ডেঙ্গু সংকট: রাজনৈতিক গুরুত্ব পায়নি, দায় চাপানো হয়েছে জনগণের ওপর
২০২৩ সালে বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ব্রাজিল ব্যতীত অন্য দেশের প্রায় সমপর্যায়ের হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ও মৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম। তারপরও রাজনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। এমনকি দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অস্বীকার করা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে দায়ভার জনগণের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
সোমবার (৩০ অক্টোবর) রাজধানীর ধানমন্ডির ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ - টিআইবির নিজস্ব কার্যালয়ে ‘ডেঙ্গু সংকট প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম : সুশাসনের চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
রাজধানীসহ ১০টি জেলার ওপরে করা গবেষণাটি সংস্থাটির গবেষক রাজিয়া সুলতানা ও জুলকারনাইন উপস্থাপন করেন।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যানুসারে– প্রতি বছর ১০০টি দেশে প্রায় ৪০ কোটি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। বাংলাদেশে ২০১৭ সাল থেকে ডেঙ্গুর ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং ২০২৩ সালে এর ভয়াবহ প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। ২৫ অক্টোবর পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৬১ হাজার এবং মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার ২৯৫ জন। যদিও বিশেষজ্ঞ মতে প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা সরকার প্রদত্ত সংখ্যার চেয়ে ১০ গুণ বেশি।
গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২৩ সালে সর্বাধিক ডেঙ্গু আক্রান্ত ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম; বাংলাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ব্রাজিল ব্যতীত অন্য দেশের প্রায় সমপর্যায়ের হলেও মৃত্যুর সংখ্যা ও মৃত্যুর হারের দিক থেকে বাংলাদেশ প্রথম। ডেঙ্গুকে রাজনৈতিকভাবে ও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক সংকট হিসেবে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জাতীয় সংসদে বিরোধী দল কর্তৃক ডেঙ্গু বিষয়ক উদ্বেগ তুলে ধরা হলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কর্তৃক বাংলাদেশে অন্য দেশের মতোই ডেঙ্গু সংকট বিরাজ করছে দাবি করে বিষয়টি এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন
এ বিষয়ে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডেঙ্গু সংকট মোকাবিলায় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা ও দেশের বিদ্যমান আইন অনুযায়ী সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের পক্ষ থেকে ডেঙ্গুর ভয়াবহতা অস্বীকার করা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হয়েছে।
তিনি বলেন, দেশে ডেঙ্গুর প্রকোপ ধারাবাহিকভাবে সারা বছরব্যাপী বিদ্যমান থাকলেও এই রোগ প্রতিরোধে রাজনৈতিকভাবে পর্যাপ্ত গুরুত্ব প্রদান করা হয়নি; আইন অনুযায়ী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড ও আন্তর্জাতিক চর্চা অনুসরণ না করা এবং বাংলাদেশের করোনা সংকট মোকাবিলার অভিজ্ঞতাকে কাজে না লাগিয়ে সমন্বয়হীনভাবে ডেঙ্গু প্রতিরোধ এবং মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
টিআইবির গবেষণার বলা হয়, ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের বিভিন্ন পর্যায়ে সুশাসনের ঘাটতি অব্যাহত রয়েছে। যা সুনির্দিষ্ট কৌশলবিহীন ও বিচ্ছিন্নভাবে পরিচালিত ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম কার্যকর না হওয়ার এবং বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হওয়ার অন্যতম কারণ।
গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, কীটনাশক ক্রয়ে ওপেন টেন্ডারিং ও সরাসরি ক্রয় প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হলেও ইজিপির মাধ্যমে ওপেন টেন্ডারিংয়ের কিছু ক্ষেত্রে ‘সিঙ্গেল বিডিং’ লক্ষ করা গেছে; একটি কীটনাশক সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ওপেন টেন্ডারিংয়ের মাধ্যমে তিনটি সিটি কর্পোরেশনের ১৬টি ক্রয়াদেশ পায়, যার মধ্যে সাতটিতে তারা একক বিডার ছিল। কীটনাশক ক্রয়ের ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য লক্ষ করা যায় এবং এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিম্নমানের কীটনাশক সরবরাহের অভিযোগ রয়েছে। জালিয়াতির মাধ্যমে আমদানি করা নিবন্ধনবিহীন কীটনাশক যথাযথভাবে পরীক্ষা না করেই মশা নিধন কার্যক্রমে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে।
এতে বলা হয়, ঢাকার বাইরে ডেঙ্গু পরীক্ষার সুবিধা অপ্রতুল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সসহ পৌরসভা এলাকার বিভিন্ন হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ডেঙ্গু কিট সংকট লক্ষ করা গেছে। একজন জটিল ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা ব্যয় সরকারি হাসপাতালে একদিনে গড় খরচ ৭ হাজার ১৪২ টাকা এবং বেসরকারি হাসপাতালে আইসিউসহ দৈনিক ৭০ থেকে ৮০ হাজার টাকা, সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবায় সংকট থাকায় প্রায় ১০ গুণ অর্থ ব্যয় করে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা নিতে বাধ্য হয়েছেন রোগীরা।
গবেষণায় বলা হয়, ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরুতে ঢাকাসহ কয়েকটি শহর কেন্দ্রিক থাকলেও বর্তমানে তা দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এবং বছরব্যাপী অব্যাহত থাকার অন্যতম কারণও হচ্ছে মশা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে সুশাসনের ঘাটতি। ঢাকার বাইরে এডিস মশা প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ ও ডেঙ্গু রোগের পর্যাপ্ত চিকিৎসা ব্যবস্থা না থাকা এবছর আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক আকার ধারণ করার অন্যতম কারণ।
আরএম/এসএসএইচ