বাংলাদেশে আঘাত হানা ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়গুলো
বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে প্রায়ই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ হতে দেখা যায়। সর্বশেষ গতরাতে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় রেমাল। ঘূর্ণিঝড়টি এরইমধ্যে উপকূল অতিক্রম শেষ করেছে।
১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে প্রায় প্রতিবছর বড় ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়তে হয়েছে বাংলাদেশকে। আবহাওয়া অধিদপ্তর ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ শুরু করে ২০০৭ সাল থেকে। এর আগে একটা সময় ঘূর্ণিঝড় বা সাইক্লোনের নামকরণ হতো না।
বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৬০ সাল থেকে ২০০৭ সালে সিডরের পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড়গুলোকে ‘সিভিয়ার সাইক্লোনিক স্টর্ম’ বা প্রবল ঘূর্ণিঝড় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
• ১৮৭৬ সালের ১ নভেম্বরের ঘূর্ণিঝড়টি অনেকের কাছে বাকেরগঞ্জের প্রবল ঘূর্ণিঝড় নামে পরিচিত। তাতে প্রাণ হারিয়েছিল ২ লাখ মানুষ, যখন ১০ থেকে ৪৫ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস হয়।
• ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবরের প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ৫ লাখ ১৪৯ জন নিহত হয়। ৬.১ মিটার উঁচু জলোচ্ছ্বাস ছিল।
• ১৯৬০ সালের ৩১ অক্টোবর চট্টগ্রামে ২০ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়
• ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে ১ অক্টোবর ২০-২২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের প্রবল ঘূর্ণিঝড়
• ২০০৭ সালে ঘূর্ণিঝড় সিডরে বাংলাদেশের প্রায় ছয় লাখ টন ধান নষ্ট হয়। সুন্দরবনের পশুর নদীতে বেশকিছু হরিণের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায় এবং বিপুলসংখ্যক মানুষ এবং বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়। ঝড়ের প্রভাবে প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস এবং ২১ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়। এ ঝড়ে প্রায় ২ লাখ ৪২ হাজার গৃহপালিত পশু এবং হাঁস-মুরগি মারা যায়।
• ২০০৯ সালে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেওয়া দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড় হচ্ছে আইলা। ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশ ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে। সিডরের মতোই আইলা প্রায় ১০ ঘণ্টা সময় নিয়ে উপকূল অতিক্রম করে, তবে পরে বাতাসের বেগ ৮০-১০০ কিলোমিটার হয়ে যাওয়ায় ক্ষয়ক্ষতি, সিডর থেকে তুলনামূলক কম হয়।
• ২০১৩ সালের ১৬ মে নোয়াখালী-চট্টগ্রাম উপকূলে জলোচ্ছ্বাসের ঘূর্ণিঝড় ‘মাহাসেন’
• ২০১৫ সালের ৩০ জুলাই চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে ৫-৭ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘কোমেন’
• ২০১৬ সালের ২১ মে বরিশাল-চট্টগ্রাম উপকূলে ৪-৫ ফুট উচ্চতার ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’
• ২০১৭ সালের ৩০ মে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূলে আঘাত হানে প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা।’
• ২০১৯ সালের ৩ মে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ফণীর আঘাতে বাংলাদেশে ৯ জনের মৃত্যু হয়। তবে প্রাণহানি কম হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক বেশি। সরকারি হিসাব মতে, ঘূর্ণিঝড় ফণীর কারণে ঘরবাড়ি, বাঁধ, সড়ক ও কৃষিতে ৫৩৬ কোটি ৬১ লাখ ২০ হাজার টাকার ক্ষতি হয়।
• বার বার দিক বদল করে ২০১৯ সালের ৯ নভেম্বর অতিপ্রবল ঘূর্ণিঝড় বুলবুল ভারতের পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সাগর দ্বীপ উপকূলে আঘাত হানার পর পৌঁছায় বাংলাদেশে। ঝড়ে মারা যায় ২৪ জন। ৭২ হাজার ২১২ টন ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়, যার আর্থিক মূল্য ২৬৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। ক্ষতি হয় সুন্দরবনেরও।
• ২০২০ সালের ২০ মে বাংলাদেশে আঘাত হানে সুপার সাইক্লোন আমফান। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে ১০ কোটিরও বেশি লোক বিদ্যুৎবিহীন হয়ে পড়েছিল। প্রায় ৩,০০০টি চিংড়ি এবং কাঁকড়া খামার বন্যায় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে যায়। সাতক্ষীরা জেলার, পূর্ব দুর্গাবতীতে, একটি বাঁধের কিছু অংশ ৪ মিটার (১৩ ফুট) উঁচু বন্যার জলে ভেসে যায়, যার ফলে ৬০০টি বাড়িঘর ডুবে যায়।
আরও পড়ুন
• ২০২২ সালের ২৫ অক্টোবর বাংলাদেশ ও ভারতকে প্রভাবিত করে এটি। ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের তাণ্ডবে দেশের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ঘূর্ণিঝড়টি ভোলা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের ওপর দিয়ে বয়ে গিয়ে ৪১৯ ইউনিয়নের ১০ হাজার ঘরবাড়ি এবং ৬ হাজার হেক্টর জমির ফসল নষ্ট করে। প্রায় ৮০ লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
• ২০২৩ সালের ১৪ মে স্থানীয় সময় বেলা ৩টার দিকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের উপকূলে আঘাত হানে মোখা। এই ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ব্যাপক অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে সেন্টমার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষেরা। বিশেষ করে গরিব ও নিম্নবিত্তদের কাঁচা ঘরবাড়ি একেবারে বিধ্বস্ত হয়ে যায় এই ঘূর্ণিঝড়ে। সবমিলিয়ে ঝড়ের প্রভাবের শিকার হন তিন লাখ ৩৪ হাজার মানুষ। যার প্রভাব কাটিয়ে উঠতে সময় লেগেছে উপকূলীয় মানুষের। এমনকি এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি সেন্টমার্টিন, টেকনাফ আর শাহ পরীর দ্বীপের মানুষেরা।
এনএফ