১৮৩ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে ঘুষ লেনদেন, ৮ জনকে তলব
দেশের হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ঘাটতি ছিল। বিশেষ করে করোনার সময়ে এটা প্রকট আকার ধারণ করলে সরকার যত দ্রুত সম্ভব ৩ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশনা দেয়। যার ধারাবাহিকতায় করোনা আক্রান্তদের নমুনা পরীক্ষার আওতা বাড়াতে ১২শ মেডিকেল টেকনোলজিস্টসহ ২৮১৭ পদে নিয়োগের অনুমোদন চূড়ান্তও হয়। কিন্তু এক শ্রেণির অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীর বিরুদ্ধে সুযোগের সর্বোচ্চ অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে।
২০২০ সালের শুরুতেই বিশেষ ব্যবস্থায় ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি লেনদেনের অডিও রেকর্ডও ফাঁস হয়। মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদের এমন অনিয়মের প্রকৃত হোতাদের ধরতে মাঠে নেমেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
বিভিন্ন মাধ্যমে পাওয়া অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রথমে দুদক নিজেরা অনুসন্ধান না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকেই ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য চিঠি দিয়েছিল।
কিন্তু তাদের ব্যবস্থা কিংবা জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় কমিশন দুদকের একজন মহাপরিচালকের নেতৃত্বে একটি বিশেষ টিম গঠন করে অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় বলে সংস্থাটির ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে নিশ্চিত করেছে।
এ বিষয়ে দুদকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুদকের বিশেষ টিম অনুসন্ধানের শুরুতে বেশকিছু রেকর্ডপত্র সংগ্রহ করেছে। বেশকিছু নতুন তথ্য দুদকের হাতে এসেছে। যা যাচাই-বাছাই করতেই সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের তলব করা হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায় ৮ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ডাকা হয়েছে, সামনে আরো কর্মকর্তাদের বক্তব্য নেবে টিম।
যাদের তলব করা হয়েছে তারা হলেন- ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. জয়নাল আবেদীন, মোস্তাফিজুর রহমান, মাসুদ রানা ও শাকিল আহমেদ। তাদের আগামীকাল সোমবার জিজ্ঞাসাবাদ করার কথা রয়েছে।
অন্যদিকে ১৮ এপ্রিল তলবকৃতরা হলেন- ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. ফিরোজ রেজা, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট মো. রাজিব হোসেন, মো. জাহাঙ্গীর আলম ও মো. রিপন মিয়া।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসন বিভাগের পরিচালক বরাবর দুদকের দেওয়া চিঠিতে অভিযোগের বিষয়ে বলা হয়েছে, করোনা আক্রান্ত রোগীদের জরুরি সেবাদানের জন্য ১২০০ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পদের মধ্যে ১৮৩টি পদে অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থের বিনিময়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সরাসরি স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। অভিযোগের তীর বঙ্গবন্ধু মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পরিষদের ঊর্ধ্বতন নেতাদের বিরুদ্ধে।
অভিযোগ সূত্রে জানা যায়, দেশের হাসপাতালগুলোতে দীর্ঘদিন ধরে মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ঘাটতি বিদ্যমান। যে কারণে করোনার মহামারির মধ্যে দেশে ল্যাবরেটরিগুলোর কার্যক্রম বাড়াতে হয়েছে। ফলে নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের ঘাটতি প্রকট আকার ধারণ করে। এ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে চিকিৎসক ও নার্সের মতো টেকনোলজিস্ট নিয়োগের দাবি ওঠে। সামগ্রিক বিষয় বিবেচনায় নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ৩ হাজার টেকনোলজিস্ট নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছিলেন।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকাকালে তড়িঘড়ি এই নিয়োগ সম্পর্কিত কাজ শেষ করা হয়। পুরো প্রক্রিয়ার সঙ্গে অধিদপ্তরের একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও জড়িত। অযোগ্যদের নিয়োগ দেওয়ার জন্য সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়স, অভিজ্ঞতাসহ অন্যান্য বিষয় শিথিল করা হয়। নিয়োগ বাণিজ্য বাস্তবায়নে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ভেরিফাইড নয় এমন আইডি থেকে তথ্য চাওয়া হয়। নিয়োগ প্রক্রিয়ায় জনপ্রতি মোটা অঙ্কের আর্থিক লেনদেন হয়েছে বলে অভিযোগ ওঠে। যার আর্থিক লেনদেনের অডিও রেকর্ড রয়েছে বলেও দুদকের অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। যেখানে জনপ্রতি ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকা লেনদেনের তথ্য রয়েছে বলে জানা গেছে।
মেডিকেল সংগঠনগুলো ক্ষোভ
করোনার সময়ে আলোচিত ওই নিয়োগের বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দেয়। ওই সময়ে ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্ট নিয়োগে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের শাস্তিও দাবি করেছিল মেডিকেল টেকনোলজিস্ট পেশায় প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠনের নেতারা।
২০২০ সালের ১০ জুন এক যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি জানায় বাংলাদেশ মেডিকেল টেকনোলজিস্ট অ্যাসোসিয়েশনসহ (বিএমটিএ) পাঁচটি সংগঠন।
বিবৃতিতে সংগঠনগুলো বলেছে, প্রায় ২৫ হাজার বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্ট রয়েছেন দেশে। করোনার প্রাদুর্ভাব দেখা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার কাজে অংশ নেওয়ার জন্য বেকার মেডিকেল টেকনোলজিস্টরা স্বাস্থ্য বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে একাধিকবার আবেদন করেছেন। কিন্তু তাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে অস্থায়ী ও মাস্টার রোলে ১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ নিয়োগবিধির পরিপন্থি। প্রচলিত নিয়োগ বিধিমালায় মেডিকেল টেকনোলজিস্টদের অস্থায়ী বা মাস্টার রোলে নিয়োগের কোনো বিধান নেই।
১৮৩ জন মেডিকেল টেকনোলজিস্টকে কোন হাসপাতালে, কী প্রক্রিয়ায়, কোন কর্তৃপক্ষ, কী কী শর্তে, কোন তারিখে অস্থায়ী বা মাস্টাররোলে নিয়োগ দিয়েছেন স্বাস্থ্য বিভাগের কেউ তা বলছেন না। আমরা মনে করি সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি অস্বচ্ছ। সংগঠনগুলো এ নিয়োগের নিন্দা ও নিয়োগ বাতিলের আহ্বান জানায়।
আরএম/এমএ