নতুন পে-স্কেল নয়, আলোচনায় মহার্ঘ ভাতা
সর্বশেষ অষ্টম জাতীয় পে-স্কেল কার্যকর হয় প্রায় আট বছর আগে ২০১৫ সালে। দীর্ঘ এ সময়ে দ্রব্যমূল্যের ক্রমাগত ঊর্ধ্বগতির সঙ্গে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে কয়েক গুণ। এ অবস্থায় পরিবার নিয়ে টিকে থাকতে হিমশিম খাচ্ছেন চাকরিজীবীরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে নবম পে-স্কেল বাস্তবায়নের দাবি তুলেছেন সরকারি কর্মচারীরা।
এ বছরের জানুয়ারিতে সংসদ অধিবেশনে পে-স্কেলের বিষয়ে তোলা এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল জানান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে নতুন করে পে-স্কেল দেওয়া সম্ভব নয়। একই অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও একই যুক্তিতে পে-স্কেলের দাবি একরকম খারিজ করে দিয়েছেন।
তারপরও নির্বাচনী বছর হওয়ায় পে-স্কেল পাওয়ার একটা ‘আশা’ নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করছেন সরকারি চাকরিজীবীরা। কিন্তু তাদের আশা অপূর্ণই থেকে যাবে বলে মনে হচ্ছে। অর্থ মন্ত্রণালয় ও সরকারের বিভিন্ন সূত্র বলছে পে-স্কেল নয়, আগামী অর্থবছরে মহার্ঘ ভাতা পাওয়ার একটা ‘সুসংবাদ’ পেতে পারেন সরকারি চাকরিজীবীরা।
মহার্ঘ ভাতার ক্ষেত্রে চাকরিজীবীদের দাবি হলো ৫০ শতাংশ। তাদের এ দাবিও পূরণ হচ্ছে না। সূত্র বলছে, সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ পর্যন্ত মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হতে পারে।
এর আগে সরকারের পক্ষ থেকে যে কয়টি মহার্ঘ ভাতা দেওয়া হয়েছে সবকটি ছিল ২০ শতাংশ। সর্বশেষ ২০১৩ সালেও ২০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা দিয়েছিল বর্তমান সরকার। ওই সময় সর্বনিম্ন ১৫০০ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ছয় হাজার টাকা পর্যন্ত বেতন বেড়েছিল।
আরও পড়ুন : ফের আন্দোলনে যাচ্ছেন সরকারি কর্মচারীরা
অর্থ বিভাগের বাজেট শাখার সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী দেশে ফেরার পর নতুন অর্থবছরের বরাদ্দ নিয়ে একটি চূড়ান্ত বৈঠক হবে। বৈঠকটি ১০ ও ১২ মের মধ্যে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। সেই বৈঠকে মহার্ঘ ভাতার বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে। বাজেটের পর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এ ব্যাপারে ঘোষণা দেবে সরকার। এর আগে যে কয়টি পে-স্কেল ও মহার্ঘ ভাতা ঘোষণা করা হয়েছে তা বাজেটের ঘোষণার দুই-তিন মাস পর ঘোষণা করা হয়। ঘোষণা যে মাসেই হোক না কেন তা ১ জুলাই থেকে কার্যকর করা হবে।
ব্যাখ্যা হিসেবে অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাজেটে এ খাতের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ রাখা হয় না। অন্য কোনো একটি খাত থেকে থোক বরাদ্দ এনে বরাদ্দ দেওয়া হবে।
কত টাকা প্রয়োজন
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে সরকারি চাকরিজীবী ১৪ লাখের কিছু বেশি। স্বায়ত্তশাসিত, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং এমপিওভুক্ত শিক্ষকসহ এ সংখ্যা প্রায় ২২ লাখ। এ সংখ্যক কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা দিয়ে ২০২২-২৩ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে বেতন-ভাতার জন্য মোট বরাদ্দ ছিল ৭৩ হাজার ১৭৩ কোটি টাকা। আসন্ন অর্থবছরে বেতন-ভাতা খাতে ৭৭ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রাক্কলন করেছে অর্থ বিভাগ।
অর্থ বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, মহার্ঘ ভাতা শুধু মূল বেতনের ওপর দেওয়া হবে। সে হিসেবে সবাইকে ১০ শতাংশ হারে দিলে ৪ হাজার কোটি টাকা, ১৫ শতাংশ হারে দিলে ৬ হাজার এবং ২০ শতাংশ হারে দিলে সর্বোচ্চ ৮ হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন হতে পারে। যেহেতু মহার্ঘ্য ভাতা মূল বেতনের সঙ্গে যুক্ত হয় না ফলে তাদের বাড়িভাড়া ভাতাসহ অন্য কোনো ভাতার হেরফের হবে না।
মহার্ঘ ভাতায় কত টাকা বেতন বাড়বে
অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, মহার্ঘ ভাতায় বাড়ি ভাড়া বাড়ে না। এক্ষেত্রে নির্ধারিত সিলিং তৈরি করে শুধু মূল বেতন বৃদ্ধি করা হয়। সর্বশেষ জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত চাকরিজীবীদের মূল বেতনের ১০ থেকে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি করা হবে। যদি ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পায় তাহলে একজন সরকারি কর্মচারীর বেতন সর্বনিম্ন বাড়বে ১ হাজার ৬৫০ থেকে সর্বোচ্চ আট হাজার টাকা বৃদ্ধি পাওয়া সম্ভাবনা রয়েছে।
আরও পড়ুন : নির্বাচনী বছরেও বাড়ছে না এমপিও খাতের বরাদ্দ
সরকারের জাতীয় বেতন স্কেলের আওতাভুক্ত সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও অর্থলগ্নি প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং সামরিক বাহিনীর সব সদস্য এ মহার্ঘ ভাতা পাবেন। এছাড়া এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মচারীরাও এ ভাতা পাবেন। একইসঙ্গে অবসরোত্তর ছুটিতে (পিআরএল) থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ছুটি পূর্বকালীন সর্বশেষ প্রাপ্য মূল বেতনের ভিত্তিতে এ ভাতা পাবেন।
বাড়বে চিকিৎসা, শিক্ষা ও টিফিন ভাতা
চলতি বছর জেলা প্রশাসক সম্মেলনে সরকারি কর্মচারীদের শিক্ষা, চিকিৎসা ও টিফিন ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। ডিসিদের এ প্রস্তাব আমলে নিয়ে এ তিনটি ভাতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন।
তিনি জানান, গ্রেড অনুযায়ী চিকিৎসা ভাতা ১৫০০ থেকে ২৫০০ টাকা, শিক্ষা ভাতা এক সন্তানদের জন্য ৫০০ টাকা এবং দুই সন্তানের জন্য এক হাজার টাকা বৃদ্ধি পেয়ে সর্বোচ্চ দুই হাজার টাকা, টিফিন ভাতা গ্রেড অনুসারে ২০০ টাকা থেকে দুই হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হতে পারে।
জীবনযাত্রার ব্যয় কত বেড়েছে
২০১৫ সালে শতভাগ বেতন ভাতা বাড়িয়ে ৮ম পে-স্কেল ঘোষণার পর মহার্ঘ ভাতা বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হয়নি। এদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধসহ বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে ক্ষেত্র-বিশেষে ১৫০ শতাংশ। ৫ শতাংশের মুদ্রাস্ফীতি এখন ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ।
সরকারি কর্মচারীরা বলছেন, ৮ম পে-স্কেল অনুযায়ী প্রতিবছর জুলাই মাসে ৫ শতাংশ হারে ইনক্রিমেন্ট পাচ্ছেন চাকরিজীবীরা। এই ইনক্রিমেন্ট চলমান মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারছে না। এ পে-স্কেলে বলা ছিল, মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় রেখে বেতন-ভাতা সমন্বয় করে বৃদ্ধি করা হবে। কিন্তু গত আট বছরে বাজারে পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পেলেও বেতন বৃদ্ধির হার ৫ শতাংশের ঘরেই রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ উপাত্ত অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ মাসে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯.৩৩ শতাংশ। আর গত বছরের একই সময়ে গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৮.৩৯ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির প্রাক্কলন করা হয়েছে ৬ শতাংশে, যা বর্তমান অর্থবছরের মূল বাজেটের ৫.৬ শতাংশ ছিল।
দায়িত্বশীলরা যা বলছেন
প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল ঘোষণার কোনো পরিকল্পনা এ মুহূর্তে নেই বলে জাতীয় সংসদকে জানিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এ বছরের জানুয়ারিতে সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে অর্থমন্ত্রী বলেন, সরকারি কর্মচারীদের জন্য নতুন পে-স্কেল দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা এ মুহূর্তে নেই।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন কয়েক দিন আগে ঢাকা পোস্টকে বলেন, নতুন পে-স্কেল দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তবে চিকিৎসা ভাতা, শিক্ষা ভাতা, টিফিন ভাতা গ্রেড অনুসারে বাড়তে পারে। এ মুহূর্তে এর চেয়ে অন্য কোনো চিন্তা আপাতত নেই। সরকারের ইচ্ছা থাকলেও আর্থিক সংকটের কারণে তা সম্ভব হচ্ছে না।
আরও পড়ুন : কম খরচে আসছে ‘আজিজিয়া হজ’ প্যাকেজ
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, তাদের দাবি-দাওয়ার বিষয়টি আমরা অবগত। কিন্তু অধিকাংশ দাবি-দাওয়াই অর্থ সংশ্লিষ্ট। এগুলো পূরণের জন্য সরকারের শীর্ষ মহল ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন প্রয়োজন। তাই এখানে আমাদের তেমন কিছু করার নেই।
সরকারি কর্মচারীদের সাত দফা
এদিকে নবম পে-স্কেল ঘোষণা, ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতাসহ সাত দফা দাবিতে আন্দোলনে রয়েছেন সরকারি কর্মচারীরা। দুই দফায় তারিখ পরিবর্তন হলেও কর্মসূচি পালনে অনড় সরকারি কর্মচারীরা। আগামী ২৬ মে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে এ মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দিয়েছেন তারা। তাদের কর্মসূচিতে সতর্ক দৃষ্টি রয়েছে প্রশাসনের শীর্ষ মহলের।
তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে, পে কমিশন পুনর্গঠন এবং ৫০ শতাংশ মহার্ঘ ভাতা প্রদান। এছাড়াও আছে, ১৯৭৩ সালের ঘোষণা অনুযায়ী ১০ ধাপে বেতন-ভাতা নির্ধারণ, পে-কমিশনে কর্মচারী প্রতিনিধি রাখা, সচিবালয়ের ন্যায় সব দপ্তর ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের পদ ও পদবি এক এবং অভিন্ন নিয়োগবিধি প্রণয়ন, টাইম স্কেল, সিলেকশন গ্রেড, বেতন জ্যেষ্ঠতা পুনর্বহাল এবং সব স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে গ্র্যাচুইটির পরিবর্তে পেনশন প্রবর্তনসহ বিদ্যমান আনুতোষিকের হার ৯০ শতাংশের স্থলে ১০০ শতাংশ নির্ধারণ।
এনএম/এসকেডি