সীমান্তের আঁধারে যেন দ্বীপশিখা ‘মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজ’

একদিকে তাকালে সীমান্ত ঘেঁষা নাফ নদী, নো-ম্যান্স ল্যান্ড। অন্যদিকে বিস্তীর্ণ লবণের মাঠ। মাঝে ঠায় দাঁড়িয়ে সুবিশাল ভবন। সামনে বিস্তৃত সবুজ মাঠ। মাঠ পেরিয়ে ভবনের ভেতর প্রবেশ করতেই দেখা মিলবে সমৃদ্ধ ল্যাবের। প্রতি তলায় চোখে পড়বে সুপরিসর ক্লাস রুম। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য রয়েছে ডরমেটরি।
বিজ্ঞাপন
কক্সবাজারের টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়ন সদর এলাকা পার হয়ে আরাকান সড়ক ধরে একটু এগোলেই হাতের ডানে যে কারও চোখ আটকাবে এই স্থাপনায়। দুর্গম সীমান্ত এলাকাটির বিভিন্ন অপরাধ প্রতিনিয়ত সমালোচনার জন্ম দিলেও এই প্রতিষ্ঠান কেবলই ‘আলো’ ছড়াচ্ছে।
বলছি টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নে প্রতিষ্ঠিত মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজের কথা। চট্টগ্রাম শহর থেকে ২৫০ কিলোমিটার দূরে এই কলেজের অবস্থান হলেও সুযোগ-সুবিধা ও পাঠদান কৌশলের দিক থেকে শহুরে অনেক প্রতিষ্ঠিত কলেজকে পেছনে ফেলেছে এই কলেজ।
বিজ্ঞাপন
কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলা সদরের ২০ কিলোমিটার আগেই অবস্থান হ্নীলা ইউনিয়নের। এই ইউনিয়নে পৌঁছাতে হলে কক্সবাজার লিংক রোড ধরে পাড়ি দিতে হবে আঁকাবাঁকা ৭০ কিলোমিটার পথ। নাফ নদীর তীরেই এই ইউনিয়নের অবস্থান।
হ্নীলা, নোনা জল-মাটির এক জনপদ। এখানকার মানুষের বেশিরভাগের জীবিকার ব্যবস্থা করেছে নোনা জলের নাফ নদী। সুদূর অতীতেও এ নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করতেন এ জনপদের মানুষ। কেউবা আবার এই নোনা জল দিয়ে উৎপাদন করেন লবণ। তার আগে এসব মাঠে ছিল ধান, তরমুজ আর শসার আবাদ। আর রাখাইন পল্লীর মানুষগুলোর বেশিরভাগের পেশা হচ্ছে স্বর্ণকার।
বিজ্ঞাপন
বর্তমানে মাছ চাষ, ব্যাটারিচালিত যানবাহন, সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার অধীনে দিনমজুর খেটে পেট চলে এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষের।
শিক্ষায় অনগ্রসর এই জনপদের গল্প নেতিবাচকতায় ভরা। পাহাড়ি, রোহিঙ্গা সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্যে আনাগোনা চলে এখানে। ইয়াবা, অস্ত্র, অপহরণ, চাঁদাবাজি, খুন, ডাকাতি আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানের কারণে প্রতিনিয়ত এই অঞ্চল সংবাদের শিরোনাম হয়।
শিক্ষার আলো এ জনপদে তেমন একটা ছড়ায়নি। উন্নয়ন হয়নি স্বাস্থ্যসেবা খাতেরও। নিরক্ষর, অল্প ও অর্ধশিক্ষিত এ জনপদের রক্ষণশীল বাসিন্দাদের সামাজিক মূল্যবোধও গড়ে উঠেছে অনেকটা নেতিবাচকভাবে।
এমন অন্ধকারে ডুবে থাকা এই অঞ্চলে আলো ছড়াতে এগিয়ে এসেছে একটি পরিবার। কক্সবাজারে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক মঈন উদ্দিন আহমেদের পরিবারের উদ্যোগে এই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে একটি আদর্শ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাদের পারিবারিক দুই একর জমির ওপর গড়ে ওঠা এ প্রতিষ্ঠানের নাম ‘মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজ’। মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল ট্রাস্টের অধীনেই পরিচালিত হচ্ছে এই কলেজটি।
২০১১ সালে এই কলেজের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান। মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগে ২০১৫-২০১৬ শিক্ষাবর্ষে ৭২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পাকা ভবনেই এই কলেজে আনুষ্ঠানিক পাঠদান কার্যক্রম শুরু করা হয়। বর্তমানে হাজারের বেশি শিক্ষার্থী নিয়ে এ কলেজের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ও কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের শীর্ষ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরাই পাঠদান করছেন এ কলেজে। সমৃদ্ধ অবকাঠামোর সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাডেমিক অর্জনের মুকুটে যুক্ত হয়েছে শ্রেষ্ঠত্বের পালকও। প্রতিষ্ঠার পর থেকে দীর্ঘ সময় ধরে ব্যক্তিগত উদ্যোগের দুর্গম এলাকার এই কলেজ কক্সবাজার জেলায় বেসরকারি কলেজগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান দখল করে আছে। সরকারি-বেসরকারি হিসেবে এ কলেজের অবস্থান দ্বিতীয়।
চারতলা সুপরিসর ভবন নিয়ে চালু হওয়া এ কলেজে রয়েছে আবাসিক ব্যবস্থা। অর্ধশত কম্পিউটার নিয়ে চালু রয়েছে কম্পিউটার ল্যাব। সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে গোটা কলেজজুড়ে চলে মনিটরিং ব্যবস্থা। বড় পরিসরে স্থাপিত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিও শোভা পাচ্ছে করিডরের দেয়ালে।
নিরাপত্তা, পাঠদান কৌশলের পাশাপাশি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত থাকায় রক্ষণশীল এলাকা হওয়া সত্ত্বেও এই কলেজের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থীই ছাত্রী।
ভ্রাম্যমাণ ক্যান্টিন ব্যবস্থাও গড়ে তোলা হয়েছে এ কলেজে। নির্দিষ্ট দোকান থেকে ঘড়ির কাঁটা বেলা ১১টার ঘরে পৌঁছালেই চলে আসে খাবার। নানা পদের খাবারের পসরা সাজানো হয় কলেজের করিডোরে। ঘড়ি ধরা ৩০ মিনিট চলে বিকিকিনি। শিক্ষার্থীদের টিফিন কেনা হয়ে গেলে গুটিয়ে ফেলা হয় এ ক্যান্টিন।
সম্প্রতি টেকনাফের হ্নীলা এলাকায় এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় ট্রাস্টের পক্ষ থেকে কলেজ পরিচালনার দায়িত্বে থাকা মিনহাজ উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে। তিনি জানান, এসএসসিতে জিপিএ-২ কিংবা জিপিএ-৩ পেয়ে এই কলেজে ভর্তি হয় বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। কিন্তু আমাদের কলেজের পরিকল্পিত পাঠদান কৌশলের কারণে এইচএসসিতে এই শিক্ষার্থীদের অনেকেই জিপিএ-৫ পেয়েছে। এই এলাকার শিক্ষার্থীরা একসময় স্কুল থেকে ঝরে পড়তো। কিন্তু এই কলেজ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এখানকার শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়েছে। এরপর থেকে তাদের মধ্যে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের বাসনা তৈরি হয়েছে।
মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, এ কলেজ কক্সবাজার জেলার বেসরকারি কলেজগুলোর মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করছে বারবার। জেলার সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের কলেজগুলো দ্বিতীয় স্থান অর্জন করছে। যা অত্যন্ত গৌরবের। কারণ দুর্গম, সীমান্তবর্তী রক্ষণশীল এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা একটি কলেজের এমন অর্জন বিস্ময়কর। আমাদের শিক্ষকমণ্ডলী অত্যন্ত আন্তরিকতা ও কৌশল প্রয়োগের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের নিবিড়ভাবে পাঠদান করে চলেছে।
পাঠদানের কৌশল বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, চলতি বছর এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের মধ্যে টেস্ট পরীক্ষা নেওয়া হয়। তাদের মধ্যে যারা ভালো ফল করতে পারেনি, আমরা তাদের আবাসিক সুবিধা দিয়ে দেড় মাসের জন্য ক্রাশ প্রোগ্রাম হাতে নিয়েছি। তারা আমাদের শিক্ষকমণ্ডলীর ২৪ ঘণ্টা তত্ত্বাবধানে থাকবেন। তাদের থাকা, খাওয়া থেকে শুরু করে পরীক্ষার প্রতিটি বিষয়ের ওপর আমাদের মনিটরিং ও শিক্ষকদের পাঠদান নিশ্চিত থাকবে। এ সুবিধা ছাত্রীদের জন্যও পৃথকভাবে নেওয়া হয়েছে। পরীক্ষার আগ পর্যন্ত তারা কলেজের তত্ত্বাবধানে থেকে নিজেদের যোগ্য করে গড়ে তুলবে।
কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ. ন. ম তৌহিদুল মাশেক তৌহিদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগের প্রথিতযশা অধ্যাপক প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদের ব্রেইন চাইল্ড এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তিনি জন্মস্থান ও বর্তমান প্রজন্মের প্রতি দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে এই আধুনিক প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছেন নিজস্ব অর্থায়নে। এই কলেজে যারা ভর্তি হয় তারা কম জিপিএ নিয়ে ভর্তি হয়। কিন্তু দুই বছর পর তারা সর্বোচ্চ জিপিএ-৫ পেয়েও মেধার স্বাক্ষর রেখেছে। ২০২২ সালে ১৯ জন জিপিএ-৫ পায় এই কলেজ থেকে। কিন্তু তারা কেউই এসএসসিতে জিপিএ-৫ পায়নি। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্স-মাস্টার্স ডিগ্রিধারীরাই এই কলেজের শিক্ষক। প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ স্যারের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে এই কলেজের শিক্ষকরা তাদের সর্বোচ্চ মেধা ও পরিশ্রম দিয়ে শিক্ষার্থীদের পাঠদান চালিয়ে যাচ্ছেন।
তিনি আরও বলেন, ‘এই কলেজ থেকে ৪০ কিমি দূরে উখিয়া কলেজ। ২০ কিমি দূরে টেকনাফ সরকারি কলেজ। মাঝে আর কোনো কলেজ নেই। তাই এই অঞ্চলের পিছিয়ে থাকা বিশাল একটি জনগোষ্ঠীর উচ্চশিক্ষার প্রবেশদ্বার হয়ে উঠেছে মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ৯১৭ জন শিক্ষার্থী পাস করে বের হয়েছে এ প্রতিষ্ঠান থেকে। তাদের মধ্যে অর্ধশত শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ পেয়েছে। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীই ছাত্রী।’
ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আ. ন. ম তৌহিদুল মাশেক তৌহিদ আরও বলেন, ‘এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষ দিনমজুর, খেটে খাওয়া। প্রধানত তারা শিক্ষার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারে না, দ্বিতীয় তাদের মধ্যে আর্থিক সংকট প্রবল। এ কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষ মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল ট্রাস্টের সহায়তা নিয়ে অনেক শিক্ষার্থীকে শতভাগ বিনামূল্যে পাঠদান দিয়ে থাকে। শুধু তাই নয়, এইচএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলআপের টাকা ট্রাস্ট বহন করে। কয়েক লাখ টাকা বৃত্তি দেয়। ট্রাস্টের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের প্রধানতম নীতি হলো, অর্থাভাবে কোনো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন থেমে যাবে না।’
কথার ফাঁকে অধ্যক্ষ উপস্থাপন করলেন ২০২২ সালে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার সমন্বিত ফলের তালিকা। এই তালিকায় উঠে এসেছে, ২০২২ সালে এই কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ অর্জনকারী শিক্ষার্থীদের এসএসসি পরীক্ষার ফলের বিষয়টি।
২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষায় মানবিক বিভাগ থেকে ৩ দশমিক ৬১ পেয়ে শহিদুল ইসলাম ভর্তি হয়েছিলেন মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজে। এই শিক্ষার্থী এইচএসসিতে পেয়েছেন জিপিএ-৫। এ তালিকায় থাকা মো. আলমগীর এসএসসিতে ৩ দশমিক ৭৮ জিপিএ নিয়ে ভর্তি হয়েছিলেন মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজে। এইচএসসিতে এই শিক্ষার্থী পেয়েছেন জিপিএ-৫। ৩ দশমিক ৭২ পেয়ে আফিফা জাহিম হিমামনি ভর্তি হলেও এইচএসসিতে অর্জন করেছেন জিপিএ-৫। এভাবে ১৯ জন জিপিএ-৫ পাওয়া শিক্ষার্থীর প্রত্যেকের এসএসসির ফল ছিল জিপিএ-৩ কিংবা ৪ এর ঘরে।
মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ও মঈন উদ্দিন মেমোরিয়াল কলেজ পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং স্বপ্নদ্রষ্টা প্রফেসর ড. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার বাবা চট্টগ্রাম কলেজে ইন্টারমিডিয়েট লেভেলে ভর্তি হয়ে আর্থিক অনটনের কারণে পড়ালেখা করতে পারেননি। এ কারণে তার মধ্যে সারাজীবন এক ধরনের অতৃপ্তি ছিল। তিনি আমাদেরকে প্রায় সময় তার স্বপ্নভঙ্গের কথা বলতেন। এ জেদ থেকে তিনি আমাদের আট ভাইবোন সবাইকে মাস্টার্স পর্যন্ত পড়ালেখা করিয়েছেন। বাবার মৃত্যুর পর কয়েকটি বিষয় আমাকে নাড়া দেয়। এ কারণে গ্রামের অনগ্রসর লোকজনের চিন্তা করে আমরা একটি কলেজ গড়ার উদ্যোগ নিই। প্রথমে আমরা একটি ট্রাস্ট গঠন করি এবং সেখানে আমরা ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ অনুদান দেন। ট্রাস্টের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কলেজ প্রতিষ্ঠা করি। যেটি সাবেক প্রধান বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান উদ্বোধন করেন। বর্তমানে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এলাকায় শিক্ষার আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।
এমআর/জেডএস