এডিসি হারুন ছাড়া নির্যাতনকারী পুলিশ সদস্যরা ছিল মুখোশ পরা
ছাত্রলীগ নেতা আনোয়ার হোসেন নাঈমকে নির্যাতন করা হয় শাহবাগ থানার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে। সেখানে ডিএমপির রমনা জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশীদের উপস্থিতিতে তদন্ত নেতৃত্বে ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য হামলে পড়েছিল নাঈমের ওপর। তারা প্রত্যেকেই ছিলেন মুখোশ পরা। পোশাক থেকে সরানো ছিল নেমপ্লেট।
জ্ঞান হারানোর আগে মুখোশ টেনে পরিদর্শক (তদন্ত) চিনতে পেরেছিলেন নাঈম। এরপর তিনি নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল শাখার সভাপতি নাঈম। কিন্তু তাতে নির্যাতন কমেনি, উল্টো বেড়েছে, নির্যাতনে একসময় জ্ঞান হারান নাঈম।
সে রাতে শুধু নাঈম নয়, নাঈমের আগে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হক মামুন, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে। শাহবাগ থানায় তারাও পুলিশের হাতে মারধরের শিকার হন।
পুলিশের হাতে নির্মম নির্যাতনের শিকার নাঈমের বক্তব্যে ও ঘটনার সময় থানায় উপস্থিত এক পুলিশ সদস্যের দেওয়া বক্তব্যে এ ভয়ঙ্কর তথ্য উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন : মানুষ পেটানোয় ওস্তাদ এডিসি হারুন, পিটিয়েছেন পুলিশও!
নির্যাতনে আহত নাঈমকে প্রথমে ঢামেক হাসপাতাল, এরপর মালিবাগের ডা. সিরাজুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখান থেকে রোববার রাতেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডেন্টাল বিভাগে ভর্তি করা হয়।
নাঈম আগেই ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছিলেন অ্যাডমিন ক্যাডার আজিজুল হক মামুন এলাকার বড় ভাই। তাদের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরে। শনিবার রাতে মামুনই কল করে শাহবাগে আসতে বলেন তাকে।
নাঈম জানান, আমি আর শরীফ আহমেদ মুনিম শাহবাগে গিয়ে দেখি, মামুন ভাই বারডেমের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। আমরা মামুন ভাইয়ের কাছে যেতে যেতেই উনি বারডেমের কার্ডিওলজি বিভাগের দিকে চলে যান। আমরাও যেতে থাকি তার পেছন পেছন। সেখানে গিয়ে দেখি, এডিসি হারুন ও মামুন ভাই কথা কাটকাটি করছেন। আমি আর মুনিম বিষয়টি মীমাংসা করে দিই।
আরও পড়ুন : এবার হারুনকে এপিবিএন-এ বদলি
নাঈম বলেন, পরে একদল পুলিশ সদস্য ডেকে এডিসি হারুন মামুন ও মুনিমকে শাহবাগ থানায় নিয়ে যায়। সেখবর পাওয়ার পর আমি নিজেও থানায় যাই।
থানায় ঢুকতেই এডিসি হারুনের মারধর, এরপর সবাই
রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) রাতে পিজি হাসপাতালের বেডে শুয়ে নাঈম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ওটা ওসি তদন্তের কক্ষ। প্রবেশ করতেই এডিসি হারুনই প্রথম মারধর শুরু করেন, এরপর অন্য পুলিশ সদস্যরাও।
এডিসি হারুন ছাড়া সবাই ছিল মুখোশ পরা
নাঈম বলছিলেন, আমি রাজনৈতিক কারণে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে চিনি। আর শাহবাগ থানার তো প্রায় সবাই চেনা। কিন্তু ওই রাতে আমি এডিসি হারুন ছাড়া কাউকে চিনতে পারছিলাম না। এডিসি হারুন ছাড়া সবাই ছিলেন পোশাক পরা। কারও নেমপ্লেট ছিল না পোশাকে। হয়তো খুলে রাখা হয়েছিল। মুখোশে ও বড় মাস্কে ছিল সবার মুখ ঢাকা। আমি মুখোশ টেনে ওসি তদন্ত মোস্তফাকে চিনতে পারি।
ছাত্রলীগ পরিচয় জেনে আরও বেশি নির্যাতন
নাঈম বলেন, জ্ঞান হারানোর আগে আমি নিজের পরিচয় দিই। বলি আমি ছাত্রলীগ করি। আমি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক। ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগ সভাপতি। পরিচয় দেওয়ার পর এডিসি হারুন আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগকে গালাগাল করে আর মারতে থাকেন। ১০-১২ জন পুলিশ সদস্য আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা ১০-১৫ মিনিট বুট দিয়ে আমাকে মারতে থাকে।
বেশি মেরেছে ওসি তদন্ত
থানার কক্ষে ঢোকার পরই এডিসি হারুন নিজেই প্রথম মারধর শুরু করে। তবে বেশি মারধর করেছে ওসি তদন্ত। মার খেতে খেতে আমি ফ্লোরে পড়ে যাই। এডিসি হারুন ওসি তদন্তকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, ওরে ধর, আমার গায়ে হাত দিয়েছিল। অথচ আমি কিছুই করিনি।
পিস্তলের বাট দিয়ে মুখে-দাঁতে আঘাত করা হয়
কেউ কেউ হাত-পা দিয়েও মারতে থাকে। এর মধ্যে এডিসি হারুন নিজের পিস্তল দিয়ে আঘাত করে আমার মুখ থেঁতলে দেন। মার খেতে খেতে আমি একটা সময় জ্ঞান হারাই।
আরও পড়ুন : থানায় ২ ছাত্রলীগ নেতাকে নির্যাতনের ঘটনায় ডিএমপির তদন্ত কমিটি গঠন
ঘটনা জানতেন রমনার ডিসি আশরাফ, এডিসি শাহেন শাহ
পুলিশের একাধিক সূত্র ও কর্মকর্তার বক্তব্যে জানা গেছে, শাহবাগ থানা হেফাজতে দুই ছাত্রলীগ নেতা ও রাষ্ট্রপতির এপিএস মামুনকে মারধর করা হচ্ছে। ওই খবরে শাহবাগ থানায় পাঠানো হয় রমনা বিভাগের নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহকে। তিনি গিয়ে নাঈমকে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ওই রাতে এডিসি হারুন ও ওসি তদন্ত ছাড়া নির্যাতনের ঘটনার আগে পরে অন্য কোনো কর্মকর্তা এসেছিল কি না, ডিসি জানতো কি না? জানতে চাইলে নাঈম বলেন, এডিসি শাহেন শাহ পরে এসেছিলেন। ডিসি জানতে পেরেই এডিসি শাহেন শাহকে পাঠান। এডিসি শাহেন শাহ’র সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। তাকে দেখেই আমি শুধু বলছিলাম, আমাকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠান। এরপর আমাকে চিকিৎসার জন্য ঢামেক হাসপাতালে পাঠানো হয়।
ফ্ল্যাশ মেরে সব ডাটা ডিলিটের পর মোবাইল ফেরত
নাঈম বলেন, থানায় নিয়ে যাওয়ার পর মামুন ভাই ও মুনিমের মোবাইল, মানিব্যাগ নিয়ে রেখে দিয়েছিল। আমি যাওয়ার পর আমারটাও নিয়ে নেয়। আমাকে যখন ছাড়া হয় তখন সব ফেরত দিয়ে দেয়। কিন্তু আমার মোবাইল ফ্ল্যাশ মেরে সব ডাটা ডিলিট করা হয়েছিল। কোনো তথ্য-নাম্বার, ছবি, ভিডিও কিছুই ছিল না। তিনজনের মোবাইলে হাসপাতাল ও থানার ঘটনা ভিডিও ছিল সন্দেহে এডিসি হারুন মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে সব মুছে দেন।
ওসির দাবি- সে রাতে থানায় ছিলেন না
থানায় এভাবে মারধরের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহবাগ থানার ওসি নূর মোহাম্মদ জানান, ঘটনার সময় তিনি থানায় ছিলেন না। তার কক্ষে কাউকে নেওয়া হয়নি। ঘটনাটি ঘটেছে পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে।
তার বক্তব্যের সত্যতা মেলে এডিসি শাহেন শাহ’র বক্তব্যে। এডিসি শাহেন শাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ডিসি আশরাফ স্যার আর আমি একটা প্রোগ্রামে ছিলাম। স্যারের নির্দেশে আমি সে রাতে শাহবাগ থানায় যাই। আমি যাওয়ার পর কোনো নির্যাতনের ঘটনা ঘটেনি। আমি গিয়ে নাঈমকে ওসি তদন্তের রুমে পাই। পরে তাকে হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা গ্রহণ করি।
বদলি নয়, ‘পেটানো ফোবিয়ায়’ ভোগা এডিসি হারুনের চাকরিচ্যুতি চান নাঈম
এডিসি হারুন, সাধারণ শিক্ষার্থী, সাংবাদিকদের ওপরও হামলা করেছিল। শুনেছি তাকে নাকি বদলি করা হয়েছে। আমি বদলিতে সন্তুষ্ট না। এডিসি হারুনের মতো পেটানো, মারধর ফোবিয়ায় ভোগা কর্মকর্তার যোগ্যতা নেই পুলিশে থাকার। আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও শাস্তি দাবি করছি। তাকে পুলিশ বাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত ও গ্রেপ্তার দাবি করছি।
তদন্তের কাজ শুরু করেছে তদন্ত কমিটি
ছাত্রলীগের দুই নেতাকে থানায় নিয়ে মারধর করার ঘটনায় অভিযুক্ত এডিসি হারুন অর রশীদকে প্রত্যাহারের পর বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুকের নির্দেশে গঠিত ওই তিন সদস্য বিশিষ্ট কমিটির সভাপতি ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস্) আবু ইউসুফ। অপর দুই সদস্য হলেন, রমনা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (নিউমার্কেট জোন) শাহেন শাহ এবং অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা-মতিঝিল বিভাগ) মো. রফিকুল ইসলাম।
তদন্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে রমনা বিভাগের নিউমার্কেট জোনের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (এডিসি) শাহেন শাহ ঢাকা পোস্টকে বলেন, তদন্ত কমিটিকে আগামী দুদিনের মধ্যে তদন্ত কাজ সম্পন্ন করে ডিএমপি পুলিশ কমিশনার বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে। আমরা গতকালই কিছু কাজ করেছি। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে তদন্ত কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
প্রত্যাহারের পর একদিনে দুবার বদলি হারুন
ছাত্রলীগ দুই নেতাকে থানায় নিয়ে বেধরক মারধর করার ঘটনায় অভিযুক্ত ডিএমপির এডিসি হারুনকে প্রথমে প্রত্যাহার করে ডিএমপি সদর দপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। এরপর তদন্ত কমিটি ও বদলির আদেশ জারি করে ডিএমপি।
এ ব্যাপারে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার ঢাকা পোস্টকে জানান, এডিসি হারুনকে রমনা বিভাগ থেকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। তাকে পিওএম-এ বদলির বিষয়ে দ্রুত আদেশ জারি হবে। পরে একটি তদন্ত কমিটি হবে। সেখানে কে দোষী, কে নির্দোষ তা প্রমাণিত হবে।
রোববার (১০ সেপ্টেম্বর) বিকেলেই হারুনকে পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টে (পিওএম) বদলি করা হয়। আবার এরপর বিকেলে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন স্বাক্ষরিত এক আদেশে তাকে এপিবিএন-এ বদলি করা হয়।
যতোখানি অন্যায় ততোখানি শাস্তি : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
ছাত্রলীগের দুই নেতাকে বেধড়ক মারধরের ঘটনায় এডিসি হারুন শাস্তি পাবেন বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।
রোববার এক অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘এটা যে করেছে, সে পুলিশের হোক বা যেই হোক না কেন, অন্যায় করলে শাস্তি পেতে হবে। কেন করেছে, কী করেছে, আমরা জিজ্ঞাসা করব। তার ভুল কর্মকাণ্ডের জন্য তাকে জবাবদিহি করতে হবে। যতখানি অন্যায় করেছে ততখানি শাস্তি সে পাবে।’
জেইউ/এসএম