হায়েনার পেটে শিশুর হাত, চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের নানা অজুহাত
- ‘বোন ক্রাশার’ জাতের হায়েনা কখনো কামড় ছাড়ে না— ভেটেরিনারি সার্জন
- হায়েনার শেডে নিরাপত্তা বেষ্টনী ভালো ছিল না— চিড়িয়াখানার কর্মী
- কোনো বোধগম্য মানুষ নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করে না— চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ
- প্রহরীদের সার্বক্ষণিক খাঁচার কাছে থাকার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে— চিড়িয়াখানার পরিচালক
রাজধানীর মিরপুরে জাতীয় চিড়িয়াখানায় হিংস্র বন্যপ্রাণী ‘চিত্রা হায়েনা’ দর্শনার্থী এক শিশুর হাত কামড়ে ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে। ঘটনাটি ঘটেছে গত ৮ জুন সকালের দিকে। এরপর থেকে নানা মহলে জাতীয় চিড়িয়াখানার দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু চিড়িয়াখানার নিরাপত্তা নয়, দর্শনার্থীদের সচেতন থাকার বিষয়টিও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
চিড়িয়াখানা প্রশাসন বিষয়টি নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে ইতোমধ্যে আরও নিরাপত্তা জোরদারে কাজ শুরু করেছে। অপেক্ষায় আছে তদন্ত প্রতিবেদনের। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে দর্শনার্থীদের নির্দেশনা মেনে চলতে অনুরোধ করা হয়েছে।
এদিকে ওই হায়েনার খাঁচার বেষ্টনী আরও কয়েকমাস আগে থেকেই ভালো ছিল না বলে জানা গেছে।
চিডিয়াখানার ভেটেরিনারি সার্জন বলছেন, প্রতিটি হিংস্র প্রাণীর জিনগত বৈশিষ্ট্যে শিকার থাকে। যদি তাকে আবদ্ধ করেও রাখা হয়, তবুও সে সুযোগ খোঁজে। তাই চিড়িয়াখানা হোক আর যেখানেই হোক হিংস্র প্রাণীদের কাছ থেকে সাবধান থাকতে হবে।
অন্যদিকে প্রাণীদের নিয়ে কাজ করা সংগঠক বলছেন, জাতীয় চিড়িয়াখানা ৪টি উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র বিনোদনকেই প্রাধান্য দিচ্ছে কর্তৃপক্ষ। যতদিন না ৪টি উদ্দেশ্যকেই সমানভাবে প্রাধান্য না দেবে, ততদিন এমন ঘটনা ঘটতে পারে। তাই, অন্তত দর্শনার্থীদের প্রতিটি জোনে প্রবেশের সময় লিখিত সাইনবোর্ডের বাইরেও বার্তা প্রদানের ব্যবস্থা করা উচিত।
মঙ্গলবার (১৩ জুন) জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘুরে দেখা গেছে, ওই দুর্ঘটনার পর নিজ থেকেই সর্তক হয়েছেন দর্শনার্থীরা। নিরাপত্তা বেষ্টনীর বাইরে থেকেই প্রাণী দেখছেন তারা। এরইমধ্যে কিছু দর্শনার্থীকে এখনো প্রাণীদের বিরক্ত করতে দেখা গেছে। কাউকে ঢিল ছুড়তে, আবার কাউকে হাতে থাকা কাঠি দিয়ে প্রাণীদের খোঁচাখুঁচি করতে দেখা গেছে।
শিশু দর্শনার্থীর হাত ছিঁড়ে নেওয়া চিত্রা হায়েনার সি-১৭ শেডের সামনে ছোট বেষ্টনীর বদলে জিআই তারের উঁচু বেষ্টনী দেওয়া হয়েছে। পাশের সি-১৮ শেডে থাকা ডোরাকাটা হায়েনার প্রথম বেষ্টনীর সামনেও জিআই তারের বেষ্টনী লাগানোর কাজ চলছে।চিড়িয়াখানা প্রশাসন জানিয়েছে, সকল হিংস্র প্রাণীর শেডের সামনেই উঁচু বেষ্টনীর ব্যবস্থা করা হবে।
চিড়িয়াখানা প্রশাসনের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, চিড়িয়াখানার প্রতিটি শেডের সামনে লিখা আছে নিরাপত্তা বেষ্টনী অতিক্রম করবেন না। দুটি নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে। প্রথম নিরাপত্তা বেষ্টনীর উচ্চতা ২ ফুটের মতো। এটি দেওয়া হয়েছে যেন দর্শনার্থীরা প্রাণীদের ভালোভাবে দেখতে পারেন। এই প্রাথমিক বাধা অতিক্রম করে কোনো বোধগম্য মানুষের সামনে আগানোর কথা না।
তিনি আরও বলেন, দ্বিতীয় বেষ্টনীতে শক্ত লোহা ব্যবহার করা হয়েছে। তারপর ওপর আবার নেট দেওয়া আছে। ওই নেটের ফাঁক দিয়ে কোনো মানুষের হাত যাওয়ার কথা না। এটা শুধুমাত্র হায়েনার শেডে না, সব হিংস্র প্রাণীর শেডের সামনেই এটি দেওয়া। এরপরেও যে ঘটনা ঘটেছে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত। ঈদে অনেক মানুষ চিড়িয়াখানায় আসেন, কখনো এমন ঘটেনি। কেউ ভাবেনি, এমন ঘটনা ঘটবে। সেখানে এমন হতে পারে, প্রাথমিকভাবে ওই ছোট ফাঁক দিয়ে ২/৩টা আঙ্গুল ঢুকেছে, পরে হায়েনা হয়তো সেটি টান দিয়ে পুরো হাত ভেতরে নিয়েছে। পরে হাত ছিঁড়ে খেয়ে ফেলেছে।
তদন্ত কমিটি সম্পর্কে জানতে চাইলে ওই কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত কমিটি রিপোর্ট দিতে একটু দেরি হতে পারে। কারণ শুধু এ ঘটনা না বরং কীভাবে দর্শনার্থীদের নিরাপত্তা দেওয়া যায় সেই বিষয়েও উল্লেখ করতে হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চিড়িয়াখানার এক কর্মী ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছেন, সি-১৭ শেডের দ্বিতীয় বেষ্টনী ভালো ছিল না। এটা অনেকদিন ধরেই এমন ছিল। এই দুর্বলতা চিড়িয়াখানার। চিড়িয়াখানার কাজ সরকারি, তাই চাইলেই কেউ কিছু করতে পারে না। কাজ করার জন্য টেন্ডার লাগে।
পর্যবেক্ষণেও ২টি জায়গায় জিআই তারের জাল ছেঁড়া থাকতে দেখা গেছে। জালটিও ছিল পুরনো।
হিংস্র প্রাণীরা চিড়িয়াখানায় থাকলে তাদের হিংস্রতা কেমন হয়— জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার ভেটেরিনারি সার্জন ডা. নাজমুল হুদা ঢাকা পোস্টকে বলেন, শিকারি প্রাণীরা খাঁচায় থাকলে শিকার করতে পারে না। কিন্তু তারা চেষ্টায় থাকে। কারণ, তাদের যে খাবার দেওয়া হয় সেটি তো প্রসেস করে দেওয়া হয়। ওই খাবার তাদের তত ভালো লাগে না। হিংস্র প্রাণীর জিনগত বৈশিষ্ট্যে শিকার থাকে।
তিনি আরও বলেন, হায়েনার ৪টি জাত হয়। যে হায়েনা দর্শনার্থীর হাত ছিঁড়ে নিয়েছে সেটি ছিল ‘বোন ক্রাশার’। এরা মুখ থেকে কখনো কামড় ছাড়ানো যায় না। যেভাবেই হোক, সে তার কামড়ের অংশ নিয়েই ছাড়বে। এমন আরেকটি প্রাণী আছে, সেটি হচ্ছে কুমির।
প্রাণী অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন পিপল ফর অ্যানিমেল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান স্থপতি রাকিবুল হক এমিল ঢাকা পোস্টকে বলেন, দেশের বাইরের চিড়িয়াখানায় শেখার ব্যবস্থাও থাকে। সেখানে জোন ভিত্তিক একজন করে কর্মকর্তা থাকেন। তারা দর্শনার্থীদের প্রাণীকুল সম্পর্কে ধারণা দেন। আর আমাদের দেশের মানুষ চিড়িয়াখানায় গিয়ে শুধু প্রাণী দেখে। তারা খাঁচার পাশে সাইনবোর্ডে থাকা লেখার বাইরে কিছু জানে না। আবার সেসব লেখাতে তথ্যগত ভুল আছে।
তিনি আরও বলেন, অফিসার থাকলে তারা খেয়াল করতে পারেন যে দর্শনার্থীরা কোনো বিপদে পড়বেন কি-না বা তারা প্রাণীদের উত্যক্ত করছেন কি-না। চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বলছে, তাদের ২৩৭টি খাঁচায় ২৩৭ জন কর্মী লাগবে, বিষয়টা এমন না। সিস্টেমেটিক ওয়েতে করতে পারলে অল্প মানুষেই কাজগুলো হয়ে যায়। চিড়িয়াখানার উচিত দর্শনার্থীদের জন্য শিক্ষামূলক কিছু ব্যবস্থা রাখা।
দর্শনার্থীদের নিরাপদ রাখতে চিড়িয়াখানার পক্ষ থেকে অদূর ভবিষ্যতে কি ব্যবস্থা নেওয়া হবে— জানতে চাইলে জাতীয় চিড়িয়াখানার পরিচালক ডা. মো. রফিকুল ইসলাম তালুকদার ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা এখন পুরো নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েই ভাবছি। প্রথমত হিংস্র প্রাণীদের নিরাপত্তা বেষ্টনী আরও উঁচু ও মজবুত করার বিষয়ে সবচেয়ে বেশি জোর দেব। দ্বিতীয়ত প্রচারণা বাড়াব। লিফলেট তৈরি করব ও টিকিটের অপরপৃষ্ঠায় সতর্কবার্তা লিখে দেব।
তিনি বলেন, আমাদের এখানে স্কুল-কলেজের বা ছোট বাচ্চা যারা আসে তাদেরকে একটি সেশনের মাধ্যমে সর্তক করার ব্যবস্থা করব। এছাড়া কর্মীরা যেন বেশিরভাগ সময় খাঁচার পাশে থাকে সে বিষয়ে তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। চিড়িয়াখানায় ১৩৭টি খাঁচার ২৩৭টি প্রকোষ্ঠ আছে। ২৩৭টি প্রকোষ্ঠে যদি একজন করে লোক সার্বক্ষণিক নিয়োগ দিই, তাহলে ২৩৭ জন কর্মী প্রয়োজন, তাও এক শিফটে। সেখানে কমপক্ষে দুটি শিফট লাগে। যেখানে আমাদের কেয়ারটেকার আছে প্রায় ৭০ এর কাছাকাছি।
তদন্তের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, তদন্ত কমিটির রিপোর্ট ৩ কার্যদিবসের মধ্যেই দেওয়ার কথা। সেই হিসেবে আজকে শেষ দিন। তারা সময়ের জন্য আবেদন করতে পারেন। তবে প্রতিবেদন হাতে না পেয়ে আমি বলতে পারব না, তদন্ত প্রতিবেদন আমি পেয়েছি। আমি আশা করব, উনারা সময়মত রিপোর্ট দেবেন।
এমএইচএন/ওএফ