ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজের ‘আত্মহত্যা’, হত্যা বলে প্রচারের নেপথ্যে…
বিবাহিত জীবন গোপন করা নিয়ে প্রেমিকা সায়মা জেরিন প্রিয়াংকার সঙ্গে টানাপোড়েন, নিজ গ্রুপের কর্মীদের সঙ্গে টেন্ডারের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব এবং পরিবারের সদস্যদের মানসিক নির্যাতনে ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ ইরফান চৌধুরী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন- পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির তদন্তে এমনটি উঠে এসেছে। এছাড়া রাজনৈতিক গুরু ও চট্টগ্রামের সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের আশীর্বাদ প্রত্যাহারও তার আত্মহত্যার অন্যতম কারণ বলে উল্লেখ করেছে সিআইডি।
দীর্ঘ ছয় বছর তদন্তের পর দিয়াজের আত্মহত্যাকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে প্রচার চালিয়ে যাওয়ার নেপথ্যের কারণও উদ্ঘাটন করেছে সিআইডি। তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীকে প্রশ্নবিদ্ধ করা, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত করা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে দিয়াজের আত্মহত্যাকে হত্যাকাণ্ড বলে প্রচার করে উপাচার্য বিরোধী একটি পক্ষ। এছাড়া চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম শহরকে অস্থিতিশীল করতে দিয়াজের মৃত্যুকে ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে প্রচার করতে ‘বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক ইন্ধন’ ছিল বলেও সিআইডির তদন্তে উঠে এসেছে।
অবৈধভাবে জমি দখলদারদের উচ্ছেদ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণের নেতৃত্ব দেওয়ায় তৎকালীন সহকারী প্রক্টর ও সমাজতত্ত্ব বিভাগের বর্তমান সহযোগী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে অবৈধ দখলদারদের ইন্ধনে মামলায় জড়ানো হয়েছে বলেও সিআইডির তদন্তে উল্লেখ করা হয়েছে। পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনকে রাজনৈতিকভাবে বেকায়দায় ফেলতে তার অনুসারী রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের এ মামলায় ফাঁসানো হয়েছে বলেও তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
আরও পড়ুন >> ছাত্রলীগ নেতা দিয়াজ হত্যা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন
২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের দুই নম্বর এলাকার নিজ বাসা থেকে ঝুলন্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ–সম্পাদক দিয়াজ ইরফান চৌধুরীর মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। দিয়াজের মা ও বাবা চবির কর্মকর্তা হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে শুরু হয় নানা জল্পনা-কল্পনা। দিয়াজকে কে, কেন হত্যা করবে— তা নিয়ে শুরু থেকেই ছিল প্রশ্ন। আবার আত্মহত্যা করলে কেনই-বা এমন সিদ্ধান্ত নেবেন দিয়াজ, সেই প্রশ্ন ওঠে। এসব প্রশ্নের উত্তর মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয় তদন্ত-সংশ্লিষ্টদের।
দুই দফা ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে বিপরীত রিপোর্ট আসায় হত্যাকাণ্ড ধরে নিয়েই তদন্ত শুরু করে সিআইডি। যদিও প্রথম ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দিয়াজের মৃত্যু ‘আত্মহত্যাজনিত’ বলে উল্লেখ করা হয়। ওই প্রতিবেদন ও স্থানীয় সাক্ষ্য-প্রমাণের ভিত্তিতে হাটহাজারী থানা পুলিশ ওই ঘটনায় দায়ের হওয়া ‘অপমৃত্যু’ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন আদালতে।
এদিকে, দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে দিয়াজের শরীরে আঘাতের চিহ্ন পাওয়ার কথা উল্লেখ থাকায় আদালত মামলাটি হাটহাজারী থানায় নিয়মিত মামলা হিসেবে রুজুর আদেশ দেন। পরে পুলিশ হেডকোয়ার্টারের আদেশে সিআইডি এ মামলার তদন্ত শুরু করে। এরপর দীর্ঘ ছয় বছর তদন্ত শেষে সিআইডি গত ২৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
সিআইডির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, দিয়াজের মৃত্যুতে চট্টগ্রাম শহর ও চবি ক্যাম্পাসে ব্যাপক তোলপাড় সৃষ্টি হয়। একপক্ষ আরেক পক্ষকে ঘায়েল করতে দিয়াজের মৃত্যুকে ব্যবহার করে। নগর আওয়ামী লীগের বিবদমান দুটি পক্ষ জড়িয়ে যায় কাদা ছোড়াছুড়িতে। দিয়াজের পরিবারও তার মৃত্যুর পর রাজনৈতিক পক্ষ-বিপক্ষের অংশীদার হয়ে যায়।
টেন্ডারের ভাগাভাগি নিয়ে মন ভাঙে দিয়াজের
চবিতে ৯৫ কোটি টাকার দুটি টেন্ডার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ সভাপতি আলমগীর টিপু, সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজনের সঙ্গে দিয়াজের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। টিপু ও সুজন ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এবং দিয়াজ চট্টগ্রামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে অবস্থান নেন। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে টেন্ডার প্রক্রিয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ায় দিয়াজের অনুসারীরা টেন্ডার শিডিউল কেনার শেষ দিন চবিতে অবরোধের ঘোষণা দেয়।
পরে জানা যায়, টেন্ডার শিডিউল কেনার শেষ দিন ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দিয়াজের বৈঠক হয়। বৈঠকে ওই প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে দিয়াজ পরিচালিত ‘বাংলার মুখ গ্রুপ’ ও চবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি রেজাউল করিম, এনামুল হক অভি, রাশেদ হোসাইন ও উপ-দপ্তর সম্পাদক মিজানুর রহমান বিপুল পরিচালিত ‘ভিএক্স গ্রুপ’-কে ২৫ লাখ টাকার চেক দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। এর মধ্যে বাংলার মুখ গ্রুপ ১০ লাখ, ভিএক্স গ্রুপ ১০ লাখ এবং দিয়াজের জন্য পাঁচ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, দিয়াজের বাংলার মুখ ও ভিএক্সগ্রুপের কেউ ঢাকার প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কাজ করবে না। কিন্তু দিয়াজ মৌখিক প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে সরাসরি ২৫ লাখ টাকার চেক দাবি করে জানান, চেক পেলেই তিনি তার গ্রুপকে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে কর্মকাণ্ড থেকে বিরত রাখবেন। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি দিয়াজের কথা মতো তাকে ২৫ লাখ টাকার চেক দেন বলে জানা যায়। টেন্ডারের কার্যাদেশ ওই প্রতিষ্ঠান পেলে ওই চেকের টাকা ক্যাশ করা হবে বলে বৈঠকে সমঝোতা হয়।
সিআইডির প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, দিয়াজ যখন ঢাকার প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের কাছ থেকে ২৫ লাখ টাকার চেক নিয়ে সমঝোতা করেন, তখন তার অনুসারীরা চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টেন্ডার শিডিউল কিনতে চবি প্রকৌশল দপ্তরে হাজির হন। এসময় চবি ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মোহাম্মদ মামুন ওরফে ক্রীড়া মামুন, ভিএক্স গ্রুপের সহ-সভাপতি রাশেদ হোসাইন, এনামুল হক অভির সঙ্গে চবি ছাত্রলীগ সভাপতি টিপু ও সাধারণ সম্পাদক সুজনের অনুসারীদের মধ্যে মারামারি হয়।
এতে ছাত্রলীগ সভাপতি টিপুর অনুসারীদের হাতে মারধরের শিকার হন দিয়াজের অনুসারী মামুন ও ভিএক্স গ্রুপের নেতা রাশেদ। তারা চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে শিডিউল কিনতে ব্যর্থ হন। এদিকে, দিয়াজ ২৫ লাখ টাকার বিনিময়ে ঢাকার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমঝোতা করে ফেলেন। বিষয়টি নিয়ে ওই রাতে মামুনের সঙ্গে দিয়াজের কথা কাটাকাটি হয়। মামুন ও নাজিম ওই সময় দিয়াজকে জানান, ১০ লাখ টাকা নিয়ে তাদের গ্রুপের দেড়-দুইশ কর্মীর দায়িত্ব নেওয়া সম্ভব নয়। এ চেকের টাকা মামুন ও নাজিম নেবেন না বলে জানান। তবে, দিয়াজের ২৫ লাখ টাকার চেক নেওয়ার মর্মে তদন্তকালে কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এদিকে, দিয়াজের অনুসারী মামুন চবি ছাত্রলীগের সভাপতি টিপুর অনুসারী সহ-সভাপতি তায়েফুল হক তপুর বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির অভিযোগ তোলেন। এ নিয়ে তপু ও মামুনের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। চট্টগ্রামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে টেন্ডারের শিডিউল কিনতে গেলে মামুনকে মারধর করেন তপু। এ ঘটনায় দিয়াজ, মামুন, নাজিম, সুমন কান্তি, আবু বকর তোহা, আবু সাইদ মারজানসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে হাটহাজারী থানায় তপুর পক্ষে মিজানুর রহমান মামলা করেন। তপুর অনুসারীরা দিয়াজ, মামুন, নাজিম ও আবু বকর তোহার বাড়িতে হামলা চালায়। এ ঘটনায় দিয়াজের মা জাহেদা আমিন বাদী হয়ে হাটহাজারী থানায় মামলা করেন।
ঘর-বাড়িতে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনায় দিয়াজ ইরফান চৌধুরী হতাশ হয়ে পড়েন। কারণ, তপুর ওপর হামলার কথা দিয়াজ জানতেন না। ফলে মামুন, নাজিম ও আবু বকর তোহাসহ অন্যান্য অনুসারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারান দিয়াজ। বাংলার মুখ নামে দিয়াজের যে গ্রুপ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিল, ওই গ্রুপের জুনিয়রদের ওপর থেকেও তার নিয়ন্ত্রণ চলে যায়। ক্যাম্পাসে কোণঠাসা হয়ে পড়েন দিয়াজ।
আরও পড়ুন >> সিআইডির প্রতিবেদনে নারাজি দেওয়া হবে, দিয়াজের বোন জুবাঈদা
সিআইডির দেওয়া প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, দিয়াজের বাংলার মুখ গ্রুপের দেড় শতাধিক অনুসারী ছিল। তাদের মধ্যে মামুন ও নাজিমের পক্ষে কিছু অনুসারী চলে যায়। কিছু অনুসারী চবি ছাত্রলীগের প্রচার সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম জিসানের পক্ষে চলে যায়। তপুর ওপর হামলার পর থেকে দিয়াজের অনুসারীরা ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত হওয়ার পেছনে ‘তার প্রতারণাকে’ দায়ী করেন।
পারিবারিক চাপ ও অশান্তি থেকেই আত্মহত্যা
সিআইডির তদন্তে দিয়াজের ওপর পারিবারিক নানা চাপের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়, দিয়াজের বাবা-মা আলাদা থাকতেন। তার পরিবারেও দীর্ঘদিন ধরে অসন্তোষ বিরাজ করছিল। দিয়াজের বাবা বিয়ে করে আলাদা বাসায় থাকেন এবং মা তার ছেলে-মেয়েদের নিয়ে আলাদা বাসায় থাকেন। দিয়াজের বেকার থাকা এবং বাড়িতে হামলার ঘটনায় পরিবারের সদস্যরা তার ওপর মানসিক নির্যাতন চালায়। তদন্ত প্রতিবেদনে পরিবারের চাপের বিষয়ে ওই সময় দিয়াজের দেওয়া ফেসবুক পোস্ট তুলে ধরেন।
দিয়াজের মৃত্যুকে পুঁজি করে যা ঘটেছিল
দিয়েজের মৃত্যুকে পুঁজি করে নানাভাবে অপরাজনীতি শুরু হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সেসব বিষয়ও উঠে এসেছে। এতে উল্লেখ করা হয়, চট্টগ্রামের তৎকালীন মেয়র নাসির সমর্থিত ছাত্রলীগের সঙ্গে সাবেক মেয়র এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী সমর্থিত ছাত্রলীগের দ্বন্দ্ব সর্বজনবিদিত। দিয়াজ তৎকালীন মেয়র নাসিরের অনুসারী ছিলেন। দিয়াজের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে প্রচার করে মহিউদ্দিন চৌধুরীর সমর্থকরা।
আবার তৎকালীন চবি উপাচার্য ইফতেখার চৌধুরীর সঙ্গে উপাচার্যবিরোধী পক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাভাবিক শিক্ষাকার্যক্রম ব্যাহত ও উপাচার্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করার লক্ষ্যে দিয়াজের মৃত্যুকে আত্মহত্যার পরিবর্তে ‘হত্যা’ বলে চালানোর চেষ্টা করে। সিআইডির প্রতিবেদনে চবির সীমানা প্রাচীর নির্মাণ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টরিয়াল বডির সঙ্গে কয়েকজন শিক্ষক-কর্মচারীর বৈরিতার বিষয়ও উঠে আসে।
প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়, চবি সংলগ্ন বিভিন্ন এলাকার কিছু শিক্ষক, কর্মচারী ও স্থানীয়রা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিতে অবৈধভাবে বাড়ি নির্মাণ করেন। উপাচার্যের তত্ত্বাবধানে মামলার দুই নম্বর আসামি চবির সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করতে সব অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। ফলে অবৈধ দখলকারীরা উপাচার্য ও সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন চৌধুরীর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। তারা দিয়াজের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ অস্থিতিশীল করার চেষ্টা চালান। শিক্ষক আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে ফাঁসানো হয় মামলায়। এছাড়া বিএনপি ও জামায়াতের রাজনৈতিক ইন্ধনে দিয়াজের মৃত্যুর বিষয়টি ‘হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে প্রচার করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম শহরকে অস্থিতিশীল করার পাঁয়তারা চালানো হয়।
জবানবন্দিতে যা বলেছেন দিয়াজের প্রেমিকা প্রিয়াঙ্কা
সায়মা জেরিন প্রিয়াঙ্কা চবির ২০১৩-১৪ সেশনের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্রী ছিলেন। পড়াশোনার সময় তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। ২০১৪ সালে দিয়াজের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। দিয়াজের মাধ্যমে প্রিয়াঙ্কা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-ছাত্রীবিষয়ক সম্পাদকের পদ পান। দিয়াজের সঙ্গে তিনি কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের নেতাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য ঢাকায়ও যান। একসঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেওয়ার সুবাদে প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে দিয়াজের ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। একপর্যায়ে তাদের মধ্যে গভীর প্রেম ও পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দিয়াজ নগরের বালুচরায় প্রিয়াঙ্কার বাসায় এবং প্রিয়াঙ্কাও চবির দুই নম্বর এলাকায় দিয়াজের ভাড়া বাসায় যাতায়াত করতেন।
আত্মহত্যার শ্বাসরুদ্ধকর রাতের সময়ের বর্ণনা দিয়ে প্রিয়াঙ্কা জানান, ওই বছরের ১৯ নভেম্বর রাতে দিয়াজের সঙ্গে মনোমালিন্য হয়। দিয়াজ বাসায় যাওয়ার জন্য চাপ দিতে থাকেন। কিন্তু আমি আমার বাসায় চলে আসি। বাসায় ফিরে আসার পর ওর সঙ্গে থাকা এক বন্ধু ফোনে জানায় দিয়াজকে একটু ‘অ্যাবনরমাল’ (অপ্রকৃতিস্থ) ও ‘ড্রাঙ্ক’ (মাতাল) মনে হচ্ছে। আমি যেন দিয়াজের বাসায় অবশ্যই যাই।
দিয়াজের সঙ্গে থাকা যুথী ও ফয়সালকে বলি, দিয়াজকে যেন আমার এলাকায় নিয়ে আসে। ওরা এলে সেখানে সহ-সভাপতি মামুনও আসে। দিয়াজ মামুনকে রেগে গিয়ে থাপ্পড় দেয়। মামুনও গালিগালাজ করতে থাকে দিয়াজকে। পরে আমি, যুথী ও ফয়সাল সিএনজিতে করে দিয়াজকে নিয়ে তার বাসায় আসি। মামুনও ক্যাম্পাসের দিকে চলে যায়। দিয়াজ বাসায় ঢুকে একটার পর একটা সিগারেট খাচ্ছিল। পরে সে তার রুমে চলে যায়।
প্রিয়াঙ্কা বলেন, আমরা তিনজন দিয়াজেররুমে গিয়ে দেখি তাররুম ভেতর থেকে আটকানো।দিয়াজ কোনো কথা বলছিলনা। পরে আমরা রুমে চলে আসি। ফয়সাল আমাকে বলেছিল, দিয়াজ তার মোবাইল ভেঙেফেলেছে। আমরা ভোর ৪টার দিকে দিয়াজকে ডাকলেও তার কোনো সাড়া মিলছিল না। আমরা ভেবেছিলামদিয়াজ ঘুমিয়ে পড়েছে।
দিয়াজের বাসা থেকে ভোর ৬টা থেকে সাড়ে ৬টার দিকে আমরা চলে আসি। তখন দরজা বন্ধ করার জন্য দিয়াজকে ডাকাডাকি করি। তখনও দিয়াজের কোনো সাড়া-শব্দ ছিল না। আমরা বালুচরা এসে বন্ধু সাজ্জাদ ও বাংলার মুখ গ্রুপের সাদবীনকে নিয়ে সকাল সাড়ে ৮টা থেকে ৯টার মধ্যে দিয়াজের বাসায় যাই। আমরা সবাই তাকে ডাকলেও কোনো সাড়া-শব্দ ছিল না। পরে সাজ্জাদ কিচেনের বেলকনি দিয়ে নেমে দিয়াজের রুমের ভেতর উঁকি মারে। ও ফিরে এসে জানায়, দিয়াজ ভাই মনে হয় আর বেঁচে নেই। আমি বললাম, সাজ্জাদ তুই কী দেখেছিস? সাজ্জাদ বলে, শুধু দোয়া কর, দিয়াজ ভাই যেন স্বাভাবিক থাকে। আমরা সবাই চলে আসি। রাতে সাজ্জাদ ফোনে জানায়, ভার্সিটিতে মাইকিং হচ্ছে দিয়াজ বেঁচে নেই।
সিআইডি চট্টগ্রাম জেলা ও মেট্রোর বিশেষ পুলিশ সুপার শাহনেওয়াজ খালেদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ঘটনার বিষয়ে একজন আদালতে এবং বাকিরা পুলিশের কাছে সাক্ষী দিয়েছেন। সার্বিক তদন্ত শেষে আত্মহত্যার পক্ষে সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এজন্য আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার আবদুস ছালাম মিয়া ঢাকা পোস্টকে বলেন, আল্লাহকে হাজির জেনে এ মামলার তদন্ত করেছি। খুঁটিনাটি বিষয়ে উল্লেখ করার চেষ্টা করেছি। সোহেলের জবানবন্দিও নেওয়া হয়েছে। কেস ডকেটে রেখেছি। মামলায় আত্মহত্যার পক্ষে সুস্পষ্ট চারটি কারণ উল্লেখ করেছি। এগুলো হলো- প্রেমিকা প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে সম্পর্কের জটিলতা, টেন্ডার সংশ্লিষ্ট টাকার ভাগাভাগি নিয়ে নিজ গ্রুপে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া, রাজনৈতিক গুরু ও সাবেক মেয়র নাছিরের আশীর্বাদ প্রত্যাহার এবং পারিবারিক বিভিন্ন বিষয়ে মানসিক চাপ।
চূড়ান্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়ার পর মামলার বাদী ও দিয়াজের মা জাহেদা আমিন চৌধুরী ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘সিআইডি বাসার অন্যান্য নারী এবং দোকানদার সোহেলের সাক্ষ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করল না কেন? তারা যার জবানবন্দি নিয়েছে, সে যদি ঘটনাস্থলে থাকে তাহলে তো তার আসামি হওয়ার কথা। তাকে রিমান্ডে নিয়ে বক্তব্য নেওয়ার কথা। এখন তো তাকে শিখিয়ে দেওয়া কথা বলানো হয়েছে। মেয়েটাকে কোর্টে জবানবন্দি দিতে নেওয়ার আগে আমাকেসহ একসঙ্গে বসানোর কথা ছিল। এর আগে আসামিদের দ্বারা আমার বাড়ি ভাঙচুরের একটি মামলা সিআইডিতে ছিল। ওই মামলার রিপোর্ট দেওয়ার আগে আমাকে ঢাকা থেকে ফোন দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এবার তা করা হয়নি। আমাদের হাতে আসার আগে সিআইডির রিপোর্ট আসামিদের হাতে গেছে।’
‘সিআইডি আমাকে নিয়ে প্রথমে ক্লু বের করে। ওই সময় আমি তাদের বলেছি, মামুনকে (ক্যাম্পাসে দিয়াজের অনুসারী ছাত্রলীগ নেতা) যাতে সব বিষয় না জানায়। আমার সব জানার পর সিআইডি মামুনকে নিয়ে গোপনে ক্যাম্পাসে আসত। আমি মামুনকে অজ্ঞাত আসামি বলেছি। সোহেল যখন সব সাক্ষ্য দিতে চাইল, সিআইডি তাকে হুমকি দিয়ে বলল, তুই কি মরতে চাস? সোহেলের সাক্ষ্য যখন দেওয়া হচ্ছে না শুনলাম, আমি সিআইডি অফিসে গেলাম। আমাদের একসঙ্গে সাক্ষ্য নেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু নেওয়া হয়নি। সিআইডি আমাকে বলে এটা অনেক জটিল বিষয়। তারা আমাকে ইঙ্গিত দিয়ে খরচের কথা বলে। আমি বলি যাতায়াতের খরচ দেওয়া যাবে। এর বেশি কিছু আমি দিতে পারব না। এরপর সিআইডি ক্যাম্পাসে গেলে ড্রাইভারের মাধ্যমে কিছু খরচ দিতাম।’
দিয়াজ ইরফান চৌধুরী ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সম্পাদক ছিলেন। চবি ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর রাত ১০টার দিকে চবির বাইরে দুই নম্বর এলাকায় নিজ বাসা থেকে তার ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ওই বছরের ২৩ নভেম্বর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে দেওয়া প্রথম ময়নাতদন্তে তিনি আত্মহত্যা করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়। এর ভিত্তিতে হাটহাজারী থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করে পুলিশ।
তবে, পরিবার ও ছাত্রলীগের একাংশ (দিয়াজের অনুসারী) এটি প্রত্যাখ্যান করলে ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগে মরদেহের দ্বিতীয় ময়নাতদন্ত হয়। সেই প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজকে শ্বাসরোধ করে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে।
ওই বছরের ২৪ নভেম্বর দিয়াজের মা আদালতে হত্যা মামলার আবেদন করেন। মামলায় চবি ছাত্রলীগের তৎকালীন সভাপতি আলমগীর টিপু, তৎকালীন চবির সহকারী প্রক্টর আনোয়ার হোসেন, ছাত্রলীগের নেতা জামশেদুল আলম চৌধুরী, রাশেদুল আলম জিশান, আবু তোরাব পরশ, মনসুর আলম, আবদুল মালেক, মিজানুর রহমান, আরিফুল হক অপু ও মোহাম্মদ আরমানকে আসামি করা হয়। দিয়াজ ও আসামিরা সবাই মেয়র নাছিরের অনুসারী ছিলেন।
দিয়াজের মায়ের আবেদনে আদালত সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতেনির্দেশ দেন। ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর দিয়াজের মরদেহ তুলে ঢাকা মেডিকেলকলেজে দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত করা হয়। ২০১৭ সালের ৩০ জুলাই দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্তের প্রতিবেদনে বলা হয়, দিয়াজের শরীরে আঘাতজনিত জখমের মাধ্যমে হত্যার আলামত আছে। পরে দিয়াজের মায়ের করা এজাহার হত্যা মামলা হিসেবে নিতে হাটহাজারী থানার ওসিকে নির্দেশ দেন আদালত। তবে নানা আলোচনা শেষে সিআইডি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে জানায়, মামলায় তথ্যগত ভুল আছে।
এমআর/ওএফ/এফকে/এমএআর