‘পরিবর্তনের দূত’ হয়ে কিশোরীদের পাশে কিশোরীরা
পিরিয়ড নিয়ে প্রায়ই বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় অনেক কিশোরীকে। পারিবারিকভাবে সচ্ছল কিশোরীরা পিরিয়ডের সময় স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের সুযোগ পায়। কিন্তু সমাজের সুবিধাবঞ্চিত কিশোরীরা এ সুযোগ পায় না। স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলায় এবং পিরিয়ড সম্পর্কিত সঠিক জ্ঞান ও ধারণা না থাকায় নানারকম স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে অসচ্ছল পরিবারের কিশোরীদের।
সুবিধাবঞ্চিত এসব কিশোরীদের পিরিয়ড বিষয়ক স্বাস্থ্যবিধি এবং উপযুক্ত স্যানিটেশন সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে দূত হিসেবে কাজ করছে স্বয়ং এক দল কিশোরী। এই কিশোরীরা সচ্ছল পরিবারের সন্তান। তারা সুবিধাবঞ্চিত কিশোরীদের হাতে তুলে দিচ্ছে স্যানেটারি ন্যাপকিন ও প্যাডসহ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ।
পরিবর্তনের দূত হিসেবে কাজ করা এমন কয়েকজন কিশোরীর সঙ্গে কথা বলেছে ঢাকা পোস্ট। তারা কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার উপকরণ নিয়ে হাজির হচ্ছে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বস্তিতে। তারা কিশোরীদের হাতে জনে জনে তুলে দিচ্ছেন স্যানিটারি ন্যাপকিন। বুঝিয়ে দিচ্ছেন কৈশোরকালে শারীরবৃত্তীয় প্রক্রিয়া আর পিরিয়ড সংক্রান্ত হাইজিনের খুঁটিনাটি।
শিশু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে নারীদের প্রাকৃতিক এ শারীরিক প্রক্রিয়ার বিষয়টি নিয়ে লজ্জা আর সংকোচ কাজ করে বেশি। এ অবস্থায় সহযাত্রী হিসেবে কিশোরীদের পাশে অন্য কিশোরীদের দাঁড়ানোর বিষয়টি জনমনে আশার আলো জাগাবে। নেতিবাচক চিন্তা দূরে ঠেলে ইতিবাচক মনোভাব তৈরির জন্যও এমন উদ্যোগ বড় ভূমিকা রাখবে।
‘পরিবর্তনের দূত’ কিশোরীরা বলছেন, বাংলাদেশের সমাজে নারীদের মধ্যে বিশেষ করে পথশিশু, অসচ্ছল পরিবারের কিশোরী এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর কিশোরীদের মধ্যে, বিশেষ করে যাদের সদ্য পিরিয়ড শুরু হয়েছে, পিরিয়ড সংক্রান্ত নানা প্রতিবন্ধকতা এখনো বিদ্যমান রয়েছে। পিরিয়ডের ট্যাবু থেকে বের হতে না পারার কারণে তাদের অধিকাংশই নানা কুসংস্কার ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো থেকে বের হতে পারছে না। আবার অসচ্ছল পরিবারের কিশোরী এবং বস্তিতে থাকা কিশোরীদের মধ্যে এ বিষয়টি নিয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা নেই। ফলে তাদের বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির মুখে পড়তে হচ্ছে।
পরিবর্তনের দূত যখন কিশোরীরা
কিশোরীদের পিরিয়ড সংক্রান্ত সমস্যা থেকে উত্তরণে এগিয়ে এসেছেন অন্য কিশোরীরা। তাদেরই একজন লায়বা হোসেন প্রেরণা। ও লেভেলে অধ্যায়নরত লায়বা যুক্ত হয়েছেন সচেতনতামূলক কর্মকাণ্ডে। সুবিধাবঞ্চিত কিশোরীদের মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি, স্যানিটেশন সম্পর্কে শিক্ষিত করা আর কুসংস্কার ও অস্বাস্থ্যকর অভ্যাস নিয়ে সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছেন তিনি।
বাংলাদেশ জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার হোসেনের মেয়ে স্বেচ্ছাসেবী লায়বা ঢাকা পোস্টকে বলেন, পিরিয়ড বা মাসিক সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও প্রাকৃতিক ঘটনা। এটি মোটেও লজ্জার বা গোপনীয় কিছু নয়। কিন্তু বিষয়টি নিয়ে আমাদের সমাজে ট্যাবুর শেষ নেই। বিশেষ করে যারা অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, তাদের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে কোনো ধরনের সচেতনতাই নেই। তাদের মনোভাব এমন যে, বিষয়টি যত গোপন রাখা যায় তত ভালো। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই সময়ে যতটা সচেতন ও হাইজিন বজায় রেখে চলা যায় ততই মঙ্গল। আমরা বিভিন্ন জায়গায় এসব কিশোরীর সঙ্গে কথা বলে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করেছি। তাদের কৈশোরকালীন পরিবর্তন, বিশেষ করে পিরিয়ড সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে কাজ করে যাচ্ছি।
আরও পড়ুন
এই স্বেচ্ছাসেবী কিশোরী অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে তার কাজের অভিজ্ঞতাও জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আমরা যখন নিম্ন-মধ্যবিত্ত, বস্তি অথবা অসচ্ছল পরিবারের মেয়েদের সঙ্গে পিরিয়ড ও নারীর শারীরিক যত্নের ব্যাপারে কথা বলতে চাই, তখন তারা খুব সংকোচ বোধ করে। আর অধিকাংশ মেয়েরা জানেই না যে তারা পিরিয়ডের সময় কী ধরনের সতর্কতা অবলম্বন করবে। তাদের অনেকেই প্যাড ব্যবহার করে না। আবার তারা যে কাপড় ব্যবহার করে সেটিও ধোয়ার পর লোক লজ্জায় বাইরে শুকাতে দিতে পারে না। অথচ নিয়ম হচ্ছে কাপড় জীবাণুমুক্ত করে রোদে শুকানো। আমরা এসব বিষয়ে সতর্ক হওয়ার জন্য পরামর্শ দিই।
অনেকে সরাসরি এ কার্যক্রমে অংশ না নিলেও নিজের ঘর থেকেই সচেতনতা সৃষ্টিতে কাজ করছেন। বিষয়টি নিয়ে ঢাকা পোস্ট কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের স্নাতক পড়ুয়া শিক্ষার্থী সায়মা নাহার দিনার সঙ্গে। তিনি বলেন, আমার বাড়ির গৃহকর্মী যে মেয়েটি রয়েছে, তার এ সংক্রান্ত জ্ঞান একেবারেই কম। অধিকাংশ সময়ই পিরিয়ড চলাকালে সে অসংলগ্ন আচরণ করত। বিষয়টি নিয়ে আমি তার সঙ্গে খোলামেলা কথা বলি। বুঝতে পারি সে এ বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞ। স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার কিংবা হাইজিন মেনে চলার বিষয়টি সে একেবারেই মেনে চলে না। ফলে এরই মধ্যে নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা ও সমস্যায় ভুগতে হয়েছে তাকে। এমন কথা শুনে আমি আমার বড় বোনের মাধ্যমে তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করি। পরে নিয়মিত পরিচর্যায় তার পিরিয়ড স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এসেছে। বিষয়টি আমি আমার অন্য সহপাঠীদেরও বলেছি, যাতে তারাও নিজেদের জায়গা থেকে অন্যদের ব্যাপারে সচেতন হতে পারে।
কিশোরীরাই সচেতন করবে অন্য কিশোরীদের– এমন কর্মসূচি শুরু হয়েছে সামাজিক সেবামূলক সংগঠন জেসিআই বাংলাদেশের উদ্যোগে। ‘কুসুমকথা : ব্রেকিং আউট অব পিরিয়ড পোভার্টি’ প্রজেক্টের আওতায় অসচ্ছল পরিবারের কিশোরীদের সচেতন করার পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে পরামর্শও। আর এক্ষেত্রে মূল ভূমিকা পালন করছে কিশোরীরা।
সংগঠনটির প্রজেক্ট ডিরেক্টর সিগমা হায়দার বলেন, বাংলাদেশের সমাজে নারীদের পিরিয়ড সংক্রান্ত নানা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। নারীদের এ সমস্যা থেকে উত্তরণে কিশোরীরা কাজ করছে। আমরা নয়াটোলা মডেল কামিল মাদ্রাসায় ও আহসানিয়া মিশনের এতিমখানায় সুবিধাবঞ্চিত কিশোরীদের মাসিকের স্বাস্থ্যবিধি এবং উপযুক্ত স্যানিটেশন সম্পর্কে শিক্ষিত করা, কুসংস্কার এবং অস্বাস্থ্যকর অভ্যাসগুলো নিয়ে সচেতন করেছি। যেখানে মূল ভূমিকা পালন করেছে কিশোরীরা। আমরা চাই সব বাধা দূরে চলে যাক। কিশোরীদের মাধ্যমেই গড়ে উঠুক নতুন এক সম্ভাবনাময় পথচলা।
সচেতনতায় কাজ করতে হবে সবাইকে
চিকিৎসকরা বলছেন, পিরিয়ডের প্রথম দিকে কিশোরীদের শারীরিক যত্নের সঙ্গে সঙ্গে মানসিক স্বাস্থ্যেরও ভালো যত্ন নিতে হবে। কিন্তু দেশের অধিকাংশ কিশোরীই এখন পর্যন্ত বিষয়টি চেপে রাখতে বা গোপন রাখতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে।
এ বিষয়ে ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের প্রভাষক ডা. নাঈমা নাহার মিতু বলেন, পিরিয়ডের সময় মেয়েদের খুব বেশি মুড বা মেজাজ পরিবর্তন হয়। একইসঙ্গে অন্যান্য উপসর্গ যেমন– পেট ব্যথা, মাথাব্যথা, সবকিছুতে বিরক্ত বোধ করা, খাবার খেতে ইচ্ছে না করা, হাঁটাচলা করতে ইচ্ছে না করা, মেজাজ খিটখিটে থাকাসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সবচেয়ে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হয় তার মায়ের। আপনজন হিসেবে খোলামেলা আলোচনার মাধ্যমে পিরিয়ডের সময়ের সতর্কতা ও শরীরের যত্ন সম্পর্কে ধারণা দিতে হয়। আবার অনিয়মিত কিংবা অন্য সমস্যার জন্য ডাক্তারের পরামর্শের ব্যবস্থাও করতে হয়।
পিরিয়ডের বয়স সম্পর্কে তিনি বলেন, আমাদের দেশে সাধারণত ১০-১৬ বছর বয়সে কিশোরীদের প্রথম পিরিয়ড হয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে শারীরিক গঠন, ভৌগোলিক পরিবেশ ও বয়সের তারতম্যের কারণে সময়টি আগে-পিছে যেতে পারে। হরমোনের কারণেও কিছু সময় সমস্যা তৈরি হয়। এতে করে অনেক সময় মেয়েরা মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে।
এই চিকিৎসকের মতে, এ অবস্থায় শুধু মা নয়, পরিবারের অন্য সদস্য– বড় বোন, সমবয়সি বন্ধু কিংবা কাছাকাছি বয়সের অন্য কিশোরীরাও সচেতনতা তৈরি করতে পারে।
আরএইচটি/এসএসএইচ