২১ জেলায় চলাচলে ভোগান্তির নতুন নাম বিআরটি
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছ থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস চলাচলের বিশেষ ব্যবস্থা ‘বাস র্যাপিড ট্রানজিট’ (বিআরটি) প্রকল্প শেষ হয়নি আট বছরেও। অথচ চার বছরে শেষ হওয়ার কথা ছিল প্রকল্পটির। এখন পর্যন্ত এই কাজের অগ্রগতি ৪৩ শতাংশ।
অভিযোগ উঠেছে, প্রকল্পে নিয়োজিত সংস্থাগুলোর মধ্যে কাজের সমন্বয়হীনতার অভাব রয়েছে। দায়হীনতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ বিমানবন্দরের কাছে প্রকল্পের গার্ডারের অংশবিশেষ ধসে পড়া। রোববারের (১৪ মার্চ) ওই দুর্ঘটনায় চীনা নাগরিকসহ ছয়জন গুরুতর আহত হন। এছাড়া শনিবার রাতে আব্দুল্লাহপুর এলাকার একটি বাজারের সামনে বিআরটি প্রকল্পের একটি পিয়ার ক্যাপ ধসে পড়ে। তবে এতে কোনো হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
• আট বছরে কাজের অগ্রগতি ৪৩ শতাংশ
• ব্যয় বেড়েছে ২ হাজার কোটি টাকার বেশি
• দায়সারা কাজে ধসে পড়েছে গার্ডারের অংশ
ওই দুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা পোস্টের পক্ষ থেকে রাজধানীর উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর অংশে বিআরটি প্রকল্পের কাজের অগ্রগতি সরেজমিনে দেখতে যাওয়া হয়। সেখানে গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সমন্বয়হীনতা এবং নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত না করে কাজ চালিয়ে যেতে দেখা যায়। এছাড়া চার বছরের কাজ আট বছরে শেষ না হওয়ায় বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কটি যেন জনভোগান্তির বিভীষিকাময় রূপ লাভ করেছে। যদিও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে সম্প্রতি প্রকল্পটি দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আক্তার ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আমি সমন্বয় করছি। দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রকল্পের সমন্বয় জোরদারের চেষ্টা চালাচ্ছি।’ ঘটনাস্থলে উপস্থিত নীলিমা আক্তার আরও বলেন, ‘আমরা এ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে আছি। এজন্য সব উদ্যোগ নেওয়া হবে।’
বিআরটি প্রকল্পের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ গত জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্য নির্ধারণ হলেও ওই সময়ের মধ্যে শেষ হয়নি। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার নতুন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অথচ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছিল ২০১২ সালে।
ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত বিমানবন্দর সড়ক ধরে টঙ্গী-গাজীপুর হয়ে ২১ জেলায় যানবাহন চলাচল করে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, এই মহাসড়ক দিয়ে দিনে গড়ে ৬০ হাজার যানবাহন চলে। প্রকল্পের কাজের জন্য বিমানবন্দরের কাছ থেকে উত্তরা, আব্দুল্লাহপুর, টঙ্গী হয়ে গাজীপুর পর্যন্ত প্রায় ২০ কিলোমিটার সড়কের বেশির ভাগের মাঝামাঝি অংশ ব্যবহার করা যাচ্ছে না। দুই পাশের সড়কও এবড়ো খেবড়ো। কোথাও তৈরি হয়েছে গর্ত, কোথাও নেই পিচ। কোথাও আবার নির্মাণসামগ্রী রাখা আছে। মহাসড়কের এই অবস্থায় সকাল থেকেই যানজটে পড়তে হয় যাত্রীদের।
তীব্র যানজটে পড়ে যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে আট বছর ধরে। সরেজমিনে আরও দেখা যায়, সড়কের কোথাও বন্ধ রাখা হয়েছে। বিকল্প সড়কও অপরিকল্পিত। কোথাও কোথাও চালকরা বুঝতেই পারেন না কীভাবে চলাচল করতে হবে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার নিজের বাড়ি গাজীপুরে। এই যানজটের ভোগান্তি এড়াতে ভোরে ঢাকা থেকে রওনা দিয়েও লাভ হয় না।
বিভিন্ন প্রকল্পের কাজ তদারকি করতে এই পথ দিয়েই চলতে হয় ঢাকা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত তৃতীয় ও চতুর্থ রেল লাইন এবং জয়দেবপুর পর্যন্ত ডাবল রেল লাইন প্রকল্পের কর্মকর্তাদের। এই রেলপথ সম্প্রসারণ প্রকল্পের পরিচালক আফজালুর রহমানসহ অন্যদেরও প্রকল্প এলাকায় যেতে হয় সকালের আলো ফোটার আগেই। ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় এমনটি জানান তিনি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক চার লেন হলেও ময়মনসিংহ যেতে আটকে যেতে হয় উত্তরা, টঙ্গী-গাজীপুর অংশে। মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বাসে উঠে যাত্রীরা অসহায়ভাবে যানজটে পড়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এই নাগরিক ভোগান্তির অন্যতম কারণ পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে বিআরটি প্রকল্প বাস্তবায়ন না করা।
প্রকল্পের নথিপত্র ও বিভিন্ন অগ্রগতি প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, চার বছরের মধ্যে প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা থাকলেও সময়সীমা সাড়ে নয় বছর বাড়ানো হয়েছে। সময়মতো প্রকল্পের কাজ শুরু না হওয়া, বারবার নকশার পরিবর্তন, সেতু বিভাগ, সওজ অধিদফতরসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকা, প্রকল্পে আন্ডারপাস যোগ না করা— সর্বোপরি দায়সারা কাজের জন্য প্রকল্পের এই করুণ দশা।
ব্যয় বাড়ল দুই হাজার ২৮৮ কোটি টাকা
প্রকল্পের কাজ লক্ষ্যমাত্রা অনুসারে না এগোলেও ব্যয় ঠিকই বাড়ানো হয়েছে। ব্যয় বেড়েছে দুই হাজার ২২৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা। প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, শুরুতে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় দুই হাজার ৪০ কোটি টাকা। ২০১৮ সালে এর ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় চার হাজার ২৬৪ কোটি ৮২ লাখ টাকায়। ২০২০ সালে তা করা হয় চার হাজার ২৬৮ কোটি ৩২ লাখ টাকা।
সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত প্রকল্প স্টিয়ারিং কমিটির পঞ্চম সভায় কাজে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। তবে প্রকল্প কর্মকর্তারা প্রকাশ্যে এ বিষয়ে মুখ খুলতে নারাজ। তারা বলেন, শুরুতে সেবা সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় না থাকায় নির্দিষ্ট মেয়াদের মধ্যে কাজ শেষ করা সম্ভব হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কর্মকর্তাদের কয়েকজন ঢাকা পোস্টকে বলেন, মেয়াদ বাড়লে মূল্যস্ফীতি হয়, শ্রমিকদের মজুরি ও পণ্যের দাম বেড়ে যায়। রেট শিডিউল পরিবর্তন হয়। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে বিমানবন্দর রেলস্টেশন পর্যন্ত আন্ডারপাস নির্মাণের বিষয়টি প্রথমদিকে ছিল না। এটি যুক্ত করায় ব্যয় আরও বেড়েছে।
সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতার ঢাকা পোস্টকে বলেন, এলজিইডি, সওজ অধিদফতর, সেতু বিভাগ, সিটি করপোরেশনসহ বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে সমন্বয় এখানে গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিতে এটি এখন জোরদার হচ্ছে।
প্রকল্পে যা আছে
প্রকল্পের চারটি অংশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের ছয় লেনবিশিষ্ট সাড়ে চার কিলোমিটার উড়াল অংশ, সাড়ে চার কিলোমিটার সড়ক, ১০ লেনের টঙ্গী সেতু ও ছয়টি বিআরটি স্টেশন নির্মাণ বাস্তবায়ন করছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান জেটিইজি ২০১৭ সালের ১৯ অক্টোবর বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়। প্রকল্পে সেতু বিভাগের অধীনে সাড়ে চার কিলোমিটার উড়াল অংশে আটটি র্যাম্পে মোট ১৬৩টি স্প্যান থাকছে। এখন পর্যন্ত পাইলিংয়ের কাজ ৫৫ শতাংশ, পাইল ক্যাপ ৪৫ শতাংশ, পিয়ার স্টেম ৪৫ শতাংশ ও নালা তৈরির কাজ ৯৮ শতাংশ শেষ হয়েছে।
গাজীপুর-টঙ্গী-বিমানবন্দর বিআরটি নির্মাণে ২০১২ সালের ২০ নভেম্বর একনেক সভায় ‘গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রজেক্ট (বিআরটি, গাজীপুর-এয়ারপোর্ট)’ অনুমোদন দেওয়া হয়। সরকারের পাশাপাশি এডিবি, ফরাসি উন্নয়ন সংস্থা (এএফডি), গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট ফ্যাসিলিটি (ডিইএফ) প্রকল্পে অর্থায়ন করছে।
বর্তমানে বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কের মাঝামাঝি অংশে প্রকল্পের কাজ চলছে। এই অংশে বিআরটি’র ৪.৫ কিলোমিটার উড়ালপথ ও উড়ালসেতু থাকবে। এর মধ্যে ৩.৫ কিলোমিটার ছয় লেনের হবে। এক কিলোমিটার হবে দুই লেনের। এতে ছয়টি উড়াল স্টেশন ও ১০ লেনবিশিষ্ট টঙ্গী সেতু থাকবে। ছয়টি উড়াল সড়ক ও আন্ডারপাস করা হবে। বিআরটি বাস ডিপোসহ বিভিন্ন স্থানে ২৫টি স্টপেজ থাকবে। বিআরটি’র নির্দিষ্ট পথে চলাচলের জন্য ১৪০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনা হবে।
ঢাকা বিআরটি কোম্পানি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শফিকুল ইসলাম ঢাকা পোস্টকে বলেন, রোববারের দুর্ঘটনায় ছয়জন শ্রমিক আহত হয়েছেন। তার মধ্যে পাঁচজন আশঙ্কামুক্ত। আমরা প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিচ্ছি।
পিএসডি/এমএআর/