মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা পিবিআইয়ের ঢাকা মেট্রো উত্তরের বিশেষ পুলিশ সুপার (পদোন্নতিতে অতিরিক্ত ডিআইজি) মো. জাহাঙ্গীর আলম ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসক সাবিরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে ২০২২ সালের ১৯ এপ্রিল এ কে এম সামছুদ্দিন আজাদকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদও করা হয়। তিনি উচ্চ আদালতের আদেশে জামিনে আছেন। তদন্তের এ পর্যায়ে স্বামী আজাদই আমাদের প্রধান সন্দিগ্ধ।
তিনি বলেন, সাবিরা ও সামছুদ্দিনের আগের পক্ষের সন্তান ছিল। কিন্তু স্বামীর সন্তানকে মেনে নিতে পারেননি সাবিরা। আবার সাবিরাকে বিয়ের আগে সামছুদ্দিন আরও দুটি বিয়ে করেন। কিন্তু তিনি একটি বিয়ের তথ্য গোপন করেছিলেন। তা নিয়ে তাদের মধ্যে কলহ-বিরোধ চরমে পৌঁছায়। এরপরই ডা. সাবিরা কলাবাগানে ভাড়া বাসায় ওঠেন।
পিবিআইয়ের এ কর্মকর্তা বলেন, স্ত্রী সাবিরার ওপর সামছুদ্দিন আজাদের ক্ষোভ ছিল। এ কারণে তিনি সাবিরাকে খুন করেছেন বলে আমরা বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণ পেয়েছি। তদন্তের পারিপার্শ্বিক তথ্যে অন্য কারো সঙ্গে যোগাযোগের তথ্য মেলেনি। স্ত্রীর সঙ্গে গোপনে যোগাযোগও ছিল আজাদের। আমরা অপেক্ষা করছি অকাট্য প্রমাণের। সে চেষ্টায় তদন্ত চলছে। মিলে গেলেই আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কলাবাগানের সেই বাসা ভাড়া নেওয়ার সময় ডা. সাবিরা ফ্ল্যাট মালিককে বলেছিলেন স্বামী কানাডায় থাকেন।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দাম্পত্য কলহের কারণে ও পারিবারিক বিচ্ছেদের চাপে তারা আলাদা থাকলেও স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যোগাযোগ ছিল। সাবিরার কলাবাগানের বাসায় সামছুদ্দিন একাধিকবার থেকেছেন। খুনের কয়েক মাস আগেও গোপনে তারা গাজীপুরে একটি রিসোর্টে সময় কাটিয়েছেন।
যে কারণে স্বামী আজাদকেই খুনি বলছে পিবিআই
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, স্বামীর সঙ্গে সাবিরার ঝগড়া-বিবাদের তথ্য মিলেছে। ঘটনার দিন ভোরে বাসা থেকে হাঁটতে বের হয়েছিলেন ফ্ল্যাটের সাবলেট বাসিন্দা কানিজ সুবর্ণা। ফিরে আসার পর তিনি দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখেন ধোঁয়া বের হচ্ছে। তখন তিনি দারোয়ানকে ডাকেন, পরে ফায়ার সার্ভিসকে খবর দেওয়া হয়।
জিজ্ঞাসাবাদে সুবর্ণা পুলিশকে জানিয়েছে, ওই বছরের ফেব্রুয়ারিতে কানিজ চিকিৎসক সাবিরার বাসায় সাবলেটে ওঠেন। ঘটনার আগের রাতে দীর্ঘসময় মেসেঞ্জারে কথা বলেন ডা. সাবিরা। কথোপকথনে ব্যাপক ঝগড়া হয়। উচ্চবাচ্যের শব্দ পাশের রুম থেকেই শোনা গিয়েছিল।
আরও পড়ুন
এটিকে একটি কারণ বলছে পিবিআই। এ কারণকে আরও তীব্র করেছে আরেকটি তথ্য। তা হলো, ঘটনার দিন ভোর থেকে সকাল ১০টা পর্যন্ত বন্ধ ছিল সামছুদ্দিন আজাদের মোবাইল। আবার আজাদের শান্তিনগরের বাসায় কখনো রাত্রিযাপন করতেন না গাড়িচালক সাইফুল। ঘটনার রাতে তিনি অভিযুক্ত সামছুদ্দিনের শান্তিনগরের বাসায় ছিলেন।
দ্বিতীয়ত, দুজনের পরিবার না জানলেও গোপনে যোগাযোগ ছিল সাবিরা ও আজাদের। কলাবাগানের ওই বাসায় পরিচিত কেউ এলেও পরিচয় নিশ্চিত না হয়ে দরজা খুলতেন না সাবিরা। তবে স্বামী আজাদ ওই বাসায় ৫/৬ বার যাতায়াত করেছেন। তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় তার প্রমাণ মিলেছে।
ঘটনার রাতে ফোন কেন বন্ধ ছিল সামছুদ্দিনের?
পিবিআইয়ের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সেই রাতে ফোন বন্ধ থাকলেও আগে খুব কম সময় ফোন বন্ধ ছিল আজাদের। প্রায় ৫ ঘণ্টা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল আজাদের মোবাইল, যখন স্ত্রী খুন হয়ে গেলেন। আর হত্যার খবর শুনে ঘটনাস্থলে আসার পর তাকে নির্লিপ্ত দেখা গেছে, যা সাধারণত ঘটে না। সাবিরার ভাড়া বাসায় তার যোগাযোগ ছিল। দাম্পত্য ক্ষোভ থেকে ফোন বন্ধ করে সাবিরাকে খুন করে নীরবে দরজায় তালা দিয়ে সটকে পড়েন স্বামী সামছুদ্দিন। ডা. সাবিরার মরদেহ যে কক্ষ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে, সেই কক্ষের দরজা ও ফ্ল্যাটের মূল দরজা বাইরে থেকে বন্ধ করা ছিল। পরিচিত ছাড়া বাইরে থেকে কেউ এসে খুন করার কথা নয়।
হত্যাকাণ্ডের তিন বছরেও বোন হত্যার বিচার না পাওয়ায় এবং কে খুনি সেটা পুলিশ বের করতে না পারায় ক্ষোভ-হতাশার কথা জানিয়েছেন মামলার বাদী মামাতো ভাই রেজাউল হাসান মজুমদার।
তিনি গত ১২ জুন বিকেলে ঢাকা পোস্টকে বলেন, সাবিরা হত্যায় স্বামী সামছুদ্দিন আজাদকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করেছিল পিবিআই। তিনি রিমান্ডে থাকলেন, জেলেও গেলেন। এরপর জামিনে বেরিয়ে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। অথচ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু বলছে না তদন্ত সংস্থা।
রেজাউল হাসান বলেন, সামছুদ্দিনের কিছু আচরণ আছে, পারিপার্শ্বিক ব্যাপার আছে। সেগুলো অবজার্ভ করলেই অনেক কিছু বেরিয়ে যাবে। আমাদের সন্দেহ সামছুদ্দিনই সাবিরাকে হত্যা করেছে।
চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তরের পরিদর্শক মোহাম্মদ জুয়েল মিঞা ঢাকা পোস্টকে বলেন, চিকিৎসক সাবিরা হত্যাকাণ্ডে সন্দিগ্ধ হিসেবে স্বামী সামছুদ্দিন আজাদকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বেশ কিছু তথ্য আমরা পেয়েছি। এখন পর্যন্ত যৌক্তিক কিছু কারণে ও পারিপার্শ্বিক তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে তাকেই সাসপেক্ট ধরা হয়েছে। মেসেঞ্জারে তাদের ২৬ মিনিট ঝগড়া, পরদিন ফোন বন্ধ রাখাটা অস্বাভাবিক। তিনি গোপনে কলাবাগানে সাবিরার বাসায় যেতেন। তদন্ত শেষে মামলার পুলিশ প্রতিবেদনে সব উল্লেখ করা হবে।
জেইউ/এসএসএইচ