ভিসা বিধিনিষেধ সুষ্ঠু নির্বাচনে কতটা সহায়ক হবে বা হবে না
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ দেখতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই লক্ষ্যে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ শুরু করেছে দেশটি। তবে ভিসা বিধিনিষেধ সুষ্ঠু নির্বাচনে কতটা সহায়ক ভূমিকা রাখবে বা আদৌ এটি কোনো ভূমিকা রাখবে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশিদের চাওয়ায় সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হলে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বোঝাপড়া দরকার। এক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপিকে ভূমিকা রাখতে হবে। আসতে হবে সমঝোতায়।
আরও পড়ুন : ভিসা নীতিতে কাকে নিষিদ্ধ করেছে, তা জানি না : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ শুরুর ঘোষণা দেওয়ার পর আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা বিএনপির ওপর এর দায় চাপাচ্ছেন। অন্যদিকে এজন্য সরকারকে এককভাবে দায়ী করছে বিএনপি। এছাড়া দুই দল পুরোনো কায়দায় ভিসা নীতিতে একে অন্যের ক্ষতি দেখছেন। তবে কারা ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় এসেছে তা গোপন থাকায় অস্বস্তি রয়েছে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলেই। কেননা, ভিসা বিধিনিষেধের আওতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপশি সরকারি ও বিরোধী দলের নেতারা রয়েছেন বলে যুক্তরাষ্ট্র জানিয়ে দিয়েছে।
ভিসা বিধিনিষেধ প্রয়োগ অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সহায়ক হবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল কুগেলম্যান। তিনি সামাজিক মাধ্যম এক্স-এ (সাবেক টুইটার) এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ভিসা বিধিনিষেধ বাংলাদেশে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে কি না তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিজাতদের মধ্যে অনেকের পরিবার যুক্তরাষ্ট্রে আছে। তবে ক্ষমতাসীন দল শেষ পর্যন্ত যেকোনো মূল্যে ক্ষমতায় থাকতে চায়। তাই ভিসা নীতি কাজ করবে কি না তা নিয়ে আমি নিশ্চিত নই।
আরও পড়ুন : যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি পুলিশের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, যখন ভিসা নীতির ঘোষণা এসেছিল, তখন একটা চাপা অস্বস্তি ও আতঙ্ক ছিল একদিকে; অন্যদিকে ছিল উল্লাস। এখন ভিসা বিধিনিষেধ কার্যকর শুরুর ঘোষণা আসার পর সেরকম মনে হচ্ছে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর বোঝাপড়ার ভিত্তিতে। ভিসা বিধিনিষেধের মতো পদক্ষেপ থেকে খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করা যাবে না। নির্বাচন সুষ্ঠু হবে দুই পক্ষের ঐকান্তিক ইচ্ছাতে। এখানে দুই পক্ষের দায়িত্ব রয়েছে। এ বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দলেরও দায়িত্ব রয়েছে।
আরও পড়ুন : ভিসা বিধিনিষেধ আসা নিয়ে সরকার চিন্তিত নয়
অধ্যাপক শান্তনু মজুমদার বলেন, সরকারি দলকে যেটা করতে হবে সেটা হলো নির্বাচনের জন্য একটা সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরি করা; সেখানে তাদের সঠিক ভূমিকা পালন করা। আর বিরোধী দলকে সংঘাত থেকে বেরিয়ে আসা বা সংবিধান ও গণতন্ত্র সমর্থন করে না এমন কোনো দাবিতে অনড় না থাকা; যদি তাদের থেকে থাকে। সেটা থেকে বেরিয়ে এক দফাতে যাওয়া। সরকারি দল ও বিরোধী দলের বোঝাপড়াটা এখানে প্রাইম ইস্যু। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধে বাংলাদেশের নির্বাচন সুষ্ঠু হবে এটা আমার কাছে মনে হয় না। এটা হয়তো এক ধরনের প্রচ্ছন্ন মনস্তাত্ত্বিক চাপ হিসেবে থাকলেও থাকতে পারে।
চলতি বছরের মে মাসে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশের জন্য নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেন। সেখানে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের বিষয়ে দেশটির অব্যাহত নজরদারির বিষয়টি স্পষ্ট করেন।
আরও পড়ুন : ভিসা বিধিনিষেধ সুষ্ঠু নির্বাচনে ভূমিকা রাখবে
ভিসা নীতিতে বলা হয়, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত ব্যক্তিদের ভিসা দেবে না যুক্তরাষ্ট্র। ওই ভিসা নীতি ঘোষণার চার মাসের মাথায় ভিসা বিধিনিষেধ কার্যকর শুরু করলে দেশটি। কারা এর আওতায় পড়েছে তা প্রকাশ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। তবে বাংলাদেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য, ক্ষমতাসীন দল এবং বিরোধী দলের সদস্যরা বিধিনিষেধের আওতায় পড়েছে বলে জানিয়ে দিয়েছে তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী এ প্রসঙ্গে বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে কি না তা নির্ভর করবে আমাদের দেশের যেসব রাজনৈতিক দল মাঠে সক্রিয় তাদের ওপর। একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপি লড়াই করছে। আওয়ামী লীগ সুষ্ঠু নির্বাচন করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। যারা নির্বাচন বাধাগ্রস্ত করবে তারা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ভিসা বিধিনিষেধকে চাপ মনে করার কোনো কারণ নেই। এটাকে রাজনৈতিক চাপ মনে না করে রাজনৈতিক রক্ষাকবচ হিসেবে দেখতে হবে।
অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, বাংলাদেশে যেন গণতন্ত্রের উত্তরণ ঘটে সে জায়গা থেকে ভিসা নীতিকে ইতিবাচক হিসেবে দেখা উচিত। এটা অপরের বিরুদ্ধে চাপিয়ে দেওয়া বা দোষ দেওয়ার কিছু নেই। বিএনপি যদি বলে আমরা নির্বাচন করতে দেব না, তাহলে ভিসা বিধিনিষেধে বিএনপি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। একইভাবে আওয়ামী লীগ যদি উল্টা-পাল্টা নির্বাচন করে সেক্ষেত্রে তাদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ হবে।
আরও পড়ুন : ভিসা নীতি ঘোষণার পর পর্যালোচনা করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হচ্ছে : লু
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. শামছুল আলম বলেন, এটা শুধু বিদেশিদের দিয়ে হবে না। আমাদের দেশের যেসব রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলন করছে তাদের যথাযথ ভূমিকা থাকতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা বিধিনিষেধে কতটুকু কাজ হবে তা এখনও নিশ্চিত করে বলা যাবে না। তবে সরকার কিছুটা চাপে পড়বে।
শামছুল আলম বলেন, আমরা শুনেছি, অক্টোবর মাসে পুলিশ ডেপ্লয় করার জন্য ক্ষমতাসীনরা বিভিন্ন জায়গায় চিঠি দিয়েছে। এটা নিয়ে আমরা শঙ্কিত। সাম্প্রতিক সময়ে আওয়ামী লীগের কিছু নেতা কিছু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বক্তব্য দিয়েছেন, যেগুলো রাজনৈতিক অঙ্গনের জন্য অ্যালার্মিং। সরকার কিছুটা চাপের মধ্যে আছে। যদিও তারা বলছে, এটা দিয়ে কিছুই হবে না।
ভিসা নীতি নিয়ে প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের একে অন্যের ওপর দায় চাপানোর প্রশ্নে অধ্যাপক শামছুল আলমের ভাষ্য- এটা আমাদের সংস্কৃতি। তবে সরকারি দলের ওপর দোষটা বেশি বর্তায়। ২০১৪ এবং ১৮’র নির্বাচনের কারণে দায়টা সরকারের ওপর অবশ্যই বেশি। সেজন্য চাপটা তাদের দিকে বেশি হবে। বিএনপিকে ছাড় দিতে হবে।
এনআই/এসএম