জলদস্যুর হাতে জিম্মি ২৩ নাবিকের মুক্তি মিলবে কবে?
সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়া ২৩ বাংলাদেশি নাবিকসহ জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধার নিয়ে ৬ দিন পরও কোনো অগ্রগতি নেই। জলদস্যুদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় আলোচনা করা যায়নি বলে দাবি করছে জাহাজের মালিকপক্ষ। কবে নাগাদ নাবিকদের মুক্তি মিলবে, তা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। ফলে নাবিকদের মুক্তি নিয়ে অপেক্ষা আরও বাড়ছে। এ নিয়ে নাবিকদের পরিবার রয়েছে নানা শঙ্কায়।
১২ মার্চ ভারত মহাসাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়ে শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ। সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে জিম্মি করে ৫০ জন অস্ত্রধারী সোমালি জলদস্যু। সেদিনই সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়া হয় জাহাজটি। পরে ১৪ মার্চ ভারী অস্ত্র নিয়ে ১৯ সদস্যের নতুন জলদস্যু দল জাহাজের দায়িত্বে আসে।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছিলেন, পরে জাহাজে আসা নতুন দস্যু দল মালিকপক্ষের সঙ্গে মুক্তিপণ নিয়ে যোগাযোগ করবে। এতে দ্রুত মুক্তির সম্ভাবনা দেখছিলেন তারা।
জাহাজে জিম্মি থাকা এক নাবিকও ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছিলেন, জাহাজে ওঠা নতুন জলদস্যুরা মালিকপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করবে– এমনটা শুনেছিলেন তিনি। কিন্তু এখন পর্যন্ত জলদস্যুদের পক্ষ থেকে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি বলে দাবি করছে মালিকপক্ষ।
এদিকে ভারতীয় নৌবাহিনীর মুখপাত্রের অফিশিয়াল এক্স অ্যাকাউন্টে বলা হয়, সোমালিয়ার জলদস্যুদের জিম্মি করা মাল্টার পতাকাবাহী এমভি রুয়েন জাহাজকে প্রায় ৪০ ঘণ্টার অভিযানে উদ্ধার করেছে নৌবাহিনী। এসময় ১৭ জন নাবিককে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। জাহাজে থাকা ৩৫ জলদস্যুর সবাই আত্মসমর্পণ করেছে বলে জানানো হয়। রোববার (১৭ মার্চ) রাতে এমভি রুয়েনের নাবিকদের উদ্ধার ও জিম্মিদের আত্মসমপর্ণের চারটি ভিডিও প্রকাশ করা হয়।
এ ঘটনার পর এমভি আব্দুল্লাহর নাবিকদের ওপর কড়াকড়ি আরোপ করেছে সোমালি জলদস্যুরা। সে কারণে নাবিকরা আগের মতো পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না।
আরও পড়ুন
অন্যদিকে এমভি রুয়েন উদ্ধার করলেও বাংলাদেশি জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহ এভাবে অভিযান চালিয়ে উদ্ধার করা বিপজ্জনক বলে মনে করছেন নৌ খাতের অভিজ্ঞ ক্যাপ্টেনরা।
তারা বলছেন, এমভি রুয়েন সোমালিয়ার উপকূল থেকে অনেক দূরে ছিল। সেখানে নানা দেশের নাবিকরা জিম্মি অবস্থায় ছিলেন। আবার জাহাজটি উদ্ধারে মালিকপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার প্রক্রিয়া সেভাবে নাও হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে শঙ্কা থাকলেও অভিযানের বিকল্প নেই।
সোমালি জলদস্যুদের কাছ থেকে মাল্টার পতাকাবাহী জাহাজ এমভি রুয়েনকে মুক্ত করার পর বাংলাদেশি জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহকে উদ্ধারে ভারতীয় নৌবাহিনী পরিকল্পনা করছে বলে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসিকে জানিয়েছেন সোমালিয়ার পুন্টল্যান্ডের বন্দর ও সামুদ্রিকপথ বিষয়ক মন্ত্রী আহমেদ ইয়াসিন সালাহ।
জিম্মি জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর মালিক বাংলাদেশি, নাবিকরাও বাংলাদেশি। জাহাজের মালিকপক্ষ নাবিকদের জীবন বাঁচানোকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছে। বাংলাদেশি জিম্মি জাহাজ ছিনতাই করে নেওয়ার সময় ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেভাল ফোর্সের একটি জাহাজ পিছু নিলেও তাদের অভিযান পরিচালনার জন্য অনুমতি দেয়নি। কারণ, অভিযান পরিচালনা করলে নাবিকদের জীবন নিয়ে শঙ্কা থাকে। ফলে এমভি আব্দুল্লাহ ও নাবিকদের উদ্ধার করতে জলদস্যুদের সঙ্গে সমঝোতার বিকল্প নেই বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
সোমবার (১৮ মার্চ) বিকেলে কেএসআরএমের মুখপাত্র মিজানুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমাদের সঙ্গে নাবিকদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। তারা সবাই সুস্থ আছেন। সেখানে জাহাজের নিয়মিত কাজগুলো করছেন তারা।
উদ্ধার প্রক্রিয়া নিয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নাবিকদের সুস্থ উদ্ধার করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। আমরা বিভিন্নভাবে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়নি।
মিজানুল ইসলাম বলেন, ২৩ বাংলাদেশি নাবিককে উদ্ধারে ‘মধ্যস্থতাকারী’ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ চলছে। তবে মুক্তিপণ বা জিম্মিদের মুক্তির বিষয়ে জলদস্যুরা এখনো যোগাযোগ করেনি। জাহাজটির কিডন্যাপ অ্যান্ড র্যানসম (কেঅ্যান্ডআর) ইন্স্যুরেন্স করা আছে। ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিও জিম্মি নাবিকদের উদ্ধারে কাজ করছে।
আরও পড়ুন
সর্বশেষ তথ্য মতে, জাহাজটি একাধিকবার সরিয়ে সোমালিয়ার গদবজিরান শহর থেকে ৪ নটিক্যাল মাইল দূরে নোঙর করা হয়েছে।
১৩ বছর আগে সোমালিয়ার দস্যুদের হাতে জিম্মি হওয়া এমভি জাহান মণি জাহাজের মাস্টার ক্যাপ্টেন ফরিদ আহমেদ বলেন, দস্যুরা নিজেদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় নেওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে সাধারণত যোগাযোগ করে। যোগাযোগের জন্য তাদের প্রতিনিধি থাকে। স্যাটেলাইট ফোনেই তারা যোগাযোগ করে।
বাংলাদেশ মার্চেন্ট মেরিন অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ক্যাপ্টেন আনাম চৌধুরী বলেন, এমভি আবদুল্লাহ সোমালিয়ার উপকূলের একেবারে কাছেই রয়েছে। যুদ্ধ ছাড়া এরকম উপকূলীয় এলাকায়, আরেক দেশের সীমানায় অভিযান চালানো যায় না। আবার দস্যুরা যেহেতু নাবিকদের জিম্মি করে রেখেছে, এখন কোনো অভিযান হলে নাবিকদের জীবন বিপন্ন হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। নাবিকদের প্রাধান্য দিতে গেলে সমঝোতার বিকল্প নেই। মালিকপক্ষ যেহেতু নাবিকদের জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছে, তাই এখানে দস্যুদের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ছাড়িয়ে আনা সম্ভব।
গত ১২ মার্চ দুপুরে শিল্প গ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। সেখানে থাকা ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়। বন্ধ করে দেওয়া হয় জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয় নাবিকদের কাছে থাকা মোবাইল, সঙ্গে থাকা ডলার।
জাহাজটি ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। নাবিক ও ক্রুসহ জাহাজটিতে ২৩ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। ১২ মার্চ বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটি ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে জলদস্যুরা। জাহাজটি ওই সময় সোমালিয়া উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল।
কেএসআরএমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ আগে ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি বাল্ক ক্যারিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এরকম ২৩টি জাহাজ আছে কবির গ্রুপের বহরে।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের চেষ্টায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা।
এসএসএইচ