‘আব্বা আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন, দুই ছেলেকে দেখে রাখবেন’
‘ওরা খুব খারাপ মানুষ। আমার একটি মোবাইল নিয়ে ফেলেছে। আমাদেরকে ওরা বন্দী করে রেখেছে। বেঁচে থাকলে দেখা হবে আব্বা। আমাদের জন্য দোয়া করবেন। আমার দুই ছেলেকে দেখে রাখবেন। আর আমাকে ক্ষমা করে দিয়েন।’ মুঠোফোনে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবাকে এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন মাঝসমুদ্রে জলদস্যুদের হাতে আটক হওয়া বাংলাদেশি ইব্রাহীম খলিল উল্ল্যাহ বিপ্লব।
বুধবার (১৩ মার্চ) বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ঢাকা পোস্টকে বিষয়টি জানান বিপ্লবের বাবা আবুল হোসাইন ভূঁইয়া।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘গতকাল বিকেল ৫টা ২৪ মিনিটের দিকে বিপ্লবের সঙ্গে কথা হয়েছে। ওই সময় আমাদের কাছে দোয়া চেয়েছে আমার ছেলে। তার দুই ছেলেকে দেখে রাখতে বলেছে। তাকে ক্ষমা করে দিতে বলেছে। এরপর থেকে আর কথা বলার সুযোগ হয়নি। আমার ছেলে কী অবস্থায় আছে জানি না।’
আরও পড়ুন
আবুল হোসাইন ভূঁইয়া আরও বলেন, ‘দুই মাস আগে আমার ছেলের সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছে। আবার দেখতে পাব কি-না জানি না।’
জাহাজের মালিকপক্ষের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ হয়েছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে জাহাজের কেউ যোগাযোগ করেনি। আমার ছেলের বউয়ের সঙ্গে করেছে কি-না জানি না।’
তিনি বলেন, ‘আমি ছেলেকে সুস্থ অবস্থায় ফেরত চাই। আপনারা আমার ছেলের জন্য দোয়া করবেন।’
আবুল হোসাইন ভূঁইয়ার ছেলে ইব্রাহীম খলিল উল্ল্যাহ বিপ্লব ওই জাহাজে ইলেকট্রিশিয়ান হিসেবে কর্মরত। বিপ্লব ফেনীর দাগনভূঞা উপজেলার মাতুভূঞার ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামের বাসিন্দা।
সর্বশেষ ১ মার্চ নিজের ছবি দিয়ে ফেসবুক বিপ্লব লিখেন, ‘নাবিক এর সুখ কোথায়।’
এদিকে স্বামীর চিন্তায় উৎকণ্ঠায় থাকা বিপ্লবের স্ত্রী উম্মে সালমা সোনিয়া বলেন, আফ্রিকার মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে জলদস্যুরা জাহাজটি অপহরণ করে। তাদের জিম্মি করা হয়েছে। তাদের সঙ্গে থাকা মোবাইল ফোন নিয়ে গেছে জলদস্যুরা। এই ঘটনা শোনার পর থেকে দুই ছেলেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
তিনি বলেন, ‘সরকার এবং জাহাজ কর্তৃপক্ষ দ্রুত সময়ের মধ্যে যেন আমার স্বামীকে উদ্ধার করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে আনে, সেই প্রত্যাশা আমাদের।’
বাংলাদেশ সময় মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে শিল্পগ্রুপ কেএসআরএমের মালিকানাধীন এসআর শিপিংয়ের জাহাজটি জিম্মি করে সোমালিয়ান দস্যুরা। এরপর এদিন বিকেলে জাহাজটি সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
সন্ধ্যা ৭টার দিকে নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ যোগাযোগ হয়েছে কেএসআরএম কর্তৃপক্ষের। ২৩ নাবিককে একটি কেবিনে আটকে রাখা হয়েছে। বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে জাহাজের ইন্টারনেট সংযোগও। ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে নাবিকদের কাছে থাকা মোবাইল, সঙ্গে থাকা ডলারও। ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরের সোমালিয়া উপকূলে জাহাজটির যেতে সময় লাগবে প্রায় তিন দিন। সেখানে পৌঁছার পর জলদস্যু দলের নেতাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে জাহাজ ও তার নাবিকদের ভাগ্য।
জাহাজটি ৫৮ হাজার মেট্রিক টন কয়লা নিয়ে ৪ মার্চ আফ্রিকার মোজাম্বিকের মাপুটো বন্দর থেকে যাত্রা শুরু করে। ১৯ মার্চ সেটি সংযুক্ত আরব আমিরাতের হামরিয়াহ বন্দরে পৌঁছানোর কথা ছিল। নাবিক ও ক্রুসহ জাহাজটিতে ২৩ জন বাংলাদেশি রয়েছেন। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে জাহাজটিকে ভারত মহাসাগর থেকে সোমালিয়ার উপকূলে নিয়ে যাওয়ার কাজ শুরু করে জলদস্যুরা। জাহাজটি ওই সময় সোমালিয়া উপকূল থেকে ৪৫০ নটিক্যাল মাইল দূরে অবস্থান করছিল।
কবির গ্রুপের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান এসআর শিপিংয়ের মালিকানাধীন ‘এমভি আবদুল্লাহ’ আগে ‘গোল্ডেন হক’ নামে পরিচিত ছিল। ২০১৬ সালে তৈরি বাল্ক কেরিয়ারটির দৈর্ঘ্য ১৮৯ দশমিক ৯৩ মিটার এবং প্রস্থ ৩২ দশমিক ২৬ মিটার। গত বছর জাহাজটি এসআর শিপিং কিনে নেয়। বিভিন্ন ধরনের পণ্য নিয়ে আন্তর্জাতিক রুটে চলাচলকারী এরকম মোট ২৩টি জাহাজ আছে কবির গ্রুপের বহরে।
এর আগে ২০১০ সালের ডিসেম্বরে আরব সাগরে সোমালি জলদস্যুদের কবলে পড়েছিল বাংলাদেশি জাহাজ জাহান মণি। ওই সময় জাহাজের ২৫ নাবিক এবং প্রধান প্রকৌশলীর স্ত্রীকে জিম্মি করা হয়। নানাভাবে চেষ্টার পর ১০০ দিনের চেষ্টায় জলদস্যুদের কবল থেকে মুক্তি পান তারা।
এমআর/এমজে