বৃষ্টি ছাড়াই কালো পানিতে ডুবে আছে পুরান ঢাকা
শেষ সময় চলছে বাংলার কার্তিক মাসের, এই সময়ে ঝড়-বৃষ্টি, মেঘ কিছুই তেমন থাকে না। আর এই মৌসুমে কোথাও বৃষ্টিও হয়নি। তবু পুরান ঢাকার অলিগলিসহ সর্বত্রই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এটা স্বাভাবিক জলাবদ্ধতা নয়, নোংরা-কালো ও মলযুক্ত পানিতে জলাবদ্ধতা। একদিন দুইদিনের নয় এটি, বিগত ৪ দিন ধরে নিয়মিত এ জলাবদ্ধতা ও নোংরা পানি দেখা দিয়েছে।
ঘটনার সূত্রপাত গত ৩ নভেম্বর (শুক্রবারে) থেকে। হঠাৎ ভোরের দিকে পুরান ঢাকার অলিগলিসহ সড়ক কালো-নোংরা পানিতে জলাবদ্ধতায় রূপ নেয়। কেউ বুঝে উঠতে পারেনি অসময়ের হঠাৎ এমন জলাবদ্ধতা কোথা থেকে এলো? সেইদিন থেকে শুরু হয়ে এখন প্রতিদিন ভোর ৪টা থেকে ৫টার দিকে এমন জলাবদ্ধতা শুরু হচ্ছে, আর পানি নেমে যাচ্ছে দুপুর ১টা-২টার দিকে। যদিও গতকাল রোববার এই জলাবদ্ধতা ছিল বিকেল পর্যন্ত।
পুরান ঢাকার বংশাল, আরমানিটোলা, বাংলাদেশ মাঠ, আগামাসীহ লেন, মকিমবাজার, নাজিমুদ্দিন রোড, মাজেদ সরদার রোড, নিমতলীসহ আশপাশের পুরো এলাকায় এই জলাবদ্ধতা বেশি দেখা গেলেও মৌলভী বাজার, আজিজুল্লাহ রোড, বেগম বাজার, আবুল হাসনাত রোড, পদ্মলোচন রায় লেন, কে,এম আজম লেন, নুর বক্স লেন, আলী হোসেন খান রোড, নাবালক মিয়া লেন, আর্মেনীয়াম স্ট্রিট, আবুল খায়রাত রোড, কেদৗর নাথ দে লেন, আগা নওয়াব দেউড়ী, বেচারাম দেউড়ী, হাফিজ উল্লাহ রোড, গোলাম মোস্তফা লেন, ডি,সি, রায় রোড, শরৎচন্দ্র চক্রবর্ত্তী রোড, এ, সি, রায় রোড, জেলা রোড, দিগু বাবু লেন, মকিম কাটারা, বি,কে, রায় লেন, সেন্ট্রাল জেল, যোগেন্দ্র নারায়ণ শীল স্ট্রিট, বংশাল রোড, কে,পি, ঘোষ স্ট্রিট, কসাইটুলী, গোবিন্দ দাস লেন, সৈয়দ হাসান আলী লেন, পি, কে, রায় লেন, হাজী আ. রশিদ লেন, রায় বাহাদুর ঈশ্বর চন্দ্র ঘোষ স্ট্রিট, কাজী জিয়া উদ্দীন রোড, সামসাবাদা লেন, শাহজাদা মিয়া লেন, গোপী নাথ দত্ত কবিরাজ স্ট্রিট ও হরনী স্ট্রিট, বাগডাসা লেন, হায়বাৎ নগর লেন শরৎচক্রবর্তী রোড কাজী মুদ্দিন সিদ্দিকী লেন, আকমল খান রোড, জিন্দবাহার লেন, জুমবালী লেন, নেকী দেউরী, আব্দুল হাদী লেন, নবাব কাটারা, চানখার পুল লেন, আগামসীহ লেন, শিক্কাটুলী লেন, আগা সাদেক রোড, বি, কে, গাঙ্গুলী লেন, আবুল হাসনাত রোড এলাকার বিভিন্ন অলিগলি, সড়কে এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। আর নোংরা পানিতে এই জলাবদ্ধতা হওয়া এলাকাগুলো পড়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩১, ৩২ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওতায়।
পুরান ঢাকার আরমানিটোলার বাসিন্দা সৈয়দ মঞ্জুর এলাহী বলেন, গত ৩ নভেম্বর ভোরে নামাজ পড়তে বের হলে প্রথমে এমন জলাবদ্ধতা দেখতে পাই। গত ১০/১১ দিন ধরে এমন কালো ও মল ভেসে থাকাসহ পানি দেখা যায়। এখন প্রতিদিন ভোর থেকে এমন জলাবদ্ধতা হয়ে দুপুর পর্যন্ত থাকছে। এতে করে আমাদের এলাকাবাসীদের খুবই বিড়ম্বনা হচ্ছে, এসব পানি মারিয়েই মানুষকে কাজে যেতে হচ্ছে।
পুরান ঢাকার আগামাসীহ লেনের ব্যবসায়ী সিদ্দিকুর রহমান বলেন, প্রতিদিন এমন নোংরা পানির কারণে একে তো এলাকাবাসীর ভোগান্তি অন্যদিকে আমাদের মতো যারা সাধারণ ব্যবসায়ী আছি তাদের ব্যবসা পরিচালনা করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে। কোথা থেকে এমন নোংরা পানি আসছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না যে কারণে জলাবদ্ধতা থাকাকালীন কোনো কাস্টমার আসছে না দোকানে। মলযুক্ত এসব পানি পেরিয়ে মানুষকে চলাচল করতে হচ্ছে।
নাজিমুদ্দিন রোডের বাসিন্দা খন্দকার খাইরুল আমল বলেন, গত কয়েকদিন ধরে আমাদের এলাকাসহ আশপাশের এলাকায় এমন নোংরা পানির জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আমরা কয়েকজন এলাকাবাসী মিলে ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ে গিয়েছিলাম সেখান থেকে তারা জানিয়েছে বুড়িগঙ্গা মিলিত হওয়া লাইনে সংস্কারের কাজ চলছে। আর কাজ চলাকালীন লাইন বন্ধ করে রাখার ফলে এই নির্দিষ্ট সময়ে পুরান ঢাকা এলাকায় এমন জলাবদ্ধতা হচ্ছে। মলযুক্ত নোংরা পানিতে জলাবদ্ধতায় আমরা খুব বিড়ম্বনার মধ্যে দিন অতিবাহিত করছি। দ্রুত এই সমস্যার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের এলাকায় চলাফেরা করাই কঠিন হয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
সার্বিক বিষয় নিয়ে কথা হয় জলাবদ্ধতার আওতায়াধীন ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ৩৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. আওয়ালের সঙ্গে। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, গত কিছুদিন ধরে আমাদের পুরো এলাকাজুড়ে এমন জলাবদ্ধতা হচ্ছে। আমাদের যে বুড়িগঙ্গার ড্রেনেজ লাইনটা আছে সেটা অনেক পুরাতন, ঠিক মতো কাজ করে না। লাইনটা ভালো করার কাজ চলছে। যখন লাইনটা বন্ধ করে কাজ করা হচ্ছে সে সময় এমন জলাবদ্ধতা হচ্ছে। এই কারণে আমাদের এলাকায় কিছু সময়ের জন্য এমন জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে, এতে পুরো এলাকার মানুষ খুবই সমস্যার মধ্যে আছে। নোংরা পানির মধ্যে আমাদের চলাচল করতে হচ্ছে। আমার ওয়ার্ড সহ আশপাশের ওয়ার্ডগুলোও একই সমস্যার মধ্যে পড়েছে। আমরা আমাদের পক্ষ থেকে বারবার তাগিদ দিয়েছি যেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই কাজ শেষ করা হয়। আশা করা যাচ্ছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বাকি কাজটা শেষ হয়ে যাবে। আর এই কাজ শেষ হলে পুরান ঢাকা এলাকায় আর জলাবদ্ধতা সেভাবে হবে না।
জলাবদ্ধতার বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার মডস জোন ২ এর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, পুরান ঢাকার জলাবদ্ধতার বিষয়টি সম্পর্কে আমরা অবগত। বুড়িগঙ্গার সঙ্গে যে ড্রেনেজ লাইন আছে সেখানে মূলত কাজ চলছে। আর এই কারণেই গত কিছুদিন ধরে পুরান ঢাকা এলাকায় জলাবদ্ধতা হচ্ছে। ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ওই এলাকার জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য নিজস্ব প্রকল্পের আওতায় কাজটা করছে। এই কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত এলাকাবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হবে। এছাড়া বুড়িগঙ্গার লাইন, বাবুবাজার ব্রিজ অংশে ড্রেনেজ ব্যবস্থার কাজ হলে পুরান ঢাকা ওইসব এলাকায় আর জলাবদ্ধতা দেখা দেবে না। এক সময় এসব ড্রেনেজ লাইন আমাদের ঢাকা ওয়াসার আওতায় ছিল, এরপর ২০২০ সালের পর থেকে এগুলো ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের আওতায় চলে গেছে।
জানা গেছে, এক সময় ঢাকা মহানগরীর প্রধান প্রধান ড্রেন লাইন নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছিল ঢাকা ওয়াসার। শাখা লাইনগুলোর দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের ওপর ন্যস্ত ছিল। ওই সময় রাজধানীর মোট ড্রেনেজ লাইনের মধ্যে ৩৮৫ কিলোমিটার ঢাকা ওয়াসার অধীন এবং প্রায় দুই হাজার ৫০০ কিলোমিটার ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের অধীনে ছিল। এর বাইরে ৭৪ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ২৬টি খাল ও ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্টের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বও ছিল ঢাকা ওয়াসার। যে কারণে বর্ষায় সৃষ্ট জলাবদ্ধতা নিরসনে সংস্থাগুলো একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর সুযোগ পেত। কিন্তু ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর থেকে ওয়াসার দায়িত্বে থাকা সব নালা ও খাল দুই সিটি কর্পোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
এএসএস/এমএ