গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে প্রধানমন্ত্রী, প্রত্যাশা কী?
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ওরসুলা ভনের আমন্ত্রণে গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের প্রথম সম্মেলনে যোগ দিতে ব্রাসেলস গেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। জাতীয় নির্বাচনের প্রায় আড়াই মাস আগে সরকারপ্রধানের এ সফর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর এ সফরে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার বিষয়টি বেশি গুরুত্ব পাওয়ার ইঙ্গিত রয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে প্রধানমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো বাংলাদেশের নেতৃত্বকে গুরুত্ব দেওয়া। বেশকিছু কারণে সরকারপ্রধানের এ সফর খুব গুরুত্ব বহন করছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর ইউরোপিয়ান কমিশনের কোনো হাই-প্রোফাইল সম্মেলনে প্রথম অংশগ্রহণ হতে যাচ্ছে। এ সফর বাংলাদেশের গ্লোবাল গেটওয়ে তহবিলে যুক্ততা, ইইউর শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক এবং ইইউর সঙ্গে সম্পর্ককে নতুন কলেবরে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে।
ঢাকার এক কূটনীতিক বলেন, ২০২১ সালে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন গ্লোবাল গেটওয়ে উদ্যোগের ঘোষণা দেয়। এ উদ্যোগের আওতায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন, সদস্য রাষ্ট্র ও অন্য অংশীদাররা অগ্রাধিকার খাতগুলোতে ২০২১-২০২৭ সালের মধ্যে মোট ৩০০ বিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগ করার ঘোষণা দেয়। প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফরে বাংলাদেশের গ্লোবাল গেটওয়ে তহবিলে যুক্ততার সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এ আয়োজনে ইইউর কয়েকটি দেশের সরকার বা রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে প্রধানমন্ত্রীর।
এ কূটনীতিক বলেন, ইইউ বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা বলছে। ইইউর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকে নির্বাচন প্রসঙ্গ আসার সম্ভাবনা রয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার বিষয়ে তার সরকারের প্রতিশ্রুতির কথা ইইউর নেতাদের কাছে হয়তো তুলে ধরবেন।
ইইউর কিছু এমপি ইইউ পার্লামেন্টের ভাইস-প্রেসিডেন্ট জোসেফ বোরেল বরাবর চিঠি লিখেছেন। তারা বাংলাদেশে মানবাধিকার এবং নির্বাচন প্রসঙ্গ সামনে নিয়ে এসেছেন। শুধু তাই নয়, গত মাসে ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে উদ্বেগ জানিয়ে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেই প্রস্তাবে বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশসহ বিচারবহির্ভূত হত্যা, বলপূর্বক অন্তর্ধান বা গুম, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও শ্রমিকদের অধিকার খর্ব করার কথা তোলা হয়েছে।
আরও পড়ুন
কূটনৈতিক সূত্র বলছে, গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামে অংশগ্রহণকে কাজে লাগাতে চাইবেন প্রধানমন্ত্রী। ব্রাসেলসে ইইউর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে হওয়া বৈঠক রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে চাইবেন তিনি। এক্ষেত্রে ইইউ বা এর পার্লামেন্টে বাংলাদেশে নির্বাচন এবং মানবাধিকার ইস্যুতে যেসব কথা উঠেছে, সরকারপ্রধান তার নিজের অবস্থান থেকে সেগুলো তুলে ধরার সুযোগ পাবেন।
নির্বাচনের ঠিক আগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর ব্রাসেলস সফর ক্ষমতাসীনদের জন্য কতটা গুরত্বপূর্ণ তার ইঙ্গিত রয়েছে পররাষ্ট্রমন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্যেও। গত রোববার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রধানমন্ত্রীর সফর নিয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, কঠিন সময়ে প্রধানমন্ত্রী এ সফরে যাচ্ছেন। অবশ্য ‘কঠিন’ সময়ের ব্যাখ্যায় মন্ত্রী বলেন, এ সময় জনগণের কাছে থাকতে পারলে সময়টা কাজে লাগানো যেত।
তার দুই দিনের মাথায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পাঁচ বছরের অর্জন নিয়ে এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম নির্বাচনের আগ মুহূর্তে প্রধানমন্ত্রীর দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কম থাকাও সত্ত্বেও সরকারপ্রধানের গুরুত্ব বাড়ায় এ সফর করতে হচ্ছে বলে জানান।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ওয়ালিউর রহমান ঢাকা পোস্টকে বলেন, সময়টা খুব ভালো হলো। এটা আমাদের জন্য ভালো খবর। প্রধানমন্ত্রী ইইউর শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। যারা আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলেছিল, তাদের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা হবে। সেই বিবেচনায় মিটিংগুলো খুব ভালো সময়ে হচ্ছে। ওদের মনে যত সন্দেহ আছে- যেমন অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে; সেটা প্রধানমন্ত্রী নিজে গিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে আসতে পারবেন। সেই কারণে এটা ভালো সফর হবে। আর নির্বাচনে ইইউতো নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
রোববার প্রধানমন্ত্রীর সফর প্রসঙ্গে ড. মোমেন জানান, ব্রাসেলস সফরে সরকারপ্রধান গ্লোবাল গেটওয়ে ফোরামের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন এবং বক্তৃতা করবেন। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট ওরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার দে ক্রো এবং লুক্সেমবার্গের প্রধানমন্ত্রী জেভিয়ার বেটেলের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে মিলিত হবেন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন তাদের ৫০ বছরের অংশীদারিত্ব নতুন উচ্চতায় উন্নীত করার ঘোষণা দেবেন বলে আশা করা যায়।
জানতে চাইলে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফায়েজ বলেন, নানান কারণে নানা ভ্রান্তি হচ্ছে। ইইউতে আমাদের ভাবমূর্তিটাকে খারাপ করার চেষ্টা করছে একটা মহল। আমাদের যে দোষ নাই সেটা কিন্তু নয়। তাই বলে নিজের দেশের বিরুদ্ধে বিদেশিদের কাছে নালিশ করাটাও কিন্তু ঠিক হচ্ছে না। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে বাংলাদেশ নিয়ে যে প্রস্তাব হয়েছে, পরে আবার ওটা নিয়ে আলাপ-আলোচনা হয়েছে; দেখা গেছে- ওগুলো মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। এসব বিষয়ে কথা বলার সুযোগ থাকবে বাংলাদেশের। এতে করে মানুষের মনে যে ভুল ধারণা সৃষ্টি করা হচ্ছে সেখান থেকে কিছুটা হলেও সরে যাওয়ার সুযোগ হবে।
মুনশি ফায়েজ বলেন, ইইউর সঙ্গে আমাদের সম্পর্কটা সবসময় গুরত্বপূর্ণ। যেভাবে হোক সেটাকে আরও সামনে নিয়ে যাওয়া বা গুরুত্ব দেওয়া আমাদের জন্য ভালো। ইইউ বাংলাদেশে বিনিয়োগ করতে চায়। ইইউর সঙ্গে আমরাও বিভিন্ন রকমের সহযোগিতায় যুক্ত হতে চাই। এটা দেশের জন্য অত্যন্ত মঙ্গলজনক।
ইউরোপীয় ঋণ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্রাসেলস সফরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ ও ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মধ্যে বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে ৩৫০ মিলিয়ন ইউরোর একটি ঋণ সহায়তা চুক্তি সই হবে। এছাড়া বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে অনুদান হিসেবে প্রদানের জন্য ইউরোপিয়ান কমিশন এবং ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের মধ্যে ৪৫ মিলিয়ন ইউরোর একটি চুক্তি এবং বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের মধ্যে ১২ মিলিয়ন ইউরোর একটি অনুদান চুক্তি সই হবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, ইউরোপিয়ান ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক ইতোমধ্যে বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তন ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে বিনিয়োগের আগ্রহ ব্যক্ত করেছে। এ চুক্তিটি বাংলাদেশে ব্যাংকটির অধিকতর বিনিয়োগের পথ প্রসারিত করবে বলে আশা করা যায়। এ সফরের সময় বাংলাদেশ সরকার এবং ইউরোপিয়ান কমিশনের মধ্যে বাংলাদেশের সামাজিক খাতে ৭০ মিলিয়ন ইউরোর পাঁচটি আলাদা অনুদান চুক্তি সই হবে।
এনআই/এমজে