দেশ পরিচালনায় আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে নারীরা
নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে এখন অনেকটাই এগিয়েছে বাংলাদেশে। প্রধানমন্ত্রী, স্পিকার, মন্ত্রিসভার সদস্য, এমপি, সচিব, জেলা প্রশাসক, ইউএনও পদে থেকে দেশ পরিচালনায় এখন আগের চেয়ে অনেক এগিয়ে নারীরা।
অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নারীর ক্ষমতায়ন— এই চার মাপকাঠির ভিত্তিতে প্রত্যেক বছর সূচক প্রকাশ করে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। ফোরামের সর্বশেষ সূচক অনুযায়ী, নারীর ক্ষমতায়নের সূচকে ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ স্কোর নিয়ে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। যেখানে ভারতের অবস্থান-৫১, পাকিস্তান ৯৮, শ্রীলঙ্কা ৯০।
ডব্লিউইএফ বলছে, বাংলাদেশে গত ৫০ বছরের মধ্যে ২৯ দশমিক ৩ বছর রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন নারী। যা বিশ্বে দীর্ঘসময় ধরে কোনো দেশের নারীর শাসনাধীন থাকার রেকর্ড।
ডব্লিউইএফ-এর তথ্যানুযায়ী, নারী-পুরুষের লিঙ্গ সমতা সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। টানা ৯ম বারের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থান ধরে রেখেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে নারীদের এ অবস্থানের পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। তিনিই নারীর ক্ষমতায়নকে প্রাধান্য দিয়েছেন। সে অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ সব পদেই এখন নারীদের অবস্থান রয়েছে।
তারা বলছেন, গত ১৫ বছর ধরে নারীর ক্ষমতায়ন হয়েছে। এগিয়ে যাচ্ছেন নারীরা। তবে তা সংখ্যার দিক দিয়ে যথেষ্ট নয়। এক্ষেত্রে নারীদের আরও সুযোগ দিতে হবে।
বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের মহাসচিব ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব সায়লা ফারজানা ঢাকা পোস্টকে বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীদের সফলতার ক্রেডিট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রথমত তিনি সুযোগ দিয়েছেন, এজন্য আমরা তার প্রতি কৃতজ্ঞ। দ্বিতীয়ত, যেসব স্যার আমাদের নারীদের সুযোগ দিচ্ছেন সচিব, কমিশনার, জেলা প্রশাসক কিংবা প্রিন্সিপাল অথবা ডিআইজি হওয়ার জন্য, আমরা তাদের প্রতিও কৃতজ্ঞ। তবে এ সুযোগ আরও বাড়াতে হবে, কারণ সুযোগের পরিমাণ উল্লেখযোগ্য নয়।
তিনি বলেন, এক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান ৫০ শতাংশ না হলে অন্তত ৩০ শতাংশ হোক। এটা আমাদের আবেগি চাওয়া নয়। শিক্ষা, চিকিৎসা, প্রশাসন, বিভিন্ন বাহিনীরসহ সব জায়গায় আমাদের নারী কর্মকর্তারা কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছে। তারা কাজের ক্ষেত্রে আত্মবিশ্বাসী। কিন্তু এখনও মনে হচ্ছে সুযোগটা আমরা সে রকম পাচ্ছি না। যেটা পেয়েছি সেটার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ, কিন্তু এ সুযোগ আরও চাই। অনেক যোগ্যতাসম্পন্ন নারী আছেন। সেজন্য সুযোগটা আমরা আরেকটু বাড়ানোর পক্ষে।
সুযোগ বাড়ছে না কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নারীরা সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যোগ্য। সুযোগ পাচ্ছে না কেন? প্রতিযোগিতা কীসের? আপনারা তো নিজেরাই বুঝতে পারেন। একটা সামাজিক ট্যাবু এখনো রয়ে গেছে আমাদের মধ্যে যে, মেয়েরা কম পারে।
তিনি বলেন, এই ট্যাবুর বিষয়ে নারী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে একটা নেটওয়ার্ক করি। তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ানো, দক্ষতা বাড়ানোর জন্য কাজ করি। আর সামাজিক ট্যাবু নিয়ে কাজ করা খুব কঠিন। বিভিন্ন সময় ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যাবে, সামাজিক এই ট্যাবু এটা নিয়ে অনেক দার্শনিক, অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিসহ বড় বড় লোকজন কাজ করেছেন এখনো করছেন। তবে আমরাও মানুষকে বলছি, এই সামাজিক ট্যাবু থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
সরকারের এই অতিরিক্ত সচিব বলেন, আমরা যখন জুনিয়র ছিলাম তখন আমাদের যারা সিনিয়র নারী বা পুরুষ কর্মকর্তা ছিলেন তাদের মধ্যে সহযোগিতা করার মানসিকতা খুব বেশি ছিল না, এখন যেমন আছে। তুলনামূলকভাবে এখনকার চেয়ে তখন কম ছিল। সে ক্ষেত্রে আমরা যখন যে চ্যালেঞ্জ ফেস করেছি, সমাধান খুব সহজে পাইনি। অর্থাৎ এখন যেমন কারো না কারো কাছে সমাধান আছে, সমস্যা যদি কেউ তুলে ধরতে পারে, পরামর্শ দিতে পারে, সমাধানের পথ দেখাতে পারে। তখন আমাদের যে কোনো একটা সমস্যায় পড়লে সমাধান খুঁজতে হলে অনেক বেশি সময় পার করতে হতো। হয়ত কখনো কখনো সমাধান পেতামই না। এখন নারীরা যেমন সুযোগ পাচ্ছে আমাদের সময় এই সুযোগটা অনেক সীমিত ছিল। অনেক বেশি প্রমাণ করতে হতো যে আমি নারী কর্মকর্তা নই, আমি একজন কর্মকর্তা। বারবার আমাদের এটা প্রমাণ করতে হতো।
নাটোরের সিংড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) হা-মীম তাবাসসুম প্রভা ঢাকা পোস্টকে বলেন, নারীর ক্ষমতায়নে সফলতার প্রধান কারণ হচ্ছে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী আমাদের নারীবান্ধব একটি কর্মস্থল তৈরি করে দিয়েছেন। বর্তমানে আমাদের দেশে এখন নারী সচিব আছেন, অতিরিক্ত সচিব আছেন বা, জেলা প্রশাসক আছেন। সবচেয়ে বড় কথা প্রধানমন্ত্রী নিজেই নারী। তারা যে পরিমাণ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছেন, সেটা আমাদের করতে হচ্ছে না। তাদের থেকে আমরা অনেক ভালো পরিবেশ পাচ্ছি। কারণ তারা আগে থেকেই সেই পরিবেশটা আমাদের তৈরি করে দিয়েছেন। এজন্য তারা অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন। আমাদের কাজ, আমাদের অফিস এখন অনেক বেশি নারীবান্ধব।
আরও পড়ুন
তিনি বলেন, আমি দেশের বাইরে থেকে পড়াশোনা করে এসেছি। সেদেশে আমাকে যখন জিজ্ঞেস করা হলো এখানকার আর তোমার দেশের পজিটিভ অথবা নেগেটিভ পার্থক্য বল। আমি তাকে একটা কথাই বলেছিলাম যে, আমি এখানে আসার পর দেখলাম আমার দেশ নারী শিক্ষায় কী পরিমাণে সমতা অর্জন করতে পেরেছে, দেশের বাইরে না থাকলে আমার চোখে এটা এত স্পষ্ট ধরা পড়ত না। নারী শিক্ষা, নারীর কর্ম এবং নারীর ক্ষমতায়ন— সব ক্ষেত্রে উন্নতি হয়েছে। এখনো হয়ত পর্যাপ্ত হয়নি কিন্তু আমরা অনেক উন্নতি করেছি।
তিনি আরও বলেন, এখনো কিছু কিছু এলাকায় বাল্য বিয়ে হচ্ছে। এখানে অনেক বিষয় আছে। অনেক সময় দেখা যায় যে বাচ্চারা নিজেরাও পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করছে অনেক কম বয়সে। কিন্তু তারা তো তখন মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকে না। যেহেতু তারা মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়, তাতে করে নানা সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে ওই নারীর ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে ব্যাঘাত ঘটে।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেন, বাংলাদেশে নারী সমাজের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন, নারী অধিকার রক্ষা, নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতা সৃষ্টির জন্য দিবসটির গুরুত্ব অপরিসীম। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশনা ও নেতৃত্বে দেশে নারীর ক্ষমতায়নের শুরু হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশে নারীর উন্নয়ন, ক্ষমতায়ন ও সম-অধিকার প্রতিষ্ঠায় সময়োপযোগী বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা ও আত্মকর্মসংস্থান সকল ক্ষেত্রে নারীরা আজ সফল হয়েছে। নারীরা দেশের উন্নয়ন ও অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। যে কারণে সমতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ ৫৯তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় শীর্ষে।
এসএইচআর/এসকেডি