‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরানোর মতো সময় আমাদের নাই’
সরকার কোনো অবস্থাতেই সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনবে না— সাফ জানিয়ে দিয়েছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফেরত আনার পেছনে সময় নষ্ট হবে। এ সময় তো আমাদের নাই।’
সোমবার (২০ মার্চ) রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘ইউনিভার্সাল পিরিয়ডিক রিভিউ- ইউপিআর’ বা সর্বজনীন পর্যায়ক্রমিক পর্যালোচনায় অংশীজনদের খসড়া নিয়ে জাতীয় পরামর্শ সভায় এমন মন্তব্য করেন প্রতিমন্ত্রী।
তিনি বলেন, এমন কোনো ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেনি যে বর্তমান সরকার বা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বাধ্য করবে সংবিধান সংশোধন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে। বর্তমান আইনের মধ্যেই সব কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
‘বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে এলেই প্রশ্ন তৈরি হয়। কারণ, প্রধান বিরোধী দল এতে অংশগ্রহণ করতে চায় না। ২০১৪ সালের নির্বাচনের বাস্তবতা আমরা সবাই জানি। তাদের (বিএনপি) প্রধান শরিকরা ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে চায়নি। নির্বাচন সংক্রান্ত অঙ্ক আমরা সবাই জানি। বাংলাদেশে দুই থেকে পাঁচ শতাংশ ভোট পরিস্থিতি বদলে দেয়।’
‘আমরা বিশ্লেষণ করে দেখেছি, ২০০১ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ৯০ আসনে গড়ে দুই থেকে পাঁচ হাজার ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে। আমরা কারও সঙ্গে জোট করলে হিসাব পাল্টে যেত। ২০১৪ সালে এ অঙ্ক কষেই জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনে আসেনি। ২০১৮ সালে তারা (বিএনপি) নির্বাচিত হতে পারেনি। কারণ, আসনগুলোতে একাধিক প্রার্থী দিয়েছিল তারা। এমন অবস্থায় বিরোধী দল যদি মাঠে না থাকে, তাহলে অন্য কোনো বিশ্লেষণের প্রয়োজন থাকে না।’
শাহরিয়ার আলম বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সরকারের যেমন দায়িত্ব রয়েছে, তেমনি অন্যদেরও দায়িত্ব আছে। সেই দায়িত্ব পালনে আমরা কাউকে জোর করে বাধ্য করতে পারি না। এ অবস্থার উন্নয়নের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয়ের মানবাধিকার বিষয়ক জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হুমা খান, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি রঞ্জন কর্মকারসহ বিভিন্ন সংস্থার মানবাধিকার কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (ডিএসএ) প্রসঙ্গে কথা বলেন শাহরিয়ার আলম। এ প্রসঙ্গে তার ভাষ্য, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের প্রয়োজন নাই। এ আইন সাংবাদিকদের দমনে করা হয়নি। তবে, এটি স্বীকার করতে হবে যে কেউ কেউ অতি উৎসাহী হয়ে এর কিছু অপপ্রয়োগ করেছেন। সাংবাদিকদের ওপর এটি ব্যবহার করতে গেলে উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের অনুমতি নেওয়ার একটি অলিখিত বিধান করা হয়েছে। গত কয়েক মাস ধরে এটি চলছে। আইনটি বাতিলের কোনো প্রয়োজন নেই।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বরাত দিয়ে প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার বলেন, ‘আইনমন্ত্রী বলেছেন, প্রয়োজনে এ আইনের সংশোধন করা হবে। আইনটির সঠিক ব্যবহারে পুলিশসহ নিম্ন আদালতে এটি নিয়ে কাউন্সিলিং করা হচ্ছে। আমরা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে সহায়তা নিচ্ছি। আমরা চাই না এ আইনের অপব্যবহার কেউ করুক।’
নির্বাচন নিয়ে টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান বলেন, নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমিকা যেন নিরপেক্ষ হয়, সেটাই আমাদের চাওয়া। যেন সব প্রতিযোগী, অংশগ্রহণকারী ও অংশীদারের জন্য সেটা নিশ্চিত হরা হয়। এটা নিশ্চিত করা গেলে ভোটাররা আত্মবিশ্বাস পাবেন। ভোট নিয়ে ভোটারদের মধ্যে যে অনাস্থা তৈরি হয়েছে, সেই আস্থা ফিরিয়ে আনা যাবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তিনি বলেন, ‘এ আইনের মধ্যে কোনো নিরাপত্তা নাই। আইনটি বাতিল করতে হবে। সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু সংস্কার করলেও পুরোপুরি নিরাপদ নয় আইনটি।’
এ সময় বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে আসায় সরকারের প্রশংসা করেন ইফতেখারুজ্জামান। বলেন, ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে এসেছে। তবে, এটা একেবারে নির্মূল হয়ে গেছে, সেটা বলছি না। যেন এটা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায় সেই অনুশীলন বা কৌশল প্রয়োগ করতে হবে।’
এদিকে, গুমের অভিযোগ নিয়ে মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ‘তথ্যগত’ অভিযোগের সমালোচনা করেন শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘একটি সংস্থা বলল যে দুই হাজার মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছে শাপলা চত্বরে। আমরা তাদের কাছে তালিকা চেয়েছি। কিন্তু তারা দিতে পারেনি। কয়েক দিন আগে পত্রিকায় দেখলাম ৬০০ জন গুম! আজ কে যেন বলল ৭৯১ জনের কথা। দয়া করে সরকারকে এর তালিকা দেন।’
‘অনেক বলার পর জাতিসংঘ একটি তালিকা দিয়েছে ৭৮ জনের। এ তালিকা থেকে ১০ জনকে খুঁজে পেয়েছি। বাকিদের মধ্যে ২৮ জনের শাস্তি হয়েছে। এর মধ্যে কেউ কলকাতা হয়ে মধ্যপ্রাচ্য গিয়ে স্বর্ণের ব্যবসায়ী হয়েছেন কি না, তা তো আমরা বলতে পারব না।’
মানবাধিকার প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে শাহরিয়ার আলম বলেন, ‘বাংলাদেশে ফাঁসির বিপক্ষে কাউকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিদেশিরা বললেই এটা তুলে নেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে এখনও সেই বাস্তবতা আসেনি।’ সাক্ষী সুরক্ষা আইন তৈরিতে সরকার কাজ করছে বলেও জানান প্রতিমন্ত্রী।
আসকের নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান এ সময় বলেন, মানবাধিকারের বিষয়ে সংখ্যাগত তথ্য প্রত্যাখ্যান না করে গভীরভাবে বিষয়টি উপলব্ধি করতে হবে। জোরপূর্বক গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যা— বিষয়গুলো প্রত্যাখ্যান না করে কাজ করা দরকার। একটা স্বাধীন কমিশন যদি এ নিয়ে করে দেওয়া যায় তাতে কোনো বাধা থাকার কথা নয়।
এনআই/এমএআর/