কাটছাঁটের আর জায়গা নেই, তাই বাসা ছাড়ছি
নতুন আশা আর সম্ভাবনাকে সামনে নিয়ে শুরু হয় নতুন বছর। নতুন করে শুরু হয় অনেকের জীবনের দিনলিপি। রাজধানী ঢাকায় অবশ্য অনেকের নতুন বছর শুরু হয়েছে একটু অন্যভাবে; আশার বিপরীতে তাদের শুরুটা হয়েছে অনিশ্চয়তার দোলাচলে। দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা এই শ্রেণির মানুষ অর্থের অভাবে তাদের চেনা আবাস ছেড়ে দিচ্ছেন। চলে যাচ্ছেন দূরে কোথাও, যেখানে কম টাকায় করতে পারবেন দিনাতিপাত।
বছরের প্রথম দিন থেকে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায় বাসা পরিবর্তনের চিত্র। এখনো কমবেশি চলছে। কেউ পিকআপে করে, কেউ ট্রাকে কিংবা ভ্যানগাড়িতে করে মালামাল নিয়ে অন্য এলাকায় চলে যাচ্ছেন। কী কারণে তাদের বাসা পরিবর্তন? অধিকাংশই জানিয়েছেন— ভাড়া বেশি, কুলাতে পারছেন না। একটু দূরে শহরের প্রান্তিক এলাকায় চলে যাচ্ছেন তারা, যেখানে বাসা ভাড়া তুলনামূলক কম।
রাজধানীর বনশ্রী এলাকায় দীর্ঘদিন ধরে পরিবার নিয়ে ভাড়া বাসায় বসবাস করেন বেসরকারি চাকরিজীবী মাসুদ রানা। তিনি বলেন, আমার বেতন অনুযায়ী বর্তমান ঊর্ধ্বগতির বাজারে সংসার পরিচালনা করা কঠিন। ইতোমধ্যে অনেক কাটছাঁট করে কোনোমতে টিকে আছি। নতুন করে কাটছাঁট করার আর জায়গা নেই। তাই বাধ্য হয়ে বাসা ছেড়ে মূল শহরের একটু বাইরে বসিলার দিকে চলে যাচ্ছি। সংসার পরিচালনার জন্য এখন প্রতি মাসেই তিন-চার হাজার টাকা ঋণ করতে হয়।
মিরপুরের বাসিন্দা সাব্বির আহমেদ। চাকরি করেন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে। দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাড়া থাকেন শেওড়াপাড়া এলাকার একটি বাসায়। তৃতীয় তলার সেই ফ্ল্যাটে ভাড়া দেন ১৪ হাজার টাকা।
বছরের শুরুতে তিনি বাড়ির মালিকের কাছ থেকে ভাড়া বাড়ানোর নোটিশ পান। আগামী মাস থেকে ভাড়া বাড়বে এক হাজার টাকা। ফলে শুধু বাড়ি ভাড়া দাঁড়াবে ১৫ হাজার টাকা। সেই সঙ্গে গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট, ময়লার বিল সবমিলিয়ে যুক্ত হবে আরও প্রায় তিন হাজার টাকা। মোট ১৮ হাজার টাকা লেগে যাবে। মাস শেষে তিনি বেতন পান ৩০ হাজার টাকা। এ টাকা থেকে ১৮ হাজার ভাড়া-বিলে চলে গেলে বাকি খরচ কীভাবে হবে? তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন— দুই-এক মাসের মধ্যে বাসা ছেড়ে দেবেন, চলে যাবেন আফতাব নগরের পেছনে একটু ভেতরের দিকে।
সাব্বির আহমেদ বলেন, আমার অফিস কারওয়ান বাজার। সেখান থেকে বেশ দূরেই (শেওড়াপাড়া) বাসা ভাড়া নিয়েছিলাম কম খরচের জন্য। প্রথমে ১০ হাজার টাকায় উঠেছিলাম, কয়েক বছরে ভাড়া বেড়ে ১৪ হাজার টাকা হয়েছে। এখন আবার ১৫ হাজার টাকা করতে চায় মালিক। যেটা আমার পক্ষে বহন করা খুব কঠিন।
তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে সবকিছুর দাম এত বেশি যে প্রতি মাসেই চলে টানাপোড়েন। এর মধ্যে বাসা ভাড়া বাড়ানো... বাধ্য হয়ে এলাকা ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আফতাবনগরের পেছনে ভেতরের দিকে ১১ হাজার টাকায় একটা বাসা দেখেছি, সেদিকেই চলে যাব। চলাচলে কষ্ট হবে কিন্তু কিছু করার নেই।
এমন আরও কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জীবনযাত্রার ব্যয় ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে দিশেহারা অবস্থা। সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধিতে অসহায় হয়ে পড়েছেন মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষেরা। যে কারণে কম ভাড়ার আশায় একটু দূরে বাসা স্থানান্তরের প্রবণতা বেড়েছে।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ বিষয়ক সংগঠন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) তথ্য অনুযায়ী— গত ১৫ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে ছয় গুণের বেশি, যা শতাংশ হিসেবে দাঁড়ায় ৬২৮। এছাড়া গত ২৫ বছরে বাড়ি ভাড়া বেড়েছে প্রায় ৪০০ শতাংশ। একই সময়ে নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে ২০০ শতাংশ। অর্থাৎ এ সময়ে নিত্যপণ্যের দামের তুলনায় বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির হার দ্বিগুণ।
সংগঠনটির আরেক পরিসংখ্যান বলছে, ঢাকার ২৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৩০ শতাংশ, ৫৭ শতাংশ ভাড়াটিয়া প্রায় ৫০ শতাংশ, ১২ শতাংশ ভাড়াটিয়া আয়ের প্রায় ৭৫ শতাংশ টাকা বাসা ভাড়া পরিশোধে ব্যয় করেন।
আরও পড়ুন
দেশে বাড়ি নিয়ন্ত্রণের একটি আইন আছে, যেটি ১৯৯১ সালের। এই আইনে ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষার কথা বলা হয়েছে। আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। ভাড়াটিয়াদের স্বার্থ রক্ষার নানান বিষয় এখানে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবে আইনটির প্রয়োগ নেই। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে— ঢাকায় বর্তমানে আড়াই কোটিরও বেশি মানুষের বসবাস। প্রতি বছর রাজধানীতে ছয় লাখ ১২ হাজার মানুষ যুক্ত হচ্ছেন। এক দিনের হিসাবে এক হাজার ৭০০ জন। পৃথিবীর সবচেয়ে জনবহুল শহরগুলোর তালিকায় অন্যতম স্থানে রয়েছে রাজধানী ঢাকা। আয়তন ও জনসংখ্যার হিসাবে ঢাকা পৃথিবীর ঘনবসতিপূর্ণ একটি শহর। এখানে প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে ৪৩ হাজার ৫০০ মানুষ।
ঢাকা সিটি কর্পোরেশন ২০০৭ সালে শহরের ৭৭৫টি এলাকায় আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, কাঁচাবাড়ি,পাকা ঘর, সেমি পাকা, মেইন রোডের তিনশত ফিট ভেতরে এবং বাইরে ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত প্রতি স্কয়ার ফিট ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু এটির প্রয়োগও কোথাও দেখা যায় না। এছাড়া ভাড়া বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন-১৯৯১ এ রয়েছে সুনির্দিষ্ট বিধান। আইনের ১৬ ধারায় বলা হয়েছে— বড় কোনো ধরনের নির্মাণকাজ বা পরিবর্তন আনা ছাড়া বাসা মালিক দুই বছরের মধ্যে মূল ভাড়া বৃদ্ধি করতে পারবেন না।
বাড়ির মালিকরা অবশ্য বলছেন, ভাড়া ঠিকই আছে। কিংবা বলতে চান, ভাড়া বাড়ানোর পেছনে যুক্তি আছে।
মিরপুর ১০ নম্বর সংলগ্ন পর্বতা সেনপাড়া এলাকার একটি পাঁচ তলা বাড়ির মালিক হামিদুর রহমান বলেন, আপনারা শুধু মনে করেন বাড়ির মালিকরা শুধু বাসা ভাড়া বাড়িয়েই যায়। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট ভিন্ন। একজন বাড়ির মালিক সারা জীবনের কষ্টে অর্জিত টাকা দিয়ে বা লোন করে একটি বাড়ি বানায়। বাড়ির নকশা, অনুমোদনসহ নির্মাণ সামগ্রির অতিরিক্ত মূল্য পরিশোধ করে, ক্ষেত্র বিশেষে বিভিন্ন জনকে চাঁদার টাকা দিয়ে বাড়ি নির্মাণ করা হয়। তখন ওই মালিকের আয়ের এবং ঋণ পরিশোধের একমাত্র উপায় এই বাড়ি ভাড়া থেকেই। এছাড়া সংসার খরচ, বাড়ি সংস্কারের কাজসহ যাবতীয় খরচ এই বাড়ি ভাড়া থেকে মেটাতে হয়। যারা চাকরি করে তাদের বছর বছর বেতন বাড়ে, প্রমোশন হয়। আর যারা ব্যবসায়ী তারা ব্যবসায় লাভ করে, কিন্তু বাড়ির মালিকের এই ভাড়ার উপরে নির্ভর করে থাকতে হয়।
বাড়ি ভাড়া বৃদ্ধির সমালোচনা করে ভাড়াটিয়া পরিষদের সভাপতি মো. বাহারানে সুলতান বাহার ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন বছর শুরু হলেই বা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কারণের কথা উল্লেখ করে নিয়মিত বাড়ি ভাড়া বাড়িয়ে আসছে বাড়ির মালিকরা। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন আছে, তবে কেউ মানে না। বাড়ি ভাড়া নিয়ন্ত্রণ আইন কার্যকর করতে আমরা বারবার সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছি, নিজেরা মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছি। তবুও এই অসহায় ভাড়াটিয়াদের কথা কেউ শুনছে না।
এএসএস/এমজে