পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে যারা
চলতি বছরের ৫ ডিসেম্বর বর্তমান পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেনের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হবে। এরপর মাসুদ বিন মোমেনের উত্তরসূরি কে হবেন তা নিয়ে কূটনৈতিক অঙ্গনে চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ। এ মুহূর্তে পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে আলোচনায় রয়েছে প্রায় হাফ ডজন কূটনীতিকের নাম।
এদের মধ্যে অস্ট্রেলিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার এম আল্লামা সিদ্দিকী, লন্ডনে নিযুক্ত হাইকমিশনার সাঈদা মুনা তাসনিম, ভারতে নিযুক্ত হাইকমিশনার মো. মোস্তাফিজুর রহমান, চীনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. জসিম উদ্দিন ও নেদারল্যান্ডসে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রিয়াজ হামিদুল্লাহর নাম রয়েছে।
পররাষ্ট্র ক্যাডারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের তালিকা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার দৌড়ে জ্যেষ্ঠ কূটনীতিকদের তালিকায় রয়েছেন, ১০তম ব্যাচের জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক এম আল্লামা সিদ্দিকী। ১৯৯১ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন তিনি। অবশ্য নিয়ম অনুযায়ী, সিদ্দিকীর চাকরির মেয়াদ শেষ হবে চলতি বছরের ১ ডিসেম্বর। বর্তমান পররাষ্ট্রসচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষের চার দিন আগে অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা রয়েছে তার। জ্যেষ্ঠ এ কূটনীতিককে পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিব করতে হলে তার অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কয়েক মাস আগেই তাকে নিয়োগ দিতে হবে। এরপর পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে তার চাকরির চুক্তি বাড়াতে হবে।
আরও পড়ুন
পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার দৌড়ে আল্লামা সিদ্দিকীর চেয়ে কিছুটা এগিয়ে থাকবেন ১১তম ব্যাচের দুই পেশাদার কূটনীতিক সাঈদা মুনা ও মোস্তাফিজুর রহমান। এদের মধ্যে ব্যাচের প্রথম সাঈদা মুনা তাসনিম ১৯৯৩ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন। মুনার চাকরির মেয়াদ শেষ হবে এ বছরের ২৬ ডিসেম্বর। বর্তমান পররাষ্ট্রসচিবের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার ২১ দিনের মাথায় তার অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা। এক্ষেত্রে মুনাকে পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিব করতে গেলে তার অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কয়েক মাস আগেই তাকে নিয়োগ দিতে হবে। এরপর পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে তার চাকরি চুক্তিতে বাড়াতে হবে।
একই ব্যাচের আরেক পেশাদার কূটনীতিক মোস্তাফিজুর রহমানের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর। সাঈদা মুনার পাঁচদিন পর তার অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা। মোস্তাফিজকে মাসুদ বিন মোমেনের উত্তরসূরি করতে হলে একই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
এরপরে তালিকায় রয়েছে ১৩ ব্যাচের কূটনীতিক জসিম উদ্দিনের নাম। বেইজিংয়ে বর্তমানে ঢাকার হয়ে দূতিয়ালি করা জসিমের চাকরির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৬ সালের ১২ ডিসেম্বর।
এছাড়া, আলোচনায় রয়েছেন পেশাদার কূটনীতিক রিয়াজ হামিদুল্লাহ। ১৫তম ব্যাচের মেধা তালিকায় প্রথম হওয়া হামিদুল্লাহর চাকরির মেয়াদ শেষ হবে ২০২৯ সালের সেপ্টেম্বর। রাষ্ট্রদূত হামিদুল্লাহকে এরইমধ্যে নেদারল্যান্ডস থেকে ঢাকায় ফেরানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আর নেদারল্যান্ডসে নতুন রাষ্ট্রদূত হিসেবে বর্তমানে কেনিয়াতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার তারেক মোহাম্মদকে পাঠানোর কথা রয়েছে।
এ পাঁচ কূটনীতিকের মধ্যে দিল্লিতে নিযুক্ত হাইকমিশনার মোস্তাফিজুর রহমানকে পরবর্তী পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার দৌঁড়ে এগিয়ে রাখছেন অনেক কূটনীতিক। কারণ হিসেবে তারা বলছেন, দিল্লিতে হাইকমিশনারের দায়িত্বে থাকায় বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন মোস্তাফিজুর।
কূটনীতিক মোস্তাফিজ দিল্লিতে হাইকমিশনার হওয়ার আগে জেনেভায় জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও সুইজারল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি প্যারিস, নিউ ইয়র্ক ও জেনেভাতেও কর্মরত ছিলেন। এছাড়া, তিনি সিঙ্গাপুরে রাষ্ট্রদূত এবং কোলকাতায় ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবেও কাজ করেছেন।
স্বাধীন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ইতিহাসে এখন পর্যন্ত কোনো নারী পররাষ্ট্রসচিব পায়নি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সেক্ষেত্রে সরকার প্রথম কোনো নারীকে পররাষ্ট্রসচিবের পদ দিতে চাইলে হয়তো দায়িত্ব পেতে পারেন হাইকমিশনার সাঈদা মুনা।
সাঈদা মুনা থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী মিশন ও লন্ডনে বাংলাদেশ মিশনসহ বিভিন্ন গুরুত্ব পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া, ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জাতিসংঘ ও বহিঃপ্রচার অনুবিভাগের মহাপরিচালক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন মুনা।
এদিকে, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ঝামেলা না নিতে চাইলে সরকার হয়তো জ্যেষ্ঠদের বাদ দিয়ে নতুন কোনো মুখকে নিয়ে আসতে পারেন পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্বে। এক্ষেত্রে হয়তো বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন রিয়াজ হামিদুল্লাহ। তাছাড়া, সরকারের পক্ষ থেকে তাকে দেশে ফেরানোর সিদ্ধান্তে হামিদুল্লার পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার সম্ভবনা দেখছেন কোনো কোনো কূটনীতিক।
অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর হামিদুল্লাহ দিল্লিতে পড়াশোনা করেছেন। তিনি বিদেশের মাটিতে কূটনীতিক হিসেবে দ্বিতীয় অ্যাসাইনমেন্টে ছিলেন দিল্লির বাংলাদেশ মিশনে।
ঢাকার কূটনৈতিক অঙ্গনের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান পররাষ্ট্রসচিবের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদ শেষ হতে এখনও সাত মাসের বেশি সময় বাকি। তবে, স্বাভাবিক নিয়ম অনুযায়ী মাসুদ বিন মোমেনের চাকরির মেয়াদ শেষ হওয়ার কয়েক মাস আগে উত্তরসূরি নির্বাচন প্রক্রিয়া শুরু করার কথা সরকারের।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা বলেন, পররাষ্ট্রসচিব এবং ওয়াশিংটন ও দিল্লি— এ তিনটি সরকার তার বিশ্বস্ত মানুষ ছাড়া অন্য কাউকে দেবে বলে মনে হয় না। এছাড়া, যে দুই-তিনটি সচিবের সিদ্ধান্ত সরকারের শীর্ষ পযায় থেকে হয়ে থাকে, তার মধ্যে পররাষ্ট্রসচিব একটি। সরকার যদি মনে করে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ধারা অব্যাহত থাকবে, তাহলে মোস্তাফিজুর রহমান বা সাঈদা মুনা এই পদ পেতে পারেন। এই দুজনের মধ্যে মোস্তাফিজুর রহমানের সম্ভবনা বেশি থাকবে। আর সরকার যদি মনে করে, নিয়মিতকরণের মধ্য দিয়ে যাবে... তাহলে জসিম উদ্দিন ও রিয়াজ হামিদুল্লাহ আছেন।
এই কূটনীতিক বলেন, জ্যেষ্ঠদের এড়িয়ে সরকার জুনিয়রদের মধ্য থেকে কাউকে পররাষ্ট্রসচিব করবেন কি না সেটা একটা প্রশ্ন। চূড়ান্ত করে কারও নাম বলার সুযোগ নেই। কারণ, সিদ্ধান্তটা শীর্ষ পর্যায় থেকে হবে।
অন্য এক কূটনীতিক মনে করেন, বর্তমান সরকার আগের চেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকার কেন অতিরিক্ত ব্যাগেজ টানবে? হয়তো সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাই করবে। সাবেক পররাষ্ট্রসচিব শহিদুল হক দায়িত্ব পালন করেছেন সাত বছর। বর্তমানে যিনি আছেন তিনি সাড়ে চার বছর। প্রায় ১২ বছরের ব্যবধানে মাত্র দুজন সচিব পাওয়া গেল। এতে করে কিন্তু ডিসকনটিনিউ হয়েছে। সব বিবেচনায় সেটি মিনিমাইজ করার সুযোগ আছে, এবং এটাই মোক্ষম সময়।
জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব মো. তৌহিদ হোসেন বলেন, নিয়মিত চাকরিতে যারা আছেন, এমন কূটনীতিককে বাদ দিয়ে সাবেক কূটনীতিককে চুক্তিতে নিয়োগের সিদ্ধান্তটা রাজনৈতিক। যাদের চাকরির মেয়াদ বেশিদিন নেই, তাদের দায়িত্ব দেওয়া হবে না— এমনটা ভাবা ঠিক হবে না। আবার সরকার যে কোনো জুনিয়রকে নিয়ে আসতে পারবে না, এমনটাও নয়। সরকার চাইলে যে কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এনআই/কেএ