এক বন্দরেই বদলে গেছে জীবন
# ৩০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এ বন্দরেই
# বেড়েই চলছে চতুরমুখী ব্যবসা-বাণিজ্য
# বন্দর ব্যবহার করে চিকিৎসার জন্য সহজেই যেতে পারছেন আগ্রহীরা
ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমদানি ও রপ্তানি কাজে ব্যবহার হতো পঞ্চগড়ের বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি। বর্তমানে মানুষের যাতায়াতেও এই বন্দর ব্যবহার হচ্ছে। বন্দর ব্যবহার করে সহজেই কয়েকটি জেলার মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে পারছেন বলে জানিয়েছেন স্থানীয় ও বন্দরের ব্যবহারকারীরা। এই এক বন্দরকে ঘিরে পঞ্চগড়ের চিত্র বদলে গেছে। এখানকার শ্রমিকদের জীবনমান উন্নত হয়েছে। বদলে গেছে ৩০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা।
জানা গেছে, পঞ্চগড় জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি বাংলাদেশের একমাত্র চতুরদেশীয় স্থলবন্দর, যার মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। পণ্য আমদানির পাশাপাশি দেশীয় পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে অধিক বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ছাড়াও এই বন্দরের মাধ্যমে স্থানীয় পর্যায়ে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিন এ স্থলবন্দরে প্রায় ৫০০০ শ্রমিক কাজ করেন। ফলে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জীবন-জীবিকা এ বন্দরের ওপর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নির্ভর করে।
স্থানীয় বাসিন্দা মহসিন আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘কয়েক বছর আগে এই বন্দরটি নামেই বন্দর ছিল। এত উন্নত ছিল না। আমাদের অনেক দুঃখ ছিল সেই সময়। আমাদের কাছেই ভারত অথচ এদিক দিয়ে আমরা যেতে পারব না। এখন আমরা যেতে পারছি, এটা হওয়ায় আমাদের জন্য ভালো হয়েছে।’
জানা যায়, ১৯৯৭ সালের দিকে প্রথম নেপালের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার্থে বন্দরটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পরে ২০১১ সালে ভারতের সঙ্গে এবং ২০১৭ সালে ভুটানের সঙ্গে এই বন্দরে পণ্য আমদানি-রপ্তানির কার্যক্রম শুরু হয়। এর মধ্যে ২০১৬ সালে এই বন্দরের মাধ্যমে ইমিগ্রেশন চালু হয়।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের মাধ্যমে ভারত থেকে পাথর, ভুট্টা, অয়েল কেক (খৈল), আদা, গম, চাল, ফল ইত্যাদি এবং নেপাল ও ভুটান থেকে উৎপাদিত ও বিভিন্ন প্রক্রিয়াজাত পণ্য আমদানি করা হয়। এছাড়াও দেশ থেকে পার্টস, গ্লাস শিট, ওষুধ, আলু, জুস, কটন ব্যাগ ও খাদ্য সামগ্রী রপ্তানি করা হয়। বর্তমানে এ বন্দরের কলেবর আরও ব্যাপকভাবে বাড়িয়ে এটিকে আধুনিক বন্দরে রূপান্তরের জন্য মাস্টার প্ল্যান গ্রহণ করে বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
পঞ্চগড় জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরটি বাংলাদেশের একমাত্র চতুরদেশীয় স্থলবন্দর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারত, ভুটান ও নেপাল। আমদানি-রপ্তানি কাজ ছাড়াও মানুষজন এই বন্দর ব্যবহার করে ভারত, ভুটান ও নেপালে যাচ্ছেন। মানুষের দৈনন্দিন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এর প্রভাব খুবই উল্লেখযোগ্য। এখানে বন্দরকেন্দ্রিক প্রায় ৩০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
এ বন্দরকে আরও আধুনিক এবং অন্য দেশের সঙ্গে যোগাযোগকে আরও সহজ করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের সড়কপথ উন্নতি করা হয়েছে। আমাদের দেশের বিভিন্ন পণ্য আমরা রপ্তানি করছি এবং এই বন্দর ব্যবহার করে আমাদের প্রয়োজনীয় জিনিস আমরা সহজে আমদানি করছি– বলেন তিনি।
বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই বন্দর দিয়ে আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৬৫৬ টন পণ্য এবং রপ্তানি হয়েছে ৭ হাজার ৫১ টন পণ্য। একইভাবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১২ লাখ ৭ হাজার ৩২৩ টন ও রপ্তানি ৬৯ হাজার ২০৫ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে আমদানি ১৭ লাখ ৯৬ হাজার ৮৬৯ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে আমদানি ১১ লাখ ৮৬ হাজার ৫৮ টন ও রপ্তানি ১ লাখ ১৩ হাজার ৩৯০ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি ১৬ লাখ ৯৩ হাজার ১২০ টন ও রপ্তানি ১ লাখ ১১ হাজার ৫৬৯ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ১৬ লাখ ৫৫ হাজার ৭২৬ টন ও রপ্তানি হয়েছে ১ লাখ ৬৪ হাজার ৮৭৫ টন পণ্য।
বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরের ম্যানেজার আবুল কালাম আজাদ বলেন, বাংলাবান্ধা বন্দরটি কৌশলগতভাবে একটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। ইতোমধ্যে চারটি দেশকে সংযুক্ত করেছে। চারটি দেশের ব্যবসা সম্প্রসারণ হয়েছে। গত ১৪ বছরে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাবান্ধা বন্দরে অবকাঠামোগত অনেক উন্নয়ন হয়েছে। এখানে কিছু দিন আগেও তেমন কিছু ছিল না বললেই চলে। বর্তমানে বাংলাবান্ধা বন্দরের ব্যাপক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে।
তিনি বলেন, আমাদের আমদানি-রপ্তানির অবস্থা অনেক ভালো। বর্তমানে প্রায় প্রতিদিনই সাড়ে তিনশ থেকে চারশ ট্রাক আমদানি হয়ে থাকে। আমদানি পণ্যের মধ্য প্রধানত হচ্ছে পাথর। ভুটান ও ভারত থেকে এই পাথর আমদানি করা হয়। পাথর ছাড়াও গম, ভুট্টা, অয়েল কেক (খৈল), চাল আমদানি করা হয়।
বাংলাবান্ধা বন্দর ব্যবহার করে ভারত থেকে বাংলাদেশে এসেছেন এরশাদ হোসেন। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি চিকিৎসার জন্য ভারতে গিয়েছিলাম। বাংলাবান্ধা বন্দর চালু হওয়ায় দ্রুত যাওয়া যায়। আমি প্রতি সপ্তাহে ভারতে যাই। সেখান থেকেই আমার প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনি। এটা সম্ভব হয়েছে শুধু শেখ হাসিনার কারণে। তিনি বন্দরটি আধুনিকায়ন না করলে আমার যাওয়া হতো না।’
পাথর ব্যবসায়ী রহমত উল্লাহ ঢাকা পোস্টকে, ‘আমি দীর্ঘদিন ধরে এই বন্দর দিয়ে পাথরের ব্যবসা করে আসছি। প্রতি মাসে ৩০ হাজার সেফটি আমদানি করে থাকি। একটি ট্রাকে ৬শ সেফটি পাথর আনলোড করা থাকে। বাংলাবান্ধা হওয়ার কারণে যাতায়াত অনেক সুবিধা হয়েছে। আগে বুড়িমারী বন্দর দিয়ে পাথর নিয়ে আসতাম। এখন বাংলাবান্ধা বন্দর দিয়ে পাথর আনার কারণে অনেক সুবিধা হচ্ছে। আর এই বন্দরের রাস্তাগুলো অনেক ভালো, গাড়িতে মালামাল লোড করতে সুবিধা ভালো।’
এমএসআই/এসএসএইচ/